• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নকশায় বিএনপির দুশ্চিন্তা: সরছে জিয়ার সমাধি


এমএ ইউসুফ ডিসেম্বর ৩, ২০১৬, ১২:০৭ পিএম
নকশায় বিএনপির দুশ্চিন্তা: সরছে জিয়ার সমাধি

বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের করা জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশার অনুলিপি এখন দেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার আর্কিটেকচারাল আর্কাইভে সংরক্ষিত আট হাজার নকশা ও নথি থেকে প্রয়োজনীয় ৮৫৩টি নকশা ও ৬০টি ডকুমেন্টের অনুলিপি গত বৃহস্পতিবার দেশে আনা হয়েছে।

জাতীয় সংসদ ভবনের নকশাবহির্ভূত সব স্থাপনা সরিয়ে ফেলা হবে- এমন কথা একাধিকবার বলেছেন সরকারের একাধিক মন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা এই নকশা যখন সরকারের হাতে, তখন বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন বিএনপি। কারণ  নকশাবহির্ভূত স্থাপনা সরানো হলে দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের সমাধি সরানো হতে পারে। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে প্রাণ হারান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তাকে তাৎক্ষণিকভাবে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় প্রথমে সমাহিত করা হয়। এরপর সে সময়ের বিএনপি সরকার জিয়াউর রহমানের দেহাবশেষ রাঙ্গুনিয়া থেকে ঢাকায় নিয়ে এসে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় ‘চন্দ্রিমা উদ্যানে’ সমাহিত করে।

এদিকে, সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, শুধু জিয়াউর রহমানের সমাধি নয়, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে লুই আই কানের নকশার বাইরের সব স্থাপনা দুই মাসের মধ্যে সরিয়ে ফেলা হবে। তিনি বলেন, নকশাবহির্ভূত স্থাপনা হওয়ায় স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনও অপসারণ হতে পারে। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ সচিবালয় এবং স্থাপত্য অধিদফতর ‘মূল নকশা’ যাচাই বাছাই করে দ্রুত সরকারকে একটি প্রতিবেদন দেবে। তারপর গণপূর্ত অধিদফতর প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কার কাজ শুরু করবে বলে জানিয়েছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী। তবে বিএনপির বক্তব্য, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়াউর রহমানের সমাধি সরানো হলে জনগণ মেনে নেবে না। বিএনপি নেতাদের দাবি, দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে হলেও এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে সরকার।

গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদ ভবনের নকশার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, সংসদ ভবনের নকশাবহির্ভূত সব স্থাপনাই সরিয়ে নেয়া হবে। মূল নকশা বাস্তবায়ন হলে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনও থাকবে না। প্রয়োজনে সেগুলোও সরিয়ে নেয়া হবে। 

অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি নানা সময় ‘শহীদ জিয়ার সমাধি’ সরানোর বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে দেয়া বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে আসছে। তারা বলছে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। কার্যত বিএনপির এখন মূল দুশ্চিন্তা দাঁড়িয়েছে জিয়াউর রহমানের সমাধি নিয়ে।

এ প্রসঙ্গে গতকাল শুক্রবার সকালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকার চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে শহীদ জিয়াউর রহমানের সমাধি সরিয়ে নিতে চাইলে, জনগণ সে সিদ্ধান্ত মানবে না। তিনি বলেন, হঠাৎ করে লুই আই কানের নকশা আনা, এটি একটি নীল নকশার অংশ। এর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে জিয়াউর রহমানকে মুছে ফেলা। কিন্তু তা সফল হবে না।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, বর্তমান সরকার সচেতনভাবে চেষ্টা করছে মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়ক, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের যিনি ঘোষণা দিয়েছেন, সেই জিয়াউর রহমানের নাম বাংলাদেশের মাটি থেকে মুছে ফেলার। যেটা কোনো দিনই সম্ভব হবে না। তার নাম বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে।

মির্জা ফখরুল বলেন, সমাধি বলুন, পদক বলুন, অন্য কিছু বলুন, তাদের হঠকারী এ সিদ্ধান্ত দেশের মানুষ মেনে নেবে না। জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম নামের একটি সংগঠনের ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।

এ ছাড়া এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, দেশে এখন চলছে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে গণতন্ত্রের দ্বন্দ্ব। ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রকে উচ্ছেদ করতে চায়। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। তাকে জনগণের চোখের সামনে থেকে নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্ত চলছে।

যদি সরকার জিয়াউর রহমানের সমাধি সরিয়েই নেয়, তাহলে কী করবেন-এমন প্রশ্নের জবাবে দুদু বলেন, একসময় তারা বাকশালও কায়েম করেছিল। সেটাও টেকেনি, মানুষ গ্রহণ করেনি। এখন যদি এটা হয়, সেটাও চিরস্থায়ী হবে তা ভাবার কারণ নেই।

সরকারি সূত্রগুলো জানায়, জাতীয় সংসদের মূল নকশা হাতে থাকায় এখন জিয়াউর রহমানের সমাধি সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেবে সরকার। কেননা, চলতি বছরের ৬ অক্টোবর গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন জাতীয় সংসদকে জানান, এই নকশা দেশে আনার পর জিয়াউর রহমানের সমাধি সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।

জানা গেছে, লুই আই কানের করা নকশার আলোকে ১৯৬১ সালে জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি এ ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে পাল্লা দিয়ে নকশাবহির্ভূত স্থাপনা নির্মাণ। সংসদ ভবনের উত্তরে ৭৪ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত চন্দ্রিমা উদ্যানের মাঝে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয় ‘জিয়াউর রহমানের মাজার কমপ্লেক্স’। সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের পশ্চিম পাশে পাঁচ বিঘারও বেশি জায়গায় ‘জাতীয় কবরস্থান’ নাম দিয়ে সাতজনকে সমাহিত করা হয়। জাতীয় সংসদের মূল ভবনের পাশে খোলা সবুজ চত্বরে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণ করা হয়েছে। চন্দ্রিমা উদ্যানের পাশে ১০ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। আর আসাদ গেটের উল্টোদিকে সংসদ ভবনের সীমানার মধ্যে স্থাপন করা হয় পেট্রল পাম্প। পরে এটি বন্ধ করে দেয়া হয়। সর্বশেষ সংসদ সচিবালয়ের গণপূর্ত বিভাগ ২০১৩ সালে সংসদ ভবনের উত্তর গেট বন্ধ করে সেখানে ‘সংসদ টেলিভিশনের স্টুডিও’ নির্মাণের কাজ শুরু করে। অবশ্য পরে তা স্থগিত রাখা হয়। জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশায় ওই কমপ্লেক্স এলাকায় কারো সমাধি বা বাসভবনের পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী নেতা খান এ সবুরকে কবর দেয়া হয় সংসদ ভবন এলাকাতেই।

অন্যদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংসদ সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, নকশা উপেক্ষা করে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার ভেতরে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বিষয়টি এরই মধ্যে আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। আর নতুন নিরাপত্তা বেষ্টনি ও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র বিশেষ প্রয়োজনেই করতে হয়েছে। তাই এগুলো উচ্ছেদের সম্ভাবনা নেই। তবে অন্যান্য স্থাপনা উচ্ছেদের পাশাপাশি নতুন বেশকিছু ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে।

ইতিমধ্যে জাতীয় সংসদ লাইব্রেরির জন্য চন্দ্রিমা উদ্যানের পাশে নতুন ভবন নির্মাণের কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন লাইব্রেরি কমিটির সভাপতি ও ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া। তিনি বলেন, লাইব্রেরির জন্য আরো বড় জায়গা প্রয়োজন। কিন্তু সংসদের মূল ভবনে সেটা সম্ভব নয়। আর নকশায় লাইব্রেরির জন্য আলাদা ভবনের কথা বলা আছে। তাই মূল নকশা দেখে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হবে। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হন। পরদিন তার মরদেহ চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৭ মাইল দূরে রাঙ্গুনিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পাশে পাহাড়ের ঢালুতে দাফন করা হয়। কিন্তু সে সময় সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টাকারী বিপথগামী সেনারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারেনি। এ ঘটনার পর ক্ষমতাসীন বিএনপির অবস্থান পুনরায় সুসংহত হওয়া মাত্রই জিয়াউর রহমানের দেহাবশেষ ১ জুন রাজধানী ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এরপর তাকে সমাহিত করা হয় চন্দ্রিমা উদ্যানে। আর সেখানে যেতে ক্রিসেন্ট লেকের ওপর স্থাপন করা হয় ‘বেইলি সেতু’।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘বেইলি সেতুটি’ খুলে নেয়া হয়। পরে ২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসার পর জিয়াউর রহমানের সমাধিকে ঘিরে নির্মাণ করা হয় ‘সমাধি কমপ্লেক্স’। পাশাপাশি সমাধির পূর্ব ও পশ্চিমে ক্যান্টিন, দক্ষিণে ঝুলন্ত সেতু, উত্তরে মেমোরিয়াল হল ও মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ২০০৪ সালে সমাধিতে যেতে ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ঝুলন্ত সেতুটি।

অতঃপর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদ ভবনের স্থপতি লুই আই কানের করা মূল নকশার বাইরে সব স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার কথা জানায়। সরকারের এই অবস্থানের কারণেই চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের সমাধি সেখানে থাকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে বাদানুবাদ কম হয়নি। যা এখন পর্যন্ত চলছে। এই যখন অবস্থা, তখন এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব সরকারের মন্ত্রিসভায় তোলা হয়। কিন্তু স্থপতি লুই আই কানের মূল নকশা না থাকায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মূল নকশাটি গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় আসে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!