• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মার ‘তিক্ত স্মৃতি’ মুছবে জিম ইয়ং কিমের সফরে


নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ১৫, ২০১৬, ১০:৫২ পিএম
পদ্মার ‘তিক্ত স্মৃতি’ মুছবে জিম ইয়ং কিমের সফরে

বাংলাদেশে ৩ দিনের সফরে আসছেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট

বাংলাদেশে তিন দিনের সফরে রোববার (১৫ অক্টোবর) ঢাকা আসছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য দেখতেই তার এই সফর। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যে তিক্ত স্মৃতি রয়েছে, জিম ইয়ং কিমের সফর তা মুছে দেবে বলে আশা করছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। ‘বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস’ বাংলাদেশে পালনের পাশাপাশি ঢাকায় একটি বক্তৃতাও দেবেন তিনি।

ঢাকায় অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করবেন কিম। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশের কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পও ঘুরে দেখবেন তিনি।

স্বাধীনতার পর জিম ইয়ং কিম হবেন বাংলাদেশ সফরে আসা বিশ্বব্যাংকের ৫ম প্রেসিডেন্ট। বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট স্ট্রেঞ্জ ম্যাকনামারা প্রথম বাংলাদেশ সফর করেন। সর্বশেষ ২০০৭ সালের নভেম্বর, সে সময়ের বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট বি. জোয়েলিক দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিপূর্বে বাংলাদেশ সফর করেছেন পল উলফোভিজ। ২০০৪ সালে সফরে আসেন জেমস ডি. উলফেনসন। দক্ষিণ কোরীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক জিম ইয়ং কিম ২০১২ সালের পয়লা জুলাই বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনসহ এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, উন্নয়নশীল বিশ্বে অনুকরণীয় হয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় মাথাপিছু আয় কম হওয়া সত্ত্বেও শিশু মৃত্যু হার, মাতৃ মৃত্যুহার কমানোয় সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশ দেখিয়েছে প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য বিমোচনের একমাত্র অবলম্বন নয়। স্বল্প আয় নিয়েও অনেক অর্জন সম্ভব। এই সাফল্য দেখতেই বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এক দশক পর বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশ সফরে করতে এলেও কিমের এই সফরকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে ‘বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস’ পালন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃষ্টান্ত হিসেবে মেলে ধরবে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সম্মেলন শেষ করেই ঢাকায় আসছেন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আসা দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক কিম। গত ৭ থেকে ৯ অক্টোবর ওই সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীরা যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীও তাতে যোগ দিয়েছিলেন

ভারতে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে সম্প্রতি দায়িত্ব নেয়া বাংলাদেশের নাগরিক জুনাইদ কামাল আহমেদ বলেন, পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে যে ‘অনাকাক্সিক্ষত’ ঘটনা ঘটেছিল, তা এই সফরে দূর হবে বলে তিনি আশাবাদী। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের কথা থাকলেও প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে টানাপড়েনের একপর্যায়ে তাদের বাদ দিয়েই দেশের বৃহত্তম এই সেতুর কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার।

ওই সময়কার তিক্ত অভিজ্ঞতা দূরে রেখে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে সংস্থাটিকে উন্নয়ন অংশীদার করতে নতুন উদ্যমে বাংলাদেশ কাজ করবে বলে আশা রাখছেন জুনাইদ। কয়েক বছর আগে পদ্মা সেতু নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার পর গত অর্থবছরে বাংলাদেশকে ঋণের অর্থ ছাড় আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি করেছিল বিশ্বব্যাংক।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে। এর আগে কখনো সংস্থাটি এক বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ ছাড় করেনি। ওয়াশিংটনে সদর দপ্তরে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালনের কারণে কিমকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন জুনাইদ। তিনি বলেন, ‘উনি (কিম) খুবই পজিটিভ মাইন্ডের একজন মানুষ। একজন আশাবাদী মানুষ।’

বাংলাদেশকে কী চোখে দেখেন কিম জানতে চাইলে জুনাইদ বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছেন।’

‘এই পাঁচ বছর তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর সেই সাফল্য-অর্জন সরেজমিনে দেখতেই বাংলাদেশ সফরে আসছেন।’ বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সফর যেহেতু বিশ্বসংবাদ মাধ্যমেও শিরোনাম হবে, সেহেতু তা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে বলেও মনে করেন জুনাইদ। ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়াও বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ভালো কাভারেজ পাওয়া যাবে। এতে বাংলাদেশের সুনাম বাড়বে।’

কর্মসূচি : রবিবার রাতে ঢাকায় নামার পর র‌্যাডিসন হোটেলে উঠবেন জিম ইয়ং কিম। সোমবার সকালে অর্থমন্ত্রী মুহিতের সঙ্গে বৈঠকের পর বিকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্বে বাংলাদেশ’ শীর্ষক পাবলিক লেকচারে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা দেবেন তিনি।

ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার। বিশ্বব্যাংক সাউথ এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যানিটি ডিক্সনও বক্তৃতা করবেন। বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী হাবিব ওয়াহিদের ‘এন্ড পোভার্টি’ শীর্ষক গান গাইবেন অনুষ্ঠানে। এ পর্বের শেষে ‘প্রসপার বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি প্রেজেনটেশন উপস্থাপন করা হবে।

সেখানে ‘এন্ড গ্লোবাল পোভার্টি বাই ২০৩০ : শেয়ারিং বাংলাদেশ’স এক্সপেরিয়েন্স’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায়ও বক্তৃতা করবেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট। মঙ্গলবার সকালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত কয়েকটি প্রকল্প পরিদর্শনের জন্য বরিশাল যাবেন কিম। ফিরে এসে একান্ত বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। বিকেলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিদায় নেবেন তিনি।

কেন গুরুত্বপূর্ণ : বিশ্বব্যাংকের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে আসলেও কেন কিমের এই সফর গুরুত্বপূর্ণ, তার ব্যাখ্যায় অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, তার উপস্থিতিতে ‘বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস’ পালন করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। ওয়াশিংটনে বৈঠকের ফাঁকে তিনি বলেন, ‘দারিদ্র্য বিমোচন এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে (এমডিজি) বাংলাদেশের সাফল্যে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট অভিভূত। তাই নিজের আগ্রহেই আমাদের দেশ সফর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উপলক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস। বাংলাদেশে তাই এবার দিবসটি ভিন্ন আঙ্গিকে পালিত হবে।’ কিমের আসন্ন ঢাকা সফরকে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্যের ‘স্বীকৃতি’ হিসেবে দেখছেন মুহিত।

‘বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর আমাদের জন্য একটি গর্বের বিষয়। আমরা দারিদ্র্য বিমোচনে যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছি, সেটা সরেজমিনে দেখতেই তিনি বাংলাদেশে আসছেন।’ বাংলাদেশের অর্জনের প্রশংসা করছেন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি চিমিয়াও ফানও।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘যেভাবে বাংলাদেশের অগ্রগতি হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে দারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশে নেমে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।’ নিজের সংস্থার প্রেসিডেন্টের সফর নিয়েও আশাবাদী বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের মিশন প্রধান।

‘বিশ্বব্যাংকের আইডিএ-এর খুব ভালো ব্যবহার করেছে বাংলাদেশ। আর সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে, দেশটির দারিদ্র্য বিমোচনে অভাবনীয় সাফল্য দেখে। সে জন্যই তো বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে সফরের জন্য বেছে নিয়েছেন।’

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্যের হার মোট জনসংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে এ হার ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা শূন্য থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।

দ্রুত কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাদের দারিদ্র্য শূন্যে নামিয়ে আনতে কোনো মতেই ২০৩০ সাল লাগবে না। তার আগেই আমরা সে লক্ষ্যে পৌঁছে যাব।’

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!