• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন কিলিং মিশন নিয়ে সক্রিয় হচ্ছে জঙ্গিরা


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ১৮, ২০১৭, ০২:৪২ পিএম
নতুন কিলিং মিশন নিয়ে সক্রিয় হচ্ছে জঙ্গিরা

ঢাকা : হঠাৎ করেই দেশে আবারও জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে গেছে। আরো বেশি আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে জঙ্গিরা। তৎপরতায় ঢাল হিসেবে শিশু ও নারীদের ব্যবহারের কৌশল বেছে নিয়েছে। শক্তিশালী বোমা, গ্রেনেড, ককটেলের পাশাপাশি আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে আবারও বড় ধরনের নাশকতা ও রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সহিংসতায় নামার গোপন প্রস্ততির কথাও জানা যাচ্ছে।

খবর আসছে সংগঠনে দুর্ধর্ষ সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির। বিশেষ করে সম্প্রতি তাদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সর্বশেষ রাজধানীর আশকোনায় হাজি ক্যাম্পের কাছে নির্মাণাধীন র‌্যাব সদর দফতরে এক জঙ্গির আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় সে লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর আগে পরপর তিনটি হামলাও সে ইঙ্গিতই বহন করে। প্রতিটি হামলাই ছিল পুলিশের ওপর এবং ধরনও ছিল প্রায় একই রকম।

এর মধ্যে গত ৭ মার্চ কুমিল্লায় বাস থেকে নেমে দুই জঙ্গি পুলিশের ওপর বোমা হামলা শুরু করে। এর আগের দিন টঙ্গীতে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নিতে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালানো হয়। তার আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর গোদাগাড়িতে পুলিশ কনস্টেবলদের ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করে জঙ্গিরা।

এ নিয়ে উদ্বিগ্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশেষজ্ঞরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের দাবি, জঙ্গি দমনে যত না কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; তার চেয়ে বেশি হয়েছে দোষারোপের রাজনীতি। ফলে জঙ্গিরা নিজেদের সুসংগঠিত করার সুযোগ পেয়েছে। আর

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জঙ্গিরা নিজেদের নতুন কৌশল ও অস্তিত্ব জানান দিতেই তৎপর হয়েছে। বিশেষ করে আত্মঘাতী হামলাকে তারা এ যাবৎকালের সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ বলে মত দেন। উভয়পক্ষ জঙ্গি দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো সুসংহত ও প্রশিক্ষিত হওয়ার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়াতে ও জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন।

গতবছর জুলাই মাসে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও শোলাকিয়ায় ঈদের দিন জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযানের মধ্যে বেশ কিছুদিন পরিস্থিতি শান্ত ছিল। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও বলা হয়, জঙ্গিদের অনেকটাই দুর্বল করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সে ঘটনার পর গত নয় মাসে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও

সর্বশেষ চট্টগ্রামে র‌্যাব, পুলিশ ও সোয়াটের অন্তত ছয়টি অভিযানে ১৭ জঙ্গি নিহতের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সে তথ্যের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে গত বুধবার বিকেলে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে এক বাড়ি থেকে বিস্ফোরকসহ এক জঙ্গি দম্পতিকে গ্রেফতার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সময় আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ও গুলিতে এক নারীসহ চার জঙ্গি নিহত হয়। নিহত নারী জঙ্গির পাশে পরে এক শিশুর বোমায় বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।

হঠাৎ করেই জঙ্গিদের এমন তৎপরতায় আবারও সতর্ক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গতকাল ঢাকার আশকোনায় র‌্যাব ক্যাম্পে ‘আত্মঘাতী’ বিস্ফোরণের পর দেশের সব বিমানবন্দর ও কারাগারে সতর্কতা জারি করেছে কর্তৃপক্ষ। সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতার প্রেক্ষাপটে সারা দেশে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো সতর্ক ও তৎপর থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এমনিতেই গত রোববার শুরু হওয়া বিভিন্ন দেশের পুলিশ প্রধানদের সম্মেলনে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেররিজম রিসার্চের পরিচালক রোহান গুণারত্নের ‘গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা করেছিল আইএস, জেএমবি নয়’- এমন মন্তব্যে কয়েকদিন ধরেই বিতর্ক চলছে। ‘দেশে আইএসের তৎপরতা নেই’ বলে সরকার তার বক্তব্য পুনর্ব্যক্ত করেছে।

সে বিতর্ক শেষ হতে না হতেই আশকোনায় আইএসের আত্মঘাতী বোমা হামলার দায় স্বীকার করায় তাদের তৎপরতার বিষয়টি নতুন মোড় পায়। এর আগে অবশ্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বাড়াতে সম্ভাব্য একটি প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য চলছে মার্চ জুড়েই। এর অনেক আগে থেকেই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দেশে জঙ্গি দমনে সহযোগিতার কথা বলে আসছে।

কিন্তু হঠাৎ করেই এই জঙ্গি তৎপরতা কেন এ তৎপরতা বন্ধে করণীয়ই বা কি- জানতে কথা হয় দেশের তিন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। এর মধ্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, জঙ্গিরা সব সময়ই তৎপর। কৌশলগত কারণে মাঝখানে কিছুদিন স্তিমিত ছিল। এখন শক্তি অর্জন করে আবার নেমেছে।

তবে এবার তারা আরো বেশি আক্রমণাত্মক হয়েছে। বিশেষ করে আশকোনায় র‌্যাবের ক্যাম্পে আত্মঘাতী হামলা ছিল এ যাবৎকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ‘আত্মঘাতী আক্রমণ’। জঙ্গিবাদ আদর্শিক ব্যাপার। দমন করতে হলে আদর্শিক লড়াই দরকার।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি তৎপরতার বৈশ্বিক কারণ তো রয়েছেই; সেই সঙ্গে দেশের চলমান পরিস্থিতি- যেমন রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা এবং বৈষম্য দায়ী। জঙ্গিবাদ রুখতে হলে জাতীয় ঐকমত্য দরকার। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হবে না; জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

‘আইএস নিয়ে বিতর্ক করে লাভ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিদের যে ধরনের তৎপরতা লক্ষ করছি, তা কিন্তু আইএসের সঙ্গে সাযুজ্য ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। সুতরাং, আইএসের বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সব কৌশলকে সামনে রেখেই জঙ্গি দমনে কাজ করে যেতে হবে এবং এ ধরনের কর্মকা- চলমান রাখতে হবে’- বলে মন্তব্য করেন এই মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও জঙ্গি বিশেষজ্ঞ এম শাহীদুজ্জামান বলেন, জঙ্গিরা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায়। চায় তাদের মতাদর্শ প্রদর্শন করতে। সম্প্রতি যে তৎপরতা, সেগুলো এর প্রমাণ। কেননা নিশ্চয়ই এদের শক্তি প্রদর্শনের উৎস আছে। এরা সে সব উৎস থেকে অস্ত্র ও অর্থ পাচ্ছে। সেগুলো সরবরাহ রুট আছে। আমাদের সেসব উৎস ও রুট খুঁজে বের করতে হবে।

জঙ্গিদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে ও তা আদায় করতে চায়। সেখানে বাধাগ্রস্ত হলে তৎপরতা বাড়ায়। হয়তো আরো আগেই তৎপর হতো; কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে পারছিল না। তবে আইনশৃঙ্খলার যে ধরনের প্রস্তুতি, তা থেকে এক ধাপ বেশি এগিয়েছে জঙ্গিরা। বিশেষ করে আত্মঘাতী হামলা তাদের নতুন কৌশল ও সেটি জানান দিতেই তারা মাথাচাড়া দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বলেন, যখনই কোণঠাসা হয়ে পড়ে, তখনই জঙ্গিরা তৎপর হয়। তারা বোঝাতে চায় যে তাদের অস্তিত্ব রয়েছে। সাম্প্রতিক তৎপরতাও তার লক্ষণ। তবে সাম্প্রতিক যে জঙ্গি তৎপরতা, সেটি আইএসের ‘স্বতন্ত্র জিহাদ’ কৌশল।

‘মনে রাখতে হবে আইএস মধ্যপ্রাচ্যে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কোণঠাসা। এখন তারা চাইবে অন্যান্য দেশগুলোতে তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে। সুতরাং, ভবিষ্যতে জঙ্গি তৎপরতা আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে’- মন্তব্য করেন এই শিক্ষক। তিনি আরো বলেন, সামনে নির্বাচন। রাজনীতি অস্থিতিশীল। সেই সুযোগটাও নেবে জঙ্গিরা। তা ছাড়া বিদেশি ষড়যন্ত্র তো রয়েছেই।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!