• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আইনজীবী রথীশ হত্যা

পাকা অভিনয় করেছেন প্রেমিক কামরুল ও দীপা


ফরহাদুজ্জামান ফারুক, রংপুর ব্যুরো এপ্রিল ৬, ২০১৮, ০২:২৪ পিএম
পাকা অভিনয় করেছেন প্রেমিক কামরুল ও দীপা

রংপুর: রংপুরের বিশেষ জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ও আওয়ামী লীগ নেতা রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনার নিখোঁজ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার একদিন আগেই স্ত্রী দীপা ভৌমিক ও প্রেমিক কামরুল ইসলাম মাষ্টার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে হত্যা করে। এরপর ওই লাশ ৩০ মার্চ শুক্রবার সকালের মধ্যেই গুম করে রাখেন তারা।

শুক্রবার সন্ধ্যায় বাবু সোনার নিখোঁজের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে পরের দিন শনিবার সকালে কামরুল ইসলাম মাষ্টারের নেতৃত্বে নিখোঁজ বাবু সোনার সন্ধানের দাবিতে প্রথম আন্দোলন শুরু হয়। ওই আন্দোলনে তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে মানববন্ধনে অংশ নেন দীপা ভৌমিকের চতুর প্রেমিক কামরুল মাষ্টার।

ওই দিন মানববন্ধনে অংশ নেয়া তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহরুল হুদা জানান, ৩০ মার্চ শুক্রবার তাদের স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনার নিখোঁজ সংবাদ শুনে আমরা পরের দিন শনিবার মহাসড়ক অবরোধসহ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করি। ওই কর্মসূচিতে কামরুল মাষ্টারের সরব নেতৃত্ব ছিল। তার চোখ-মুখ দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে, সে এরকম একটি হত্যাকান্ড ঘটনা ঘটিয়েছেন।

এদিকে তদন্তসংস্থার সূত্রগুলো বলছে, আতি চতুর স্বভাবের কামরুল মাষ্টার এবং স্নিগ্ধা সরকার দীপা নিখুত পরিকল্পনার ছক কষে বাবু সোনাকে হত্যা করে। বাবু সোনা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে স্নিগ্ধা সরকার দীপা একজন দক্ষ অভিনেত্রীর মত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মিডিয়ার সাথে প্রতিনিয়ত অভিনয় করে গেছেন।

অন্যদিকে স্কুল ও তদন্তকারী সংস্থার তথ্য মতে, রংপুর মহানগরীর তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৯৪ সালের ৮ অক্টোবর হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে স্নিগ্ধা সরকার দীপা এবং ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক পদে কামরুল ইসলাম একই সাথে যোগদান করেন। আর নিয়োগ দুটি দিয়েছিলেন সেই সময়ে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি পদে থাকা অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা। ওই দিন থেকেই শিক্ষক হিসেবে একে অপরকে জানাশুনার সুযোগ হয় দীপা ভৌমিক ও কামরুল ইসলামের মধ্যে। ওই দুজনের শিক্ষকতা জীবনের এমন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে তদন্ত করছেন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের বিবাহের পর থেকেই পারিবারিক অশান্তি শুরু হয়। স্বামী সংসারের প্রতি অমনোযোগি দীপা ভৌমিক পর পুরুষের প্রতি বেশি আসক্ত ছিলেন। তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক পদে নিয়োগ পাওয়ার পরপরই কামরুলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন দীপা ভৌমিক। শুধু কামরুলই নয় আরো বেশ ক’জনের সাথে পরকীয়ার সর্ম্পকে জড়িয়ে ছিল দীপা ভৌমিকের রসালো মন।

এরমধ্যে একই স্কুলের আরেক শিক্ষক মতিয়ার রহমান এবং বাবু সোনার একান্ত সহকারী (গাড়ি চালক) মিলন মোহন্ত ছাড়াও একাধিক ব্যক্তির সাথে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। তবে কামরুলের সাথে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ট সম্পর্কে কোন বাঁধা হয়নি। কামরুল ইসলামের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট।

তদন্ত সংস্থাগুলোর সূত্র বলছে, শিক্ষক কামরুল ইসলাম শুধু দীপা ভৌমিকের পরকীয়া প্রেমিকই নয়, অবৈধ্য ওই সম্পর্কের সূত্র ধরে দীপা ভৌমিকের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, রাধাবল্লভে কামরুলের যে দ্বিতল বাড়ি আছে তার আর্থিক যোগানও দিয়েছেন ওই দীপা ভৌমিক। কামরুল যে মোটরসাইকেলটি ব্যবহার করতেন সেটিও দীপা ভৌমিকের দেয়া উপহার কিনা তাও খতিয়ে দেখছে আইনশৃংখলা বাহিনী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রজীবনে জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত কামরুল ইসলাম। শিক্ষক হিসেবে তাজহাট স্কুলে যোগদানের পর ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ওই স্কুলের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেই সময়ের সভাপতির আনুকুল্যে একজন জুনিয়র শিক্ষক হয়েও নিয়ম বহির্ভূতভাবে কামরুল ইসলাম বিভিন্ন পদ পদবি পান এবং নিয়োগসহ আর্থিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে অনিয়ম দুর্নীতির পাহাড় গড়ে তোলেন স্কুলটিতে। এসময়কার প্রধান শিক্ষক ছিলেন কামরুলের হাতের পুতুল।

স্কুল সূত্র জানা গেছে, সেই সময়ের স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি মারা যাওয়ার পর স্কুলটিতে সভাপতি হিসেবে আসেন অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা। এরপর তিনি শিক্ষক কামরুল ইসলামের সকল অবৈধ হস্তক্ষেপ কঠোরহস্তে দমন করেন। সিনিয়র শিক্ষকদের যথাযথভাবে দায়িত্ব দিয়ে কাজ শুরু করেন। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালে হত্যার শিকার হবার আগ পর্যন্ত তার মাধ্যমে স্কুলে একাডেমিক বিল্ডিং হওয়ার পাশাপাশি বহু উন্নয়ন হয়েছে। স্কুলের জমি নিয়ে সমস্যার ছিলও তার সমাধান হয়েছে কোর্টের রায়ের মাধ্যমে গত ১৪ মার্চ।

এদিকে কামরুল ইসলাম অবৈধ ক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারায় স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরিসহ বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র এবং শৃঙ্খলা বিরোধী কাজ শুরু করেন। আর তাকে রশদ ও সাহস জোগান প্রেমিকা ও সহকর্মী স্নিগ্ধা সরকার দীপা ভৌমিক।

স্কুল সূত্রে জানা গেছে, অব্যাহত শৃঙ্খলা বিরোধী কাজের কারণে গত ৪ মার্চ স্কুলের প্রধান শিক্ষক সভাপতির নির্দেশে তিনটি বিষয় উল্লেখ করে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেন কামরুল ইসলামকে। ওই নোটিশের জবাবও দেন কামরুল। সেই জবাব নিয়ে গত ১৯ মার্চ কলেজ পরিচালনা কমিটির বৈঠক বসে। বৈঠকে জবাব পর্যালোচনা করে সন্তোষজনক না হওয়ায় কামরুলের সাথে কথা বলার জন্য অভিভাবক সদস্য বিপুল সরকারকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি করে দেন অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা।

গত ২৮ মার্চ স্কুলে দুপুরে ওই কমিটির কাছে সরাসরি নোটিশ ও জবাবের বিষয়ে কথা বলেন কামরুল। এক পর্যায়ে তিনি ভুল স্বীকার করেন।

এ বিষয়টি খুবই খারাপ ভাবে নেন কামরুল ও দীপা ভৌমিক। কামরুলকে নোটিশ এবং নোটিশের জবাব প্রাপ্তির পর কমিটি করে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনায় দীপা ভৌমিক খুব নাখোশ হন রথিশ চন্দ্র ভৌমিকের ওপর এনিয়ে কথাকাটাটি হয় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। কামরুলের সাথে দীপার অবাধ প্রেম ও অসামাজিক কার্যকলাপ এবং স্কুলে কামরুলের অবৈধ হস্তক্ষেপে দীপার সমর্থন ও কামরুলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ নিয়ে পারিবারিক বিরোধ উঠে যায় তুঙ্গে।

বিষয়টি নিয়ে একটি সমঝোতার জন্য ৩০ মার্চ রাতে পারিবারিক সালিশের দিনধার্য করা হয় হয়। কিন্তু পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কামরুলের স্কুলের তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হওয়ার পরের দিন এবং দীপার সাথে পারিবারিক সালিশে আগেই দিন ২৯ মার্চেই নিজ বাড়ির নিজ শয়ন কক্ষেই দীপা ভৌমিক ও কামরুল ইসলামের হাতে হত্যার শিকার হন বাবু সোনা।

তদন্ত সূত্রগুলোর তথ্য মতে, ২৯ তারিখ রাতে বাড়ি ফেরার সাথে সাথেই ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর পর ওড়না পেচিয়ে বাবু সোনাকে হত্যা করে দীপা ভৌমিক ও কামরুল। লাশের গলায় ওড়না দিয়ে পেচানো সেই দাগ রয়েছে। এসময় তার পরনে শার্ট-প্যান্ট ও পায়ে জুতা ছিল। লাশ পেচানো ছিল বিছানার চাদর ও লুঙ্গি দিয়ে। সুরুত হাল রিপোর্টেও সে বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

দীপা ভৌমিকের কথিক প্রেমিক কামরুলে ইসলামের পৈতৃক বাড়ি তাজহাট মোল্লাপাড়ায়। তিনি পরিবার নিয়ে নগরীর রাধাবল্লভ এলাকায় বসবাস করলেও মোল্লাপাড়ার বাড়িতেও মাঝেমধ্যে যাতায়াত করতেন।


সোনালীনিউজ/আরআইবি/আকন

Wordbridge School
Link copied!