• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পতিসরে রবীন্দ্রস্মৃতি: কবি-কবিপুত্র ও পুত্রবধূর চিঠি


এম মতিউর রহমান মামুন মে ৭, ২০১৭, ০৯:১৫ পিএম
পতিসরে রবীন্দ্রস্মৃতি: কবি-কবিপুত্র ও পুত্রবধূর চিঠি

ঢাকা: ইতিহাস ঐতিহ্যের বিচারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজস্ব জমিদারীর অংশ পতিসরের সদর কাচারী বাড়ি যেমন প্রত্নসম্পদ তেমনি এখানে উদ্ধার হওয়া অনেক রবীন্দ্রস্মৃতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আনন্দ ও গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি আমার উদ্ধার করা কবির হাতের লেখা চিঠি, কৃষি ব্যাংকের হিসাবের খাতা, টি-পট, জমিদারির লোহার সিন্দুক, নাগর বোটের দরাজা-জানালা, আরাম-কেদারাসহ আরো নতুন কিছু রবীন্দ্রস্মৃতি সংযোজনে রবীন্দ্র মিউজিয়ামকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। এইসব স্মৃতিচিহ্ন রবীন্দ্রগবেষকদের যেমন নতুন ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করবে, তেমনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসব স্মৃতিচিহ্ন আমাদের আনন্দ আর গর্বকে বাড়িয়ে দেবে।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিবেচনায় বিশ্বকবির প্রতিষ্ঠিত ‘কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশান’ এর গুরুত্ব কোনোভাবেই কম নয়। তৎকালীন নির্মিত মাটির ঘর, কবির দেয়া আর্শীবাণী, প্রজাদের উদ্দেশ্য দেয়া শেষ অভিভাষণ, কালীগ্রাম পরগণার শেষ জমিদার কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর চিঠির আবেদন তো আরো অনেক বেশি।

১৯৩৭ সালের ২৬ জুলাই ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে দেয়া কবির অবিনাশী বাণী আজ দেশের প্রচলিত শিক্ষা আইন প্রণয়নে দিক নির্দেশক হতে পারে। প্রজাদের উদ্দেশ্যে দেয়া সেদিনের ভাষণ, পতিসর তথা বংলাদেশে দেয়া কবির শেষ ভাষণ ছিল। এসব যেমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ তেমনি, রবীন্দ্র পরবর্তী কালিগ্রাম পরগণার শেষ জমিদার কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রাতিমা দেবীর চিঠিগুলোও রবীন্দ্র জমিদারীর ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল।

ইতিহাসবিদরা এসব নিয়ে না ভাবলেও, সুধী গবেষকদের কলমে কালি না ঝরলেও আর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এসব স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করুক আর না করুক- সেসব আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসে অনেক গুরুত্ব বহন করে। বলা প্রয়োজন যে, ‘কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশান’ এর অরক্ষিত বিপুল রবীন্দ্রস্মৃতি সংরক্ষণে সরকারের পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের অনেক দায় রয়েছে।

আমরা মনে করি, উদ্ধার করা বরীন্দ্রস্মৃতি ‘কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশান’-এ সংরক্ষণের জন্য একটি প্রথাসিদ্ধ সংগ্রহশালা করতে পারলে তা শান্তিনিকেতনের মতোই আবেদন সৃষ্টি করতে পারে। সেই বোধ থেকেই ২০১৩ সালের ৮ মে বিশ্বকবির জন্মবার্ষিকীতে কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনে একটি রবীন্দ্র সংগ্রহশালা তৈরি করে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্মৃতি সংরক্ষণ করেছি।

ইত্তেফাকসহ (রবীন্দ্রনাথের পতিসর) বেশ কিছু পত্র-পত্রিকায় এ সংক্রান্ত কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক, অনুরাগী, অনুসারীদের উজ্জিবীত মনে হয়েছে। রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের গবেষকগণ রবীন্দ্রস্মৃতি উদ্ধারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পাশপাশি তারা পরামর্শও দিয়েছেন ‘কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশান’ কে পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্র সংগ্রহশালা করে তা আরকাইভের আওতায় নেয়ার জন্য। আবার হতাশা প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথের ফেলে যাওয়া জায়গা জমি অবৈধ্য দখলদারিত্ব নিয়ে। জানতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরো কোনো নিদর্শন কোথায়, কীভাবে আছে, সেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব কিনা? গভীর আগ্রহ দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর চিঠিগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে সংরক্ষণের জন্য।

বেশ কিছুদিন আগে পতিসর ঘুরে গেলেন কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. জোসেফ টি ও কলিন, প্রফেসর ড. ক্যাথলিন এম ও কলিন, জার্মানের কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র গবেষক প্রফেসর ড. গোলাম আবু জাকারিয়া, প্রফেসর ড. এল কে জাকারিয়া, প্রফেসর ড. এফ লিংক, গোমার্চবাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. সুজিত কুমার চৌধুরী। গবেষকরা পতিসরে রবীন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিষয় উল্লেখ করেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বকবির ফেলে যাওয়া বিষয় সম্পত্তি দিয়ে ‘রবীন্দ্র কল্যাণ ট্রাস্টিবোর্ড’ গঠন করার।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন ছিল সংসার থেকে বিদায় নেয়ার আগে প্রিয় পরগনার প্রিয় প্রজাদের শেষবারের মত দেখে যাবেন। কবির সে স্বপ্ন পুরণ হয়েছিল। ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই নদীপথে পতিসরে এসেছিলেন। সেদিন অসুস্থ কবি খেটে খাওয়া হাজার হাজার প্রজাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। অসুস্থ কবির অশ্রুসিক্ত ভাষণের অংশবিশেষে যা লেখা ছিল তা হচ্ছে-

রবীন্দ্রনাথের চিঠি

‘সংসার থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্বে তোমাদেরকে দেখার ইচ্ছা ছিল; তা আজ পূর্ণ হল। তোমরা এগিয়ে চল জনসাধারণের জন্যে। সবার আগে চাই শিক্ষা, এডুকেশন ফাস্ট। সবাইকে শিক্ষা দিয়ে বাঁচাও। ইচ্ছা ছিল মান-সম্মান-সম্ভ্রম সব ছেড়ে দিয়ে তোমাদের সঙ্গে তোমাদের মতোই সহজ হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেব। কী করে বাঁচতে হবে তোমাদের সঙ্গে মিলে সেই সাধনা করব। কিন্তু আমার আর এ বয়সে তা হবার নয়। এই নিয়ে দুঃখ করে কী করব? আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তোমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখ। আমি তোমাদেরকে বড় ভালোবাসি, তোমাদের দেখলে আমার আনন্দ হয়, তোমাদের কাছে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। কিন্তু কিছুই তোমাদের দিতে পারিনি- আশির্বাদ করি, তোমরা সুখি হও। তোমাদের সবার উন্নতি হোক- এ কামনা নিয়ে পরলোকে চলে যাব।’

ওই দিনই প্রিয়পুত্রের নামে স্থাপিত বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষদের উদ্দেশ্যে কবিগুরু লিখেছিলেন-

‘রথীন্দ্রনাথের নাম চিহ্নিত কালীগ্রামের এই বিদ্যালয়ের আমি উন্নতি কামনা করি। এখানে ছাত্র এবং শিক্ষকদের সম্মন্ধ যেন অকৃত্রিম স্নেহের এবং ধৈর্যের দ্বারা সত্য ও মধুর হয়- এই আমার উপদেশ। শিক্ষাদান উপলক্ষে ছাত্রদিগকে শাসন পীড়নে অপমানিত করা অক্ষম ও কাপুরুষের কর্ম- এ কথা সর্বদা মনে রাখা উচিৎ। এরূপ শিক্ষাদান প্রণালী শিক্ষকদের পক্ষে আত্মসম্মান হানিজনক। সাধারণত আমাদের দেশে অল্প বয়স্ক বালকগণ প্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষকদের নির্মম শাসনের উপলক্ষ হইয়া থাকে- এ কথা আমার জানা আছে। সেই কারণেই শতর্ক করিয়া দিলাম।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স যখন ৭৬, মৃত্যুর ঠিক চার বছর আগে পতিসর থেকে শেষ বিদায় নিয়েছিলেন। সেদিন প্রজাদের  উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে কবি কেঁদেওছিলেন। কেঁদেছিলেন হাজার হাজার প্রজা। ‘আমাদের ছোট নদী’ খ্যাত সেই নাগর বয়ে নিয়ে গেল অশ্রসিক্ত তার প্রিয় যাত্রীকে। এরপর কবির আর কখনও পতিসর তথা বাংলদেশে আসা হয়ে উঠেনি।

কবির মৃত্যুর পর কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের ওপর জমিদারি দেখভালের দায়িত্ব অর্পিত হয়। ১৯৪৫-এ ঠিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন কবিপুত্র সস্ত্রীক পতিসরে আসেন। পিতার প্রিয় জমিদারী ও খেটে খাওয়া সাধারণ গরীব প্রজাদের শেষ বারের মত দেখা, নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত ‘রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিশন’ এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে রথীন্দ্রনাথ উতলা ছিলেন। জমিদারী প্রথা যে বিলুপ্ত হবে তা সময়ের ব্যাপার ছিল। তা হয়তো কবিপুত্র উপলব্ধী করেছিলেন।

পঞ্চাশের দশকে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত কবিপুত্র সশরীরে পতিসরে না আসতে পারলেও জমিদারী ও কৃষি ব্যাংকের হিসাব নিকাশ, অডিট রিপোর্ট নিতে গুরুত্বপূর্ণ অনেক চিঠি লিখেছেন বীরেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারীকে। জমিদারী বিলুপ্তির আগ মুহূর্তে তিন বছরের বার্ষিক হিসাব নিকাশের প্রতিবেদন কবিপুত্রের হাতে এলে তাতে যে বড় রকমের গোলযোগ আছে তা বুঝতে পেরে সংশোধন করতে বিশ্বস্ত ম্যানেজার বীরেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারীকে চিঠি লিখেন। চিঠিটি হুবহু তুলে ধরলাম-

কল্যাণীয়েষু,
তোমার চিঠি ও সেই সঙ্গে তিন বছরের বার্ষিক ষ্টেটমেন্ট যা অন্নদা তোমাকে দিয়েছে তা পেলুম। এর থেকে কিছু বোঝা যায় না। তবে দুটো বিষয় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তোমাকে জানাচ্ছি। ১৩৫৯ পর্যন্ত সাপোস এ/সি কিছু ছিল না। কিন্তু ১৩৬০ সালে সাসপেন্সে ৬,৬১৫/= জমার দিকে দেখান আছে তার মধ্যে ২৭,৬৫ টাকা মাত্র ক্লিয়ার করা হয়েছে। এত টাকা কেন সাসপেন্সে পড়ে থাকবে বুঝলুম না। কিন্তু এর চেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে ইনকাম ট্যাক্স এর হিসাব আমি এই বিষয়েই বেশি আশঙ্কিত ছিলুম। অন্নদার কাছ থেকে তুমি যে ষ্টেটমেন্ট গুলি পাঠিয়েছ তার সঙ্গে দু এক মাস পূর্বে অন্নদা ডিটেলস, আমাকে ইনকাম ট্যাক্স এর যা হিসাব পাঠিয়েছিলে তার কোন মিল নেই। আমি ওকে খুব তাগিত দিয়ে গত পাঁচ বছরের ইনকাম ট্যাক্স পেমেন্ট এর একটি হিসাব আদায় করেছিলুম। এই দুটি ষ্টেটমেন্ট আনুযায়ী আমি একটি কম্পারেটিভ ষ্টেটমেন্ট প্রস্তুত করে তোমার কাছে পাঠিয়েছি। মনে রেখো ১৩৫৮ সালের পূর্বে  ইনকাম ট্যাক্স যা দেয় তা সম্পূর্ণ শোধ করা হয়েছে। পূর্বেকার দরুন ১৩৫৮ সালে কোন টাকা ডিউ ছিল না।

আমার ষ্টেটমেন্ট দেখলে বুঝতে পারবে অনুদা আমাকে জানিয়েছিল এই তিন বছরে মাত্র ৫৯৮৮০৯ সর্ব সমেত ট্যাক্স দেওয়া হয়েছে তারপর ১৩৬১ সালে সৌরীন ১৯০০০- দিয়েছে ( এটা অন্নদার হিসেবে দেখান নেই অন্নদা হিসাব পায়নি) তাহলে হাল নাগাদ ৭৮৮৮০/= দেওয়া হয়েছে। কিন্ত তোমাকে আন্নদা যে ষ্টেটমেন্ট দিয়েছে তাতে দেখেছি সৌরীনের দেওয়া ১৯০০০/= ধরলে সর্বসমেত ১,২১,৩৩৪/= পেমেন্ট হয়েছে। এই অসামঞ্জস্য কি করে হয়? ৪২,০০০/= টাকার উপর ডিজওভার পেমেন্ট  আর একটা বিষয় লক্ষ করা আছে- ইনকাম ট্যাক্স বিভাগ ১৩৫৮ থেকে ১৩৬১ পর্যন্ত ৪ বছরে টোটাল এমাউন্ট করল ১,০৬,৬৪৭/= অথচ পেমেন্ট করা হল ১২১,৩০৪/= এবং এখনো শুনছি অনেক বাকি আছে দিতে। এরও রহস্য বুঝলুম না। সমস্ত হিসাব পরীক্ষা করতে সময় লাগবে। কিস্তু ইনকাম ট্যাক্স পেমেন্ট সমন্ধে এমন একটা গোলমাল দেখছি এ বিষয়ে অনুসন্ধান ফেলে রাখা যায় না। পরীক্ষা করতে ২/১ দিনের বেশি সময় লাগতে পারে না। তুমি পতিসর যাবার আগে এই বিষয়টা অনুসন্ধান ও হিসাব পরীক্ষা করে দেখে তোমার রিপোর্ট আমাকে দিয়ে যাবে। তোমরা এত চেষ্টা করে টাকা দিয়ে যাচ্ছ অথচ ওভার পেমেন্ট হয়ে যাচ্ছে এর বিহিত ব্যবস্থা এখুনি করা দরকার। Saspease clear করার জন্য আমি অন্নদাকে আজ লিখে দিয়েছি। পু: সৌরীন কি এখন কলকাতায় আছে? শান্তিনিকেতনে যাবার আগে আমাদের উকিল বাবুর সঙ্গে জোড়াসাঁকোয় দেখা করে যেতে পার। তার হাত দিয়ে অধিকাংশ পেমেন্ট হয়েছে। তাঁর কাছেও হিসাব থাকতে পারে। যদি দেখ যে হিসাবে বিশেষ গন্ডগোল আছে তবে আমাকে টেলিগ্রাম কর আমি চলে যাব।
ইতি-
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হিসাব নিকাশ সংশোধন করতে অনুরোধ করলেও তাতে খুব একটা ফল হয়নি। জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির আগাম ইঙ্গিত যখন রবীন্দ্রনাথের নিকট আত্মীয় এস্টেটের কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছেন তখন সঠিক হিসাব তো দূরের কথা স্বয়ং জমিদারের আদেশও অমান্য করেছেন! রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর হৃদয় বিদারক অপর এক চিঠিতে বিশ্বস্ত ম্যানেজার বীরেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারীকে লিখেছেন-

পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর চিঠি

‘শ্রী বীরেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারী কল্যানীয়েষু, 
গত তিন বছরের হিসাব পরীক্ষা করার আমি সুযোগ পাই নাই। অন্নদাকে শৈলেশ বাবুকে হিসাবের খাতা ও ভাউচার অডিটের জন্য দিতে লিখিয়াছিলাম- আমার সে আদেশ অগ্রাহ্য করিয়াছে। তুমি পত্র পাঠ শান্তিনিকেতনে গিয়া অন্নদার কাছ থেকে খাতাপত্র নিজের হেফাজতে লইবে- এবং সমস্ত বিষয়ই চার্জ বুঝিয়া লইবে। যখন চলিয়া আসিবে অফিস ঘর ভালো করিয়া তালাচাবি দিয়া আসিবে। হিসাব পরীক্ষা হইয়া গেলে আমাকে অডিট রিপোর্ট পাঠাইয়া দিও। 
ইতি, শুভার্থী-
শ্রী রথীন্দ্রনাথঠাকুর

অবশ্য ম্যানেজার বীরেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারী তার প্রিয় জমিদার রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্পিত দায়িত্ব জমিদারী বিলুপ্তি পর্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। এবং পতিসর এস্টেটের সকল হিসাব নিকাশ কাগজপত্র নিজ হেফাজতে নিয়েই পতিসর ত্যাগ করেছেন। জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির কিছু আগে ঠাকুর পরিবার যখন অর্থনৈতিক ভগ্নদশায় পড়েছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে ঠাকুর পরিবারে ছেলের বিয়ের জন্য দু’হাজার টাকা ধার চেয়ে ম্যানেজারকে চিঠি লিখেছিলেন কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। নিজে অর্থকষ্টে থেকেও শরীকানদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রেখে প্রতিমা দেবী লিখেছেন-

কল্যানীয়েষু,
বীরেন, জোড়াসাঁকোর বাড়ী থেকে অমিতার চিঠি পেলুম। তার ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে ইতিপূর্বে তোমাকে বলেছি। বিয়ের খরচের টাকা সংগ্রহের জন্য তারা খুবই বিব্রত হয়ে পড়েছে। আমাকে বার বার লিখছে। অজীনের সঙ্গে তোমাকে দেখা করবার জন্য বলেছিলুম। তুমি কি দেখা করেছ? না করে থাকলে নিশ্চয় একবার দেখা করে কথাবার্তা বলে নিয়ো। এসময় তাদের কিছু টাকা দেওয়া বিশেষ দরকার। প্রয়োজনবোধ করলে তুমি দেরাদুনে তোমার বাবু মহাশয়কে লিখে অনুমতি আনিয়ে, অজীনকে কিছু টাকা দেবার ব্যবস্থা যাতে হয় করবে। তাদের এখন বিশেষ অভাব চলছে, এই সময় তাদের কিছু টাকা না দিলে অন্যায় হবে। আমিতা বৌমা লিখেছেন, ইজারার টাকা হিসাবে পেলে, সেই টাকা তাঁরা নিজেদের কাজে লাগাতে পারেন না, সরিকদের মধ্যে হিসাব মত বন্টন করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব যে জমিদারীর হিসাবের আমার নিজস্ব চার্চ্ছ বাবদ যে টাকা পাওনা হয়েছে। হিসাব যদিও আমি পাইনি তবে সম্ভবত দুই হাজারের উপর হবে। তার থেকে যদি দুই হাজার টাকা আমার নামে অজীনদের ধার দাও (আমি যেন ধার দিচ্ছি এই ভাবে) ত খুবই খুশী হব। তাতে আমার অসুবিধা হলেও, এদের এসময় সাহায্য দেওয়া নিতান্তই উচিত বলে মনে করি। অজীনের ছেলের বিয়ে জানুয়ারীতে স্থির হয়েছে, সেই জন্য তুমি যদি ওদের টাকাটা দেওয়ার ব্যবস্থা কর ত খুশী হব। বৌমা জানিয়েছেন অন্তত তাঁর তিন বা চার হাজার টাকার দরকার, আমি দুই হাজার তাদের দিতে পারি সেটা তুমি তাঁকে জানিও। এবং জমিদারীতে ফিরে গিয়ে এক হাজার টাকা আন্দাজ তাঁকে পাঠিয়ে দিও যাতে তাঁরা বিয়ের জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে পারেন। নভেম্বর শেষে টাকাটা পাঠালেই ওঁদের সাহায্য হবে। আশা করি তুমি যথা সাধ্য চেষ্টা করে এ দায় থেকে আমাদের উদ্ধার করবে।
ইতি,
আশীর্বাদিকা, প্রতিমা দেবী

দুঃখের বিষয় আজ যখন গীতাঞ্জলীর একশত বছর পেরিয়ে পালন করেছি রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী; পালন করছি কবির নোবেল প্রাপ্তির শততম বছর, তখন রবীন্দ্রনাথের আর্শীবাণী, অভিভাষণ, কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর চিঠিগুলোর কিছু অংশ পোকায় কেটে ফেলেছে। বিনষ্ট হচ্ছে সমমানের আরো কিছু নিদর্শন। সংরক্ষণের অভাবে এই মহামূল্যবান রবীন্দ্রস্মৃতি যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে তার দায়ভার বহন করবে কে?

তবে আপাতত হাইস্কুলে যে ‘রবীন্দ্র সংগ্রহশালা’ করেছি তাতে সম্পূর্ণ বে-সরকারিভাবে মূল্যবান চিঠিপত্রগুলো প্রদর্শনী করেছি। কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে মূল চিঠিপত্রগুলোর ভবিষ্যত কী হবে? যা হোক শেষ পর্যন্ত এই মহামূল্যবান নিদর্শন, ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, রবীন্দ্রনাথ ও পতিসরে দুর্লভ দলিলপত্র সংরক্ষণ করতে পারলেই আমাদের দায়মুক্তি হয়। যা হতে পারে আমাদের শ্রেষ্ট কাজও। 

লেখক: রবীন্দ্রস্মৃতিসংগ্রাহক ও গবেষক

সোনালীনিউজ/এন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!