• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পরিবহন শ্রমিকদের অরাজকতায় জিম্মি সাধারণ মানুষ


নিজস্ব প্রতিবেদক মার্চ ১, ২০১৭, ১০:৪১ এএম
পরিবহন শ্রমিকদের অরাজকতায় জিম্মি সাধারণ মানুষ

ঢাকা : বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের হঠাৎ ডাকা ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা। একজন বাসচালককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সড়ক দুর্ঘটনা মামলায় অপর এক ট্রাকচালকের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের প্রতিবাদে দূরপাল্লার কোনো বাস চলাচল না করায় সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। ধর্মঘটের কারণে পরিবহন সংকটে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে শুরু করে আজ বুধবারও (০১ মার্চ) চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সারা দেশের মানুষ। অফিসগামী লোকজন, শিক্ষার্থী বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়া লোকজনকে দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের অনেকেই কোনো যানবাহন না পেয়ে হেঁটেই গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেন। তবে সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের। তাদের অনেককেই পরীক্ষা শুরু হয়ে যাওয়ায় দৌড়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছাতে হয়েছে।

চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের নিহতের ঘটনায় গত ২২ ফেরুয়ারি ঘাতক বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন মানিকগঞ্জ আদালত। এছাড়া  গত সোমবার সাভারে সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত মামলায় ঢাকার একটি আদালত এক ট্রাকচালককে মৃত্যুদণ্ড দেয়ায় দেশব্যাপী এই ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। রায়ের প্রতিবাদে পরদিন থেকে চুয়াডাঙ্গায় অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট পালন করেন বাস চালক ও শ্রমিকরা। গত রবিবার থেকে খুলনা বিভাগের ১০ জেলাতেও অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট পালন করা হচ্ছে। এরপর হঠাৎ করে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে এই ধর্মঘট দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী, গুলিস্তান ও মহাখালী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ধর্মঘটের কারণে সব বাস সারিবদ্ধভাবে টার্মিনালে দাঁড়িয়ে আছে। দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি বা ঢাকার বাইরে থেকেও কোনো বাস রাজধানীতে প্রবেশ করছে না। এছাড়া অভ্যন্তরীণ রুটের বাসও তেমন চলাচল করছে না। ফলে রাজধানীবাসীসহ বাইরে থেকে আগতদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। যারা জরুরি প্রয়োজনে রাজধানীতে এসেছিলেন তারাও ফিরে যেতে পারছেন না।

রাজধানীতে সিটি সার্ভিস চললেও তা সংখ্যায় ছিল অনেক কম। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। যানবাহনের জন্য হাজার হাজার যাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা বা অন্য যানবাহনে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে কিছু কিছু মানুষকে।

এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্টোপলিটন ট্রাফিক বিভাগের (পশ্চিম) উপকমিশনার লিটন কুমার সাহা গণমাধ্যমকে জানান, পরিবহন শ্রমিকদের অবরোধের ফলে রাজধানীতে কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে পারছে না। এদিকে ধর্মঘটের কারণে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরে কয়েকশ পণ্যবাহী ট্রাক আটকে পড়ায় ব্যবসায়ীরাও বিপাকে পড়েছেন। বাস না থাকায় চাপ বেড়েছে ছোট যানবাহন ও  ট্রেনে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, এক বাস চালকের যাবজ্জীবন সাজার রায় আসার পর শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়েছিল। কয়েকদিন ধর্মঘট পালনের পর  গত সোমবার রাতে আমরা আলোচনায় বসে সমস্যার প্রায় সমাধান করে ফেলেছিলাম। পরে শোনা গেলো সাভারে এক দুর্ঘটনার মামলায় ঢাকার ৫ নম্বর জজ কোর্টে এক ট্রাক চালকের ফাঁসির রায় হয়েছে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা এখন অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে গেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আবার আলোচনায় বসব।

এই কর্মবিরতি পূর্বনির্ধারিত কোনো কর্মসূচি নয় দাবি করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা জেলা বাস মিনিবাস সড়ক পরিবহন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল হক সদু। তার ভাষ্য, শ্রমিকরা অন্য যানবাহন চলাচলে কোনো বাধা দিচ্ছে না। আমার জানামতে কোনো সংগঠন এ ধর্মঘট পালন করে নাই। ড্রাইভাররা কর্মবিরতি করেছে।

আদালতে বক্তব্য দেয়ার আহবান আইনমন্ত্রীর : পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। জনগণকে কষ্ট না দিয়ে আদালতের সামনে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে তিনি শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে প্রেসব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
 
সারা দেশে পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটে আদালত অবমাননা হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ‘তাঁদের (পরিবহন শ্রমিক) উদ্দেশে বলতে চাই, জনগণকে কষ্ট না দিয়ে আপনারা আদালতে এসে আপনাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। আপনাদের বক্তব্য যদি যুক্তিসংগত হয়, তবে তা দেখা হবে। ধর্মঘটে আদালত অবমাননা হচ্ছে কি না, আবার জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, এটি আদালতের বিবেচ্য বিষয়।

যাত্রীরা অসহায় : কুড়িল বাসস্ট্যান্ডে প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর বাসে উঠেছিলেন মতিঝিলের একটি বেসরকারি  প্রতিষ্ঠানের কর্মী আসাদুল হক। মহাখালীতে নামিয়ে দেওয়ায় বিরক্ত তিনিও। ভাই, অনেক সময় দাঁড়াইয়া বাসে উঠতে পারছি। কিন্তু এরপর আবার এইখানে আইসা নামাইয়া দিল। কিভাবে যাই বলেন?

গাবতলী থেকেও কোনো বাস ছাড়ছে না। চালকদের কর্মবিরতির কারণে হানিফ পরিবহনের সব বাস বন্ধ রয়েছে বলে জানান হানিফ পরিবহনের মহাব্যবস্থাক মো. মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, চালকরা গাড়ি চালাচ্ছে না। আমাদের সব বাস টার্মিনালে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছেলের চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরতে এসে গাবতলীতে আটকা পড়েন খুলনার হান্নান খান। সকাল ৬টা থেকে কাউন্টারের সামনে অপেক্ষা করেও কোনো গাড়ি না পাওয়ায় ২টার দিকে ট্যাক্সি ভাড়া করে পাটুরিয়া ফেরিঘাটের পথ ধরেন তিনি; সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী, বাবা ও মা।

মায়ের অসুস্থতার খবরে আর মেয়ের এসএসসি পরীক্ষার কারণে বাড়ি যাচ্ছিলেন রিকশাচালক আবদুল আজিজ। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও সাতক্ষীরার গাড়ি পাননি তিনি। তিনি বলেন, সকাল থেকে অপেক্ষা করতেছি, মালিক সমিতি বলে হরতাল ডাকছে, কখন গাড়ি ছাড়বে তার ঠিক নাই। অপেক্ষায় আছি, আল্লায় যেভাবে নিয়া যায় যামু।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহিম বক্স দুদু চলমান পরিবহন ধর্মঘট প্রসঙ্গে বলেছেন, এটা আমাদের সাংগঠনিক কোনও সিদ্ধান্ত নয়। চালকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গাড়ি চালানো বন্ধ করেছেন। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।

তিনি আরও বলেন, ‘চালক জমিরকে সাজা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার গাড়ি চালনার বয়স ৩৩ বছর। এরপরও তাকে অদক্ষ চালক বলা হচ্ছে। তাহলে যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্সের বয়স দুই তিন বছর তারা গাড়ি চালাতেই জানেন না। আমরা আর গাড়ি চালিয়ে কী করবো। তাই আমরা গাড়ি চালানো থেকে অবসরে গেলাম।

ঢাকার বাইরে দুর্ভোগ : চট্টগ্রামের সব পরিবহন শ্রমিকও জানতেন না গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে ধর্মঘট। জেলার বিভিন্ন উপজেলার মানুষ এবং নগরবাসীও ধর্মঘটের খবর আগে পায়নি। সকালে বাইরে বেরিয়ে ধর্মঘটের বিষয়ে তারা জানতে পারেন। আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা শামীম সুমন বলেন, আমার অফিস প্রবর্তক মোড়ে। সকালে বেরিয়ে দেখি গাড়ি চলছে না। এখন হেঁটেই গন্তব্যে যেতে হচ্ছে।

এদিকে গতকাল মঙ্গলবার সকালে নগরীর বিভিন্ন রুটে সিটি সার্ভিসের বাস চলাচল করলেও শ্রমিকদের বাধার কারণে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাও বন্ধ হয়ে যায়। চট্টগ্রামের উপজেলা পর্যায়েও বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। টার্মিনাল থেকে আন্তঃজেলা বাস ও দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়নি। নগরীর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল ও কদমতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় পরিবহন শ্রমিকরা সব ধরনের যান চলাচলে বাধা দিচ্ছেন। ধর্মঘটের কারণে বাস-মিনিবাস, ট্রাক, কর্ভাড ভ্যান, হিউম্যান হলারসহ সব গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। নগরী ও মহাসড়কে অটোরিকশা ও রিকশা চলাচল করছে।

সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন পূর্বাঞ্চলীয় কমিটির কার্যকরী সভাপতি মৃণাল চৌধুরী বলেন, গত সোমবার রাতে কর্মসূচি ঘোষণা করায় সব জায়গায় খবর পৌঁছায়নি। তাই কিছুটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড ছাড়া অন্য কোথাও যাতে পিকেটিং না হয় সে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

চান্দগাঁও থানার ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, পরিবহন ধর্মঘট থাকায় শ্রমিকরা গাড়ি চলাচলে বাধা দিচ্ছে। টার্মিনাল এলাকায় পুলিশ পাঠানো হয়েছে। আলমডাঙ্গা উপজেলার হারদি গ্রাম থেকে ফাতেমা খাতুন গত সোমবার বিকালে ট্রেনে করে এসেছিলেন জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসক দেখাতে। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে আবার ট্রেন আসার অপেক্ষায় বসে ছিলেন স্টেশনে। তিনি বলেন, যত দুর্ভোগ আমাগে ঘাড়ে আইসে পড়ে।

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ শেষ বর্ষের ছাত্র আকিমুল ইসলাম রাজবাড়ির বহরপুর গ্রামের বাড়ি যাবেন। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, নাগরিক জীবনের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগ। বিচারের রায়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষ ক্ষুব্ধ হতেই পারে। তার জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় অনেক পথ খোলা আছে। সেই পথে না গিয়ে এভাবে ধর্মঘটে জনজীবনকে জিম্মি করে বিচারের রায় বদলে দেওয়ার চেষ্টা কোনোভাবেই সমাধানের পথ হতে পারে না।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!