• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
একজন জীবন জয়ী নারী নরসুন্দরের গল্প

নারী নরসুন্দর...


মো. আমিনুল ইসলাম, ঝালকাঠি জানুয়ারি ১৯, ২০১৮, ১০:৩০ এএম
নারী নরসুন্দর...

ঝালকাঠি: বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। সব ক্ষেত্রেই নারীদের অবদান রয়েছে। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ আসন থেকে রান্না ঘর পর্যন্ত একজন নারীর বিচরণ।

সবকাজে নারীদের অংশগ্রহণ সমানভাবে থাকলেও নর সুন্দরের (নাপিত) কাজে সাধারণত নারীদের দেখা যায় না। জেলার কাঠালিয়া উপজেলার শৌলজালিয়া ইউনিয়নের বলতলা বাজারে দেখা গেল এক নারী নরসুন্দরের কাজ করছে।

কৌতূহল নিয়ে তার সাথে কথা বলা ও সার্বিক খোঁজ খবর নেয়ার সময় তিনি জানান, পশ্চিম ছিটকী গ্রামের দরিদ্র যাদব শীলের চতুর্থ সন্তান শেফালী শীল। দারিদ্রতার কারণে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তই লেখাপড়ার সৌভাগ্য হয় তার। নিজের ইচ্ছা না থাকলেও পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে আতর আলী গ্রামের বিশ্বনাথ শীলের সাথে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। শুরু হয় দারিদ্রতা আর মানিয়ে নেয়ার জন্য জীবনের সাথে যুদ্ধ। জীবনকে বুঝে উঠার আগেই ৪ মেয়ে ও ১ ছেলের মা হন তিনি।

একদিকে স্বামীর অবহেলা ও বেপরোয়া উদাসী জীবনযাপনের কারণে তার জীবন বিষন্নময় হয়ে ওঠে। এরপর তিনি প্রথমে তার বাবার বাড়িতে থাকা শুরু করে এবং এক সময় বাবার বাড়ি থেকে বলতলা গ্রামের দোগনা বাজারে চলে আসে।

বলতলা গ্রামের দোগনা বাজারে আসার পরও স্বামী কাজ করতো। কিন্তু পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ২০১২ সালে স্বামী প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অভাবের কারণে ভালো চিকিৎসা করাতে না পারায় একসময় তার স্বামী মানসিক বিকারস্ত হয়ে যায়। এ অবস্থার কিছুদিনের মধ্যে তার স্বামী কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

এরপর থেকেই পাঁচ সদস্যের পরিবারের দায়িত্বভার পুরোটাই শেফালিকে নিতে হয়। পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দেয়ার জন্য প্রথমে তিনি অন্যের বাড়ি কাজ করলেও সংসার যখন চলছিল না তখন ছেলেবেলায় বাবার বাড়ি থেকে চুল কাটার পেশা বেছে নেয়। যখন তিনি গ্রামের বাজারে চুল কাটতে শুরু করেন তখন গ্রামের কিছু লোক তার পেশাকে ভালো চোখে দেখিনি। গ্রামে বাজারের মধ্যে মেয়ে মানুষ পুরুষ লোকের চুল কাটছে দেখে অসহযোগিতা ও হাসি-ঠাট্টা করতো। অনেকে সমালোচনাও করতো। আবার গ্রামের কিছু লোক শেফালির অভাব দেখে সহযোগিতাও করছে।

এ সময় গ্রামের লোকজন টাকা তুলে চুল কাটার জন্য তাকে একটি চেয়ারও কিনে দিয়েছিল। কিন্তু এর পরেও সম্পদহীন জীবনে তিনি কোনো স্বপ্ন দেখতে পারছিলেন না। জীবনের পথচলা যখন তার কাছে দুর্বিসহ, স্বপ্নগুলি যখন মরীচিকার মতো ঠিক তখনই ২০১৬ সালে ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া ব্র্যাক অফিসের টিইউপি কর্মসূচির আওতায় জরিপ এর মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে তিনি সদস্য নির্বাচিত হন এবং তার মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে গবাদী প্রাণিপালন এন্টারপ্রাইজের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে একটি বকনা গরু ও একটি ছাগল প্রদান করা হয়।

এর পর পর্যায়ক্রমে সহায়ক ভাতা, হোম ভিজিটের মাধ্যমে ইস্যু শিক্ষা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শেখানো হয়। এরপর থেকে তিনি একটু একটু করে জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।

শেফালির বাড়িতে এখন একটি গাভী আছে যার আনুমানিক মূল্য ৪০ হাজার টাকা, তার ৩টি ছাগল ও ৩০টি হাঁস/মুরগি আছে। তার বড় মেয়েটি বি. এ (পাস কোর্স), ছেলেটি এইচএসসি আর বাকি ৩টি মেয়ে যথাক্রমে অষ্টম, সপ্তম ও প্রথম শ্রেণিতে পড়াশোনা করেছে।

তিনি আগে অন্যের ঘরে থাকতেন। এখন ব্র্যাক কর্মীদের অনুরোধে বলতলা জিডিবিসি কমিটি দোগনা বাজারের পাশে তিনকাঠা খাস জমিতে শেফালিকে একটি ঘর তুলে দিয়েছে। শেফালি এখন সামাজিক ও মানসিকভাবে অনেক সচেতন। তিনি তার ছেলে-মেয়েকে বাল্য বিয়ে দিবে না বলে নিজে নিজে অঙ্গীকার করেছে।

তিনি তার মেয়েকে বিএ পাশ করার পর চাকরি করানোর স্বপ্ন দেখছেন। ব্র্যাক কর্মীরা তার সেলুনের বেশ কিছু প্রয়োজনীয় মালামাল কিনে দিয়েছে।

তিনি এখন গরু-ছাগল, হাঁস, মুরগি-লালন-পালনের পাশাপাশি দোকানে চুল কেটে উপার্জিত অর্থ দিয়ে দিয়ে সংসার এবং সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালান। শেফালি বর্তমানে একজন জীবন যুদ্ধে হার না মানা একজন নারী।

পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক কণ্ঠস্বর। নারী হয়েও ব্যতিক্রমী পেশা গ্রহণ করে জীবনযুদ্ধে হার না মেনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি।

কাঠালিয়ার শৌলজালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদ হোসেন রিপন জানান, শেফালী আমাদের সমাজের অনুকরণীয় নারী জাগরণের দৃষ্টান্ত। লজ্জা এবং সমাজের ঠাট্টা উপেক্ষা করে তিনি এখন নারী সমাজের গর্ব। আমি তার মঙ্গল কামনা করছি।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!