• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধুলোবালির এই শহরে জনস্বাস্থ্য হুমকিতে


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৭, ০২:৪৯ পিএম
ধুলোবালির এই শহরে জনস্বাস্থ্য হুমকিতে

একসময় ভোররাতে এই ঢাকা শহরে সিটি করপোরেশনের গাড়ি প্রধান সড়কগুলোয় পানি ছিটাতো। পানিতে ধুয়ে যেত দুই পাশের গাছের পাতা। বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা বর্জ্যও পরিষ্কার হতো ভোরের আলো ফোটার আগেই। ভোরে নাগরিকরা পেত ধুলো-আবর্জনামুক্ত পরিচ্ছন্ন এক নগরী। কিন্তু এখন হয় না। শহরে বের হলেই ধুলোয় দম বন্ধ হয়ে আসে। অথচ বিভিন্ন দেশে এখনো ধুলো দূর করতে পানি ছিটানো হয়। সিটি করপোরেশনের গাড়ি প্রতিদিন শহর জেগে ওঠার আগেই রাস্তায় তো বটেই, রাস্তার দুই পাশের গাছের পাতায় পানি ছিটায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেন খান এভাবেই শহর পরিচ্ছন্নের এমন বর্ণনা দিলেন। সেই সঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘কিন্তু সেসব কিছুই নেই। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার প্রধান সড়কের দুই পাশের গাছের পাতায় ধুলোর এমন গভীর আস্তরণ পড়েছে যে, পাতাগুলোর ছিদ্র বন্ধ হয়ে গেছে। 

পাতাগুলো যেমন অক্সিজেন ছাড়তে পারছে না, তেমনি পরিবেশ থেকে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইডও গ্রহণ করতে পারছে না। অথচ এ ধুলোর কারণে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গাছের নিজের খাদ্য তৈরির পথও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে মানবদেহেও। কারণ ধুলোর জন্য পাতার মাধ্যমে মানবদেহের জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরিতেও বিঘ্ন ঘটছে।

পুরো রাজধানী যে এখন ধুলোয় ঢাকা, তা যে কেউ রাস্তায় বের হলেই টের পাবেন। বিশেষ করে প্রধান সড়কগুলোয় উড়তে থাকা ধুলো রূপ নিয়েছে ধুলোর কুয়াশায়। সেই সব ধুলো নিয়েই দম বন্ধ অবস্থায় চলতে হচ্ছে মানুষকে। দ্রুতগতির গাড়ি উন্নয়নের নির্মাণযজ্ঞের ধুলো উড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে। নাকে-মুখে ঢুকছে পথচারীদের। মুখে মাস্ক নিয়েও ধুলো থেকে রক্ষা মিলছে না কারো। বিশেষ করে স্কুলগামী শিশু ও রোগীদের পড়তে হচ্ছে বেশি দুর্ভোগে। ধুলোর পরিমাণ এতটাই বেশি যে, দিনদুপুরের রাস্তায় দেখা দিচ্ছে ধুলোর কুয়াশা।

অথচ এই ধুলো থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে দুই সিটি করপোরেশনের কোনো পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে না। দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ধুলোর মূল কারণ মূলত ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ। যেসব শর্তের মধ্যে থেকে এই নির্মাণকাজ করার কথা, তা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো মানছে না। সেই সঙ্গে রয়েছে আরো কিছু উন্নয়ন কর্মকান্ড। 

এ ছাড়া ঢাকা ওয়াসা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন নালা, তিতাস গ্যাসের লাইন স্থাপন, ডেসকো ও ডিপিডিসি ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক তার, বিটিসিএল টেলিফোন লাইন এবং বিভিন্ন বেসরকারি ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের ভূগর্ভস্থ ইন্টারনেট ক্যাবল লাইন বসাতে রাজধানীজুড়ে সড়ক কাটা হচ্ছে। এসব কাজের জন্যও সড়কে ধুলা হচ্ছে।

এই ধুলোর কারণে শুধু জনস্বাস্থ্যই যে হুমকির মুখে তা নয়; রাজধানীর মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এক জরিপ বলছে, ধুলোর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে শুষ্ক মৌসুমে নিম্নবৃত্ত থেকে উচ্চবৃত্ত পরিবারের খরচ ৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। এর স্বপক্ষে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধুলোর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে কাপড় পরিষ্কার, ঘর ধোয়ামোছা, বাড়ির টপের গাছ পরিষ্কার এবং রোগব্যাধির খরচ মিলিয়ে জরিপে এমন চিত্র মিলেছে।

সমাধান কী—জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মো.আখতার হোসেন খান বলেন, ফ্লাইওভারসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের কাজের সময় বদলাতে হবে। এমন সময় করা উচিত যখন ধুলো উড়বে না। তা ছাড়া বিভিন্ন ভবন নির্মাণের সময় চটের ঘেরাও থাকতে হবে। ধুলো থেকে বাঁচতে জনগণকে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে দুই সিটি করপোরেশনকে অবশ্যই গাড়ি দিয়ে পানি স্প্রে করতে হবে। রাস্তার পাশাপাশি গাছের পাতায়ও পানি ছিটাতে হবে। প্রতিদিন না পারলেও দু-তিন দিন পরপর হলেও পানি ছিটাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

উড়ছে ধুলো: মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ ও শান্তিনগর ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের স্থান ঘুরে দেখা গেছে, ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণে রাস্তায় ব্যাপক ধুলোবালি উড়ছে। ধুলো নিয়ন্ত্রণে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মকানুন মেনে চলার নির্দেশনা থাকলেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না তারা। রামপুরা থেকে মালিবাগ-মৌচাক হয়ে রাজারবাগ-শান্তিনগর, বাংলামোটরের ইস্কাটন থেকে মগবাজার মোড় হয়ে মৌচাক এবং হাতিরঝিল মোড় থেকে কারওয়ান বাজারের দিকে এফডিসি গেট হয়ে সোনারগাঁও হোটেল পর্যন্ত এলাকাগুলোতেই ধুলো উড়ছে সবচেয়ে বেশি। 

মগবাজার হয়ে তেজগাঁও সাতরাস্তা, মহাখালী সব জায়গাতেই ধুলো। বিশেষ করে মগবাজার থেকে মালিবাগ মোড় এবং মৌচাক মোড় থেকে মালিবাগ রেলগেট এবং এই দুই সড়কের আশপাশেসংলগ্ন সড়কগুলোয় এখন কেবলই ধুলো। ধুলোর আস্তরণে খুব কাছের জিনিসও স্পস্ট দেখা যায় না। এ ছাড়া জুরাইন, পোস্তগোলা এলাকার প্রধান সড়কের দোকানপাট, গাছগাছালিতে ধুলোর আস্তর পড়ে আছে। উত্তরার যেসব রাস্তায় উন্নয়ন হচ্ছে, সেসব এলাকায় ধুলোবালির উৎপাত তীব্র। 

গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে গোলাপ শাহ মাজার পর্যন্ত ধুলোর কারণে পথচলাই কষ্টকর। এ ছাড়া এসব নির্মাণ প্রকল্প এলাকাসংলগ্ন এলাকাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে ধুলো। এ ছাড়া সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, গুলিস্তান, বাবুবাজার, রায়েরবাজার, ধানমন্ডি, কাকরাইল, কাওরান বাজারসহ অন্যান্য এলাকা ধুলায় আচ্ছাদিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বাতাসে ধুলো দূষণ অতীতের সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানীবাসী। বিশেষ করে নির্মাণ এলাকার বাসিন্দা ও পথচারীদের দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুসের ক্যানসার, শ্বাসকষ্টসহ জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

এ ক্ষেত্রে শিশুরা রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। ধুলো প্রকৃতপক্ষে অনেক জীবাণুর মিশ্রণ। শতকরা ১০ শতাংশ মানুষ এসব জীবাণুর কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হন। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়, নিঃশ্বাসের সঙ্গে কাশি হয়। ধুলোর মধ্যে মিশে থাকা জীবাণু মানুষের শরীরে ঢুকে অ্যালার্জির সৃষ্টি করে, একসময় যা অ্যাজমায় রূপান্তর হয়।

এ ব্যাপারে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এস এম আনিসুর রহমান বলেন, ধুলোযুক্ত বাতাস গ্রহণের ফলে প্রাথমিকভাবে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে পারে। 

দীর্ঘমেয়াদে এর ক্ষতি হবে অনেক বেশি। ক্যানসার তৈরির সঙ্গে যুক্ত কিছু রাসায়নিক ইউরিয়া, প্যারাবিন, থ্যালেট, পেট্রোলিয়াম বাই প্রডাক্টস ও প্রোপাইলিন গ্লাইকল পানির সঙ্গে মেশে না। এগুলো ধুলার সঙ্গে বাতাসে উড়তে থাকে। ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে গিয়ে ধীরে ধীরে ফুসফুসে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে।

দূষিত বায়ুতে দেশ চতুর্থ : ঢাকার বাতাস যে কতটা বিষাক্ত ও দূষিত তার প্রমাণ আরো পাওয়া যায় ঘরের বাইরে (আউটডোর) বায়ুদূষণের ওপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সর্বশেষ জরিপ। ওই জরিপ বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান চতুর্থ। ৯১টি দেশের এক হাজার ৬০০টি শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত ২৫টি শহরের তালিকায় রয়েছে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও ঢাকা। 

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!