• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ দিনেও রহস্য উদঘাটন হয়নি লিটন হত্যার


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ৫, ২০১৭, ১২:২৭ পিএম
পাঁচ দিনেও রহস্য উদঘাটন হয়নি লিটন হত্যার

এখনও অন্ধকারে রয়েছে সুন্দরগঞ্জের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যার রহস্য। ঘটনার ৫ দিন পেরিয়ে গেলেও হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন বা কিলিং মিশনের প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। জানা যায়নি, হত্যার উদ্দেশ্য। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন ৩৯ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এদিকে পুলিশ তদন্ত বাধাগ্রস্ত হতে পারে কারণ দেখিয়ে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো তথ্যই দিচ্ছে না।

গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের স্ত্রীসহ দলের নেতারা হত্যাকাণ্ডের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে সন্দেহ করলেও এই সংসদ সদস্যের বোনদের দাবি তদন্তে সব বিষয়কেই মাথায় রাখতে। রবিবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক অভিযোগ করে বলেন এমপি লিটন হত্যায় জামায়াত-শিবির জড়িত। তিনি বলেন, জামায়াত-শিবির অনেক দিন থেকেই লিটনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছিল। অবশেষে তার শেষ রক্ষা হলো না।

এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকান্ডের ৫ দিন পরও তদন্তে ক্লু বের করতে না পারায় মুখ খুলেছেন তার (লিটন) তিন বোন তৌহিদা বুলবুল, ফাহমিদা বুলবুল কাকলী ও আফরোজা বারী। তারা বলেন, শুধু জামায়াতকে ঘিরে যেন হত্যা মামলার তদন্ত আটকে না থাকে। তার আগে লিটনের স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে জামায়াতই তার স্বামীকে হত্যা করেছে বলে তার ধারণা। আওয়ামী লীগের নেতারাও সেই সন্দেহের কথা ইতিমধ্যে জানিয়েছেন। তবে জামায়াত এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, প্রকৃত খুনিদের আড়াল করতে তাদের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে।

গত ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে। ঘরের ভেতর ঢুকে খুব কাছ থেকে এমপিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে সন্ত্রসীরা। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পরপরই তার মৃত্যু ঘটে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন লিটনের বোন ফাহমিদা। বেশ কয়েকজনকে আটক করলেও তিন দিনেও প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত কিংবা গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

গত মঙ্গলবার (০৩ জানুয়ারি) লিটনের বাড়িতে দোয়া মাহফিল হয়। এর মধ্যেই সাংবাদিকদের সামনে আসেন লিটনের দুই বোন ও স্ত্রী। তাদের চোখেমুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ; আতঙ্কিত যে তা লুকানোর চেষ্টাও তারা করেননি। তৌহিদা বুলবুল বলেন, ‘শুধু জামায়াত-জামায়াত করলে তো হবে না। যদি জামায়াত হয়, জামায়াত। যদি আওয়ামী লীগ হয়, আওয়ামী লীগ। যদি আমি হই, আমি, এনি বডি। আমরা তার পানিশমেন্ট চাই। আমাদের আর কিছু চাওয়ার নেই।’

এমপি লিটনের বন্ধু ও তার পরিবারের নিকটজন হিসেবে পরিচিত মুকুট বলেন, ‘জামায়াত হতে পারে। কিন্তু ডাইরেক্ট জায়ামাত করছে- এ কথাটা কখনো বলা হয়নি।’ মামলার বাদী ফাহমিদা কাকলী বলেন, ‘আমার ভাইয়ের হত্যাকারী কে, কারা করল- সেটা আমি জানতে চাই এবং তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’ 

গাইবান্ধার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এ সার্কেল) রবিউল ইসলাম বলেন, পারিবারিক, স্থানীয় রাজনীতির বিভেদ, ব্যবসাগত, আর্থিক লেনদেন, জামায়াত-শিবির ও জঙ্গিসহ সব বিষয় মাথায় রেখে পুলিশ তদন্ত করছে। আমরা আশা করছি, খুব শিগগিরই খুনি ধরা পড়বে।’ লিটন হত্যাকাণ্ডের দিন তার বাড়িতে স্ত্রী স্মৃতি ও শ্যালক বেদারুল আহসান বেদারসহ দু-একজন ছাড়া আর কোনো স্বজন ছিলেন না। বেশ কয়েকজন গৃহকর্মী ও গাড়িচালকও ছিলেন তখন বাড়িতে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, সেদিন সন্ধ্যায় পাঁচজন ঘাতক দুটি মোটরসাইকেলে এসেছিল। তাদের মধ্যে দুজন লিটনের সঙ্গে কথা বলে তার বৈঠকখানায় ঢোকে। এরপরই গুলির শব্দ আসে। ফাহমিদা বলেন, ‘এইভাবে গ্রামের মধ্যে এসে হত্যা করে যাওয়া এবং সেই সুযোগটা পাওয়া- সব মিলিয়ে সব অ্যাঙ্গেল থেকে পুলিশ তদন্ত করে দেখুক। প্রত্যেকটা অ্যাঙ্গেলে তারা সার্চ করুক। আসলে কী ঘটনাটা।’ ‘লিটন আমার ভাই। হত্যাকারীর বিচার তো আমি চাইতেই পারি। যত দিন বেঁচে আছি। যত দিন বিচার না হয়, তত দিন বিচার চাইব’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন ফাহমিদা।

বড় বোন তৌহিদা বুলবুল বলেন, ‘একেবারে বাড়ি এসে মেরে যাওয়া। এটা সহ্যও করতে পারছি না। আবার কিছুটা ভয়ও পাচ্ছি। আবার ও (কাকলী) বাদী হয়েছে। ওকে আবার টার্গেট করবে কি না? আমাদের এক তরফ থেকে বলাও হয়েছে, আপনারা ভাইবোনেরা একটু সেইফ থাকেন।’ লিটনের স্ত্রী গাইবান্ধার মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী স্মৃতি বলেন, ১৯৯৮ সালে সুন্দরগঞ্জে গোলাম আযমকে নিয়ে জামায়াত আয়োজিত এক সমাবেশ পণ্ড করে দিয়েছিলেন লিটন। তার জের ধরেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।

‘সে সময় তার (লিটনের) গুলিতে আহত জামায়াতের ফতেখাঁ গ্রামের ক্যাডার হেফজসহ আরো দুধর্ষ জামায়াত ক্যাডাররা লিটনকে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে এবং ফোন করে দীর্ঘদিন থেকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল।’ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্মৃতি বলেন, ২০১৫ সালের ২ অক্টোবর শিশু শাহাদত হোসেন সৌরভকে গুলি ছোড়ার ‘একটি পরিকল্পিত মিথ্যা ঘটনাকে’ কেন্দ্র করে এমপি লিটনের লাইসেন্সকৃত রিভলবার ও শটগান জব্দ করে নেয়া হয়। জামায়াত-শিবির চক্র জানত, তার বাড়িতে তাদের প্রতিরোধ করার মতো কোনো অস্ত্র এখন আর নেই। সেই সুযোগে বাড়িতে এসে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করতে সাহস পেয়েছে।’ শিশু শাহাদাত হোসেন সৌরভকে গুলি করার মামলায় গত বছর গ্রেফতার হয়ে কিছুদিন কারাগারে থেকে জামিনে ছাড়া পান লিটন।

প্রতিদিন বিকেলে অনেক নেতাকর্মী তাদের বাড়িতে থাকত। পুলিশ পাহারার ব্যবস্থাও ছিল রাতে। সাধারণত সন্ধ্যার আগেই নেতাকর্মীদের নিয়ে লিটন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বামনডাঙ্গা রেলস্টেশনসংলগ্ন তার অফিসে গিয়ে বসতেন। রাত ৯টা থেকে ১০টা অবধি সেখানে থাকতেন তিনি। স্মৃতি বলেন, ‘কিন্তু কেন জানি না সেদিন কোনো নেতাকর্মী তার বাড়িতে ছিল না।’
লিটনের স্ত্রী জানান, বাড়িতে তখন তিনি, তার ভাই বেদার, ভাগ্নি মারুফা সুলতানা শিমু, চাচি শামীম আরাসহ কয়েকজন গৃহকর্মী ছিলেন।

‘আমি ও আমার ভাই উঠানের রান্নাঘরের কাছে ছিলাম। তখন গুলির শব্দ শুনতে পাই। তিনি (লিটন) ঘর থেকে ভেতর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে বলে, ওরা আমাকে গুলি করেছে, আগে ওদের ধর। তিনি বুকে হাত দিয়ে ছিলেন, বুকের বাঁ পাশ দিয়ে রক্ত ঝরছিল।’

লিটনের চিৎকার শুনে গাড়িচালক ফোরকান মিয়া হামলাকারীদের ধরতে গিয়েছিলেন বলে স্মৃতি জানান। লিটনকে নিয়ে স্মৃতি, ইসমাইল ও বেদার বেরিয়ে আসেন। গাড়িচালক না থাকায় একটি মোটরসাইকেলের মাঝখানে বসিয়ে লিটনকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হন তারা। এর মধ্যে গাড়িচালক ফিরে এলে ওই গাড়িতেই তারা হাসপাতালে যান।

প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ : গাইবান্ধায় চার পুলিশ সদস্য হত্যার পর প্রায় চার বছর হতে চললেও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমন এবং উন্নয়নসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গতকাল বুধবার রংপুর বিভাগের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের ঘটনা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। তাহলে আর দ্রুত বিচার কী হচ্ছে!’ বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা এবার সরকারদলীয় একজন এমপিকে হত্যা করল। এরপরে আর কত ঘটনা ঘটবে কে জানে।’

শেখ হাসিনা বলেন, সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের হত্যাকারীদের অবশ্যই সাজা ভোগ করতে হবে। তাদের কঠোর সাজা দেয়া হবে। এভাবে জনপ্রতিনিধিকে হত্যার ঘটনা তার সরকার কোনোভাবেই বরদাশত করবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকারও আহ্বান জানান তিনি। অপরাধীদের দ্রুত খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছি, যারা এর সঙ্গে জড়িত, যেকোনোভাবে তাদের (আততায়ীদের) খুঁজে বের করতে হবে।’

এ প্রসঙ্গ টেনে গত সোমবার সুন্দরগঞ্জের শাহবাজ এলাকায় এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের জানাজায় ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, ‘সেই মামলার আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে পারলে আজ লিটন হত্যার মতো ঘটনা ঘটত না। কিছু কর্মকর্তার অবহেলার কারণে এতদিনেও পুলিশ হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি।’ গাইবান্ধার নবম শ্রেণির ছাত্রী ঐশ্বর্য সিংহের সঙ্গে কথা বলার পর সংসদ সদস্য লিটন হত্যা মামলার অগ্রগতি জানতে তিনি জেলার পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানতে চান, পুলিশ কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে?

জবাবে গাইবান্ধার এসপি বলেন, ‘৩১ ডিসেম্বর অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। গাইবান্ধা-১ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা অত্যন্ত মর্মাহত। আমরা ইতিমধ্যে এই ঘটনা তদন্তে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছি। পুলিশ এবং বিশেষায়িত সংস্থার কর্মকর্তাসহ সবাই ঘটনাস্থলে গেছেন। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে আমরা দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছি। যে করেই হোক, যেই হোক না কেন... সঠিক তথ্য উদঘাটন করব।’ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি মোতায়েনের কথাও বলেন পুলিশ সুপার।

সুন্দরগঞ্জে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জামায়াত ও জঙ্গিবাদ রুখে দিয়েছিল বলেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। একজন সংসদ সদস্যকে এভাবে হত্যার ঘটনা মেনে নেয়া যায় না।’ তিনি বলেন, ‘অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল লিটন।... আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলব, যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’ 

উল্লেখ্য, গত ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় গাইবান্ধা-১ আসনের সরকারি দলের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে। ঘরের ভেতর ঢুকে খুব কাছ থেকে এমপিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে সন্ত্রসীরা। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

এর পরদিন রবিবার ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ ঢাকায় আনা হয়। সোমবার ঢাকায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জানাজা শেষে গাইবান্ধায় নেয়া হয় লিটনের লাশ। সেখানে তৃতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!