• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
শব্দ ছবি আলো প্রযুক্তির সম্মিলন

নবরূপে ‌পুলিশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ২১, ২০১৭, ০২:৪২ পিএম
নবরূপে ‌পুলিশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

আলোচনা-সমালোচনায় পুলিশের খারাপ দিকগুলোই বেশি মুখরোচক হয়ে ওঠে। দু-একজনের অপকর্মে পুরো বাহিনীকে সমালোচনায় বিদ্ধ করি আমরা। কিন্তু এই পুলিশই একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম অস্ত্র ধরেছিল। ২৫ মার্চ রাতেই সেই সম্মুখযুদ্ধে অনেক পুলিশ সদস্যই প্রাণ বিসর্জন দেন, শুধু দেশমাতৃকার জন্য।

স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছিল ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন। প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধও শুরু হয় এই রাজারবাগ থেকেই। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ সদস্যদের ওই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’।

রাজারবাগে পুরনো ভবনের সেই জাদুঘরটি এখন পাশেই স্থায়ী স্থাপনায় নতুনভাবে যাত্রা শুরু করছে আগামী ২৩ জানুয়ারি থেকে। এদিন পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে রাজারবাগে আসবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার হাতেই নবরূপে ও নতুন আঙ্গিকে রূপ পাবে পুলিশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটি। উদ্বোধনকে সামনে রেখে দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি নতুন ভবনের কাজও শেষ। অপেক্ষা শুধু উদ্বোধনের।

নতুন ভবনের মূল জাদুঘরটি হচ্ছে বেজমেন্টে। দুইতলা জাদুঘরটি মূলত মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ পুলিশের ভূমিকাসংবলিত স্মৃতিচিহ্নগুলোকেই ধারণ করছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজরিত বিভিন্ন প্রদর্শনী থাকছে। জাদুঘরটির মোট আয়তন ২০ হাজার বর্গফুট।

মুক্তিযুদ্ধের তিন হাজারেরও বেশি স্মারক প্রদর্শিত হবে জাদুঘরে। ভবনের মূল প্রবেশপথ দক্ষিণমুখী। স্মৃতিস্তম্ভের ওপরে চারদিকে ৩২টি ফলকে সারি সারিভাবে সাজানো মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৭৫১ জন পুলিশের নামের তালিকা। আছে বঙ্গবন্ধু গ্যালারি।

গতানুগতিকতার বাইরে শব্দ, ছবি আর আলোকের চমৎকার সংমিশ্রণে সাজানো গ্যালারিটি। যা দর্শনার্থীদের ভিন্ন অনুভূতি দেবে। কিছু মুহূর্তের জন্য দর্শনার্থী পৌঁছে যাবেন মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ে। বেজমেন্টে আছে অডিও-ভিজুয়াল গ্যালারি।

আর ভার্চুয়াল লাইব্রেরিতে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও বাঙালি জাতির পাঁচ শ বছরের পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্য-সম্পর্কিত বইও সংরক্ষিত। আছে একটি স্যুভিনিওর শপ। সেখানে মিলবে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত ভিউকার্ড, পোস্টার, মগ, টি-শার্ট ছাড়াও থাকবে নানা স্মৃতিচিহ্ন কেনার সুযোগ। জাদুঘরের মূল অংশ বেজমেন্টে শতাধিক মানুষের একসঙ্গে বসার ব্যবস্থা থাকবে।

বাংলাদেশ পুলিশের তত্ত্বাবধানে জাদুঘরটির আর্কিটেকচারাল ডিজাইন করেছে ‘দ্য ইউনিয়ন কনসট্রাকশন লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠন। এর কর্ণধার ও স্থপতি মীর আল আমীন বলেন, সাহিত্য যেমন একটি নির্দিষ্ট সময়কে ধারণ করে, তেমনিভাবে একজন স্থপতিও তার সময়কে ধারণ করেন তার স্থাপত্যশৈলীর মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ আর বর্তমান সময়কে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, নতুন ভবনটিতে।

দৃষ্টি ছিল জাদুঘর যেন মূল স্মৃতিস্তম্ভকে ছাড়িয়ে না যায়। নকশায় ফুটে উঠেছে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের স্মৃতিসংবলিত মনুমেন্টটিকেই যেন জাদুঘরটি শ্রদ্ধা করছে। সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব ও আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধাসংবলিত পুরো ভবনটিকে ‘গ্রিন বিল্ডিং’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে সোলার প্যানেল ও ওয়াটার রিসাইকেলের ব্যবস্থা আছে।

জাদুঘরে স্থান পেয়েছে একটি পাগলা ঘণ্টা, যেটি বাজিয়ে সেই রাতে পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করছিলেন কনস্টেবল আবদুল আলী। এছাড়া আরো রয়েছে পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা ও ইউনিফর্ম। দেয়ালজুড়ে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের যুদ্ধের সময়ের ডায়েরি, হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা, বিভিন্ন ধরনের আলোকচিত্র এবং পোস্টার।

মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আলোচনায় এই বিষয়টি খুব বেশি আলোচিত হয় না। তাই বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা তুলে ধরার। তারই অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই জাদুঘরটি।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ উদ্বোধন করা হয় বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের। স্বল্প পরিসরে সেখানে অল্প কিছু স্মৃতিস্মারক দিয়ে তা সাজানো হয়েছিল। তৎকালীন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জাদুঘরটি সবার জন্য উন্মুক্ত। এর পরিদর্শন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ টাকা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একযোগে আক্রমণ চালিয়েছিল ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে রাজারবাগেই বাঙালি পুলিশ সদস্যদের দ্বারা পাকিস্তানি সেনারা প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। একই সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে ঢাকা আক্রান্ত হওয়ার বার্তা সারা দেশের থানাগুলোতে প্রেরণ করেন। জানিয়ে দেওয়া হয়, তারা পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। পুলিশের এই প্রতিরোধযুদ্ধের কথা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হন।

রাজারবাগ আক্রান্ত হওয়ার পরপরই ওয়্যারলেস বা বেতারযন্ত্রের অপারেটর মো. শাহজাহান মিয়া জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ উদ্যোগে ইংরেজিতে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের বার্তাটি দেশের সব থানায় পাঠিয়ে দেন। ২৫ মার্চ তিনি তার বার্তায় বলেন, ‘বেইজ ফর অল স্টেশন্?স অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিসেন অ্যান্ড ওয়াচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেল্ভস, ওভার।’ রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি বেতারযন্ত্রটির মাধ্যমে সারা দেশে এই বার্তা প্রচার করেন। এই জাদুঘরে সেই বেতারযন্ত্রটি স্থান পেয়েছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ১২ শতাধিক পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু এ পর্যন্ত ৭৫১ জনের নামের তালিকা করা সম্ভব হয়েছে। বাকি প্রায় পাঁচ শ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যের বিষয়ে খোঁজ মেলেনি আজও। তবে সেসব বীর পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হচ্ছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!