• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিষ্ঠুরতার শিকার শিশুরা, বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৭, ০৬:৫০ পিএম
নিষ্ঠুরতার শিকার শিশুরা, বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা

ঢাকা: শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা যেন থামছেই না। দিন দিন তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত আক্রোশ-প্রতিহিংসা, পারিবারিক কলহের জের কিংবা পরকীয়ার বলি হচ্ছে ঘরের নিষ্পাপ শিশুটি। এ নিযে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েই চলছে। শিশুদের প্রতি এ নির্মম আচরণকে মানবিক গুণাবলিসমৃদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

শিশুর প্রতি নির্মমতা যে কত ভয়ংকর হতে পারে, তার আরেকটি দৃষ্টান্ত তৈরি হলো গত রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) চাঁপাইনবাবগঞ্জে। গলায় থাকা সামান্য স্বর্ণের চেইন হাতিয়ে নিতে এক প্রতিবেশী নারী দুই অবুঝ শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করল। শিশুদের মেরে নিজের ঘরেই বস্তাবন্দি করে লুকিয়ে রেখেছিল খুনি। এ যেন মানবিকতার চরম বিপর্যয়। বিকৃত মস্তিষ্কের চূড়ান্ত পরিণতি।

নরপশু শব্দের সঙ্গে কমবেশি সকলেই পরিচিত। স্বচক্ষে দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি এত দিন। কিন্তু ইদানিং আমাদের সমাজে এ রকম নরপশুর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বেড়েই চলছে শিশু হত্যা। তুচ্ছ সব কারণে বলি হতে হচ্ছে শিশুদের। বিশেষ করে বড়দের স্বার্থের বলি হচ্ছে শিশুরা। দিন দিন বাড়ছে শিশু হত্যা, ধর্ষণের মতো ঘটনার পরিসংখ্যান। নিজের মা-বাবার কোলও শিশুদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে।

সম্প্রতি কয়েকটি শিশু হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পারিবারিক কলহ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, ব্যক্তিগত লোভ-লালসা চরিতার্থ কিংবা স্বার্থ আদায় করার জন্য টার্গেট করা হচ্ছে শিশুদের। বাড়ছে ধর্ষণ ও অপহরণের ঘটনাও। কখনো চোর সন্দেহে শিশুকে পিটিয়ে হত্যা আবার পরকীয়া আড়াল করতে আপন সন্তানকে খুন করতে পিছপা হয়নি বাবা-মা। বিখ্যাত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। তার সেই আহ্বানের সাত দশক পর আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উন্নতির এ কালেও শিশুর প্রতি এ কেমন নৃশংসতা দেখছি!

দেশে শিশু নির্যাতন, নির্যাতন করে শিশু হত্যা, ধর্ষণ কিংবা শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ নতুন কোনো ঘটনা নয়। আর ঘরে-বাইরে, কল-কারখানায়, গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশু-কিশোরদের নির্যাতন তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কিছু ঘটনা মিডিয়ার কল্যাণে জনসমক্ষে আসে। তবে বেশির ভাগ ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়।

এক ধরনের বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ অন্যের অসহায়ত্বের সুযোগে শিশু নির্যাতন করে এক ধরনের ‘পাশবিক’ সুখ পেয়ে থাকে। এদের মানবিক মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক চেতনা বলতে কিছু নেই। এদের নিষ্ঠুরতা কখনো কখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, আমাদের বিস্মিত হওয়ার সীমাকেও ছাড়িয়ে যায়। রাজনের প্রতি নিষ্ঠুরতা তেমনই এক ঘটনা। স্কুলছাত্র রাজন পরিবারকে সহায়তা করতে কাজ করতে গিয়েছিল। সে কারো সঙ্গে অসদাচরণ করেনি, বাকবিতন্ডায়ও জড়িত হয়নি।

অথচ তাকে কিছু মানুষের চরম পৈশাচিকতার শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হলো। আমরা প্রায় সময়ই দেখি গ্রামে-গঞ্জে-শহরে চোর, ডাকাত, পকেটমার সন্দেহে কাউকে ধরে পিটিয়ে মারার ঘটনা। গণসহিংসতার এসব ঘটনায় কোনো অপরাধী শনাক্ত হয় না, কেউ শাস্তিও পায় না। আর এ কারণেই এই সমাজে শিশু হত্যা ও নির্যাতনের ভয়াবহ দৃষ্টান্ত তৈরি হচ্ছে বারবার।

সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতাই শিশুদের ওপর নৃশংস আচরণের জন্য দায়ী। সমাজে অস্থিরতা বিরাজমান থাকলে মানুষের মনে তার প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি এক ধরনের মানসিক রোগ। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার’ বলে। সমাজে অস্থিরতা বিরাজ থাকলে সচ্ছল মানুষের মধ্যেও এ ধরনের রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

সাম্প্রতিককালে শিশুর প্রতি নৃশংসতার মাত্রা ছাড়িয়েছে। আর শিশু ধর্ষণের চিত্র তো আরো ভয়াবহ এ দেশে। বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গেল বছর পাঁচ শতাধিক শিশু নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ সময়ে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে ১৪৪ শিশু। আর চলতি বছরের মাত্র দেড় মাসে ১৪ শিশু নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে ৬ শিশু। আর গত চার বছরে দেশে ১ হাজার ৮৫ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।

শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ২০১৫ সালের চেয়ে ২০১৬-তে ধর্ষণ বেড়েছে ১৬ শতাংশ। এ সময় ১১৯ শিশুকে গণধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয় ৩৫ শিশুকে। ২০১৫ সালে ৯৯ শিশু দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় এবং ৩০ শিশুকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। কারণ বেশির ভাগ ঘটনাই প্রকাশ্যে আসে না।

গত ১২ ফেব্রয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফতেপুরে সুমাইয়া খাতুন মেঘলা ও মেহজাবিন আক্তার মালিহা নামে দুই শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে প্রতিবেশী লাকি খাতুন। শিশুদের গলায় স্বর্ণের চেইন ও কানের দুল ছিল। শিশুদের কাছে থাকা ওই স্বর্ণালঙ্কারের লোভেই দুই শিশুকে হত্যা করে প্রতিবেশী লাকি খাতুন। খুন করে শিশুদের লাশ বস্তাবন্দি করে নিজ ঘরের খাটের নিচেই লুকিয়ে রাখে লাকি।

পরে দুদিন পর লাশ দুটি উদ্ধার করে পুলিশ। খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে লাকি। স্বীকারোক্তিতে দুই শিশুকে হত্যার নির্মম বর্ণনা দেয় লাকি।

এদিকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় তামিম (৭) নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নানাবাড়ি বেড়াতে নিখোঁজ হয় শিশুটি। কিন্তু এ শিশু হত্যাও রহস্যেই থেকে গেছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর পুঠিয়ায় মোবাইল ফোনের মেমোরি কার্ড চুরির অভিযোগে আরিফুল ইসলাম (১২) নামে এক শিশুকে গাছের সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক মারপিট করা হয়।

এর আগে গত ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা থেকে আলিফ (৬) নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। তবে এ ঘটনার কোনো রহস্য জানাতে পারেনি পুলিশ। গত ৯ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে গলায় রশি বাঁধা অবস্থায় এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। মায়ের অভিযোগ, শিশুটির বাবা তাকে হত্যা করেছে। কিন্তু এ ঘটনারও প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, মূলত চারটি কারণে বর্তমান সমাজে এ ধরনের অধপতন। ভোগবাদী মানসিকতা ও এর কাঠামো গড়ে ওঠায় সমাজে উচু-নিচু শ্রেণির বৈষম্য তৈরি হয়েছে। এর ফলে নারী ও শিশুদের ওপর বেশি নির্যাতন বাড়ছে। এ ছাড়া সমাজ কাঠামোয় এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। ফেসবুক ও ইন্টারনেটের ব্যবহার, বিদেশি চ্যানেলের অপসংস্কৃতি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে বিকৃত সামাজিক আগ্রাসনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

আধুনিকায়নের নামে চলছে অস্থিরতা। নারী ও শিশু খুনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন ও মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলছেন, মানবিক গুণাবলিসমৃদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার অভাবের কারণেই মূলত এসব ঘটনাগুলো ঘটছে। এতে করে সামাজিক অবক্ষয়ও সৃষ্টি হচ্ছে। এ সব ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনায় জড়িত মূল অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হলে এ ধরনের ঘটনা কমে যেত। বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, মেয়েশিশু নির্যাতন ও সহিংসতার বিচার চেয়ে বিভিন্ন সময় সভা-বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে, আর তাতেই প্রমাণ হয়, অপরাধীদের বিচার হচ্ছে না। শিশুদের ওপর নৃশংসতার ১০০ অপরাধে গড়ে দুটির বেশি শাস্তি হয় না। আমার জানামতে, গত ৫ বছরে শিশু হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ কিংবা দলবদ্ধ ধর্ষণের ৯৮ শতাংশ অপরাধে কারো শাস্তি হয়নি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম খান বলেন, সমাজে এমন বর্বর ঘটনা প্রতিরোধে সামাজিক ও পারিবারিক আন্দোলন আরো জোরালো করতে হবে।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় চেয়ারম্যান তানিয়া হক জানান, ছেলেমেয়ে উভয় শিশুই শিকার হচ্ছে এই বিকৃত মানসিকতার, যৌন লালসার।

ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, আইন করে শাস্তি দিয়ে অপরাধীকে হয়তো আটকানো যায়, তার মানসিকতাকে নয়। আইন দিয়ে হয়তো অপরাধী শাস্তি পাবে, কিন্তু অপরাধীর মন, তার কী সংশোধন হবে? এজন্য পারিবারিক শিক্ষা জরুরি, নারী ও শিশুর প্রতি শ্রদ্ধা, স্নেহ ও সম্মানবোধ আবশ্যক।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!