• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
আত্মঘাতী নারী জঙ্গি

পালাতে ব্যর্থ হলে আত্মহননের নির্দেশ


বিশেষ প্রতিনিধি ডিসেম্বর ২৬, ২০১৬, ০৬:০২ পিএম
পালাতে ব্যর্থ হলে আত্মহননের নির্দেশ

উগ্র জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন দেশের নারীরাও। মূলত স্বামীদের উৎসাহ ও নির্দেশেই ঝুঁকে পড়ছেন এই ধ্বংসাত্মক পথে। ধর্ম প্রচারের নামে এসব নারী জঙ্গি যেমন সংগঠিত করছেন অন্য নারীদের; তেমনি গোপনে দেশ ও দেশের বাইরে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরাও পরিণত হচ্ছেন দুর্ধর্ষ জঙ্গিতে। নামে-বেনামে জঙ্গি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

কোমলমতি শিশু-কিশোরসহ নারীদের নিয়ে গোপন আস্তানা গড়ছেন। অপারেশনে অংশ নিচ্ছেন। এমনকি সুইসাইডাল স্কোয়াডে নাম লিখিয়ে বেছে নিচ্ছেন ভয়াবহ আত্মঘাতীর পথ। মরছেন নিজে। ধ্বংস হচ্ছে পরিবার। প্রাণ যাচ্ছে শিশু সন্তানদেরও।

র‌্যাব ও পুলিশ বলছে, সারা দেশেই জেএমবিসহ বিভিন্ন উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠনে এখন নারীদের রিক্রুট করা হচ্ছে। তাদের কাছে এর একটা তালিকাও আছে। তাতে দেড় সহস্রাধিক সক্রিয় সদস্য থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে হামলা চালানোর জন্য এই নারীদের ব্যবহারের পরিকল্পনা আছে উগ্রবাদীদের।

নারী জঙ্গিরা জেলাপর্যায়ে পাড়া-মহল্লায় ধর্ম প্রচারের নামে ও ছোট ছোট সাপ্তাহিক ধর্মসভার আড়ালে কাজ করছে। নারীদের এই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জঙ্গিবাদী তৎপরতায় নারীদের ব্যবহারের কিছু সুবিধা আছে। পর্দা করার কারণে তাদের শনাক্ত করা কঠিন এবং অস্ত্র-বিস্ফোরক বহনও তাদের জন্য সহজ। বিশেষ করে আত্মঘাতী হামলায় তাদের ব্যবহারে বাড়তি সুবিধা পেতে পারেন জঙ্গিরা।

গত ২৫ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নারী জঙ্গি বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, জামায়াত-শিবির আগে থেকেই মাঠে রয়েছে। এখন তারা লেডি সুইসাইডাল স্কোয়াড গঠন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর সেই বক্তব্যের পর দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে।

গত ২৩ জুলাই সিরাজগঞ্জের এক বাসা থেকে চার নারী জঙ্গিকে আটকের পরই নারী জঙ্গিবাদের বিষয়টি সামনে চলে আসে। অন্য জেলা থেকে সেখানে এসে গোপন আস্তানা গড়েছিলেন এই নারী জঙ্গিরা। তারা সেখান থেকে জেএমবির জন্য তহবিল সংগ্রহ, সদস্য সংগ্রহ, সাংগঠনিক ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছিলেন।

এরপর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু নারী জঙ্গিদের আটক ও আস্তানা উদ্ধার করে র‌্যাব ও পুলিশ। সর্বশেষ আরেক নারী জঙ্গিদের আস্তানার সন্ধান মেলে রাজধানীর আশকোনায়। গত শনিবার সেখানে ‘সূর্য ভিলা’ নামে এক বাসায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চালানো অভিযানে ভয়ংকর জঙ্গি সুমনের স্ত্রী আত্মঘাতী হয়ে মারা যান। নিহত হয় রাজধানীর অভিজাত একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ুয়া আফিফ কাদেরী আদর নামের এক কিশোর।

পুলিশ বলছে, জঙ্গি সুমনও পুলিশের একটি অভিযানে নিহত হয়েছেন। আর কিশোর আফিফের বাবা তানভীর কাদেরী ও ভাই তাহরীর কাদেরীও পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আত্মঘাতী হয়ে মারা যান। তবে জঙ্গিবাদে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নারী ও কিশোরের নিহত হওয়ার ঘটনাটি একেবারেই নতুন। তাই বিষয়টি এখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে নতুন ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটি) সূত্র থেকে জঙ্গিদের নারী শাখার কঠোর সিদ্ধান্তের কথা জানা গেছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, একেক পুরুষ জঙ্গি তাদের স্ত্রীদের দীক্ষা দিয়ে বলেছেন, ‘জিহাদের’ জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কোনোভাবেই পুলিশের কাছে ধরা পড়া যাবে না। লড়াই করে ধরা পড়ে যাওয়ার আগে প্রয়োজনে আত্মাহুতী দিতে হবে। এরই অংশ হিসেবে আজিমপুরের অভিযানের সময় এক নারী জঙ্গি ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার করে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন।

তবে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় পুলিশ তাকে ধরতে সমর্থ হয়। আজিমপুরের রাস্তায় ওই নারীর দুর্ধর্ষ আচরণ প্রত্যক্ষ করেছে সেখানকার মানুষ। অপর দুই নারী আস্তানা থেকে বের হতে না পেরে সেখানেই আত্মাহুতী দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সর্বশেষ গত শনিবার রাজধানীর আশকোনায় রিপল-২৪ অভিযানে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হন জঙ্গি সুমনের স্ত্রী। কল্যাণপুর অভিযানে নিহত আরেক জঙ্গি মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা ও পলাতক জঙ্গি নেতা মাঈনুল ইসলাম মুসার স্ত্রী তৃষ্ণা মনি তাদের কন্যাশিশুসহ আত্মসমর্পণ করেন।

সিটি সূত্র আরো জানায়, পুলিশের জঙ্গিবিরোধী শক্ত অভিযানের মুখে পালিয়ে থাকা জঙ্গিরা তাদের স্ত্রীদের কাছে বার্তা দিয়ে জানিয়েছেন, তাদের খুঁজে পাওয়া না গেলে বা নিহত হলে জিহাদের প্রয়োজনে তারা নতুন সঙ্গী (স্বামী) বেছে নিতে পারবেন। তারা মারা গেলে যোগ্যতার বিচার না করে সংগঠনের সদস্যদের মধ্য থেকে যে কাউকেও বিয়ে করার নির্দেশনা রয়েছে নারী জঙ্গিদের প্রতি। নিজেদের আত্মরক্ষায় প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি সন্তানদের জঙ্গি দীক্ষা দেওয়া এবং সংগঠনে নতুন ‘সিস্টার’ (বোন) বাড়ানোরও নির্দেশনা রয়েছে এসব জঙ্গি স্বামীর।

গত ১০ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার আজিমপুরের আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার হন তিন নারী জঙ্গি। তারা হলেন অভিযানে নিহত নব্য জেএমবির সংগঠক তানভীর কাদেরী ওরফে আবদুল করিমের স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে আশা, নব্য জেএমবির অপারেশনাল কমান্ডার পলাতক নুরুল ইসলাম মারজানের স্ত্রী শায়লা আফরিন প্রিয়তি ও পলাতক জঙ্গি বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেটের স্ত্রী ফেরদৌসী আফরিন। দুর্ধর্ষ এই তিন নারী জঙ্গি গত ১৭ অক্টোবর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তারা বলেছেন, স্বামীদের মাধ্যমেই তারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন। তাদের নির্দেশেই প্রশিক্ষণ নেয়া থেকে শুরু করে হিজরতের মাধ্যমে নিজেদের ঘর ছেড়ে অন্যত্র (আজিমপুরের আস্তানায়) উঠেছিলেন।

তাদের অন্যতম সমন্বয়ক নব্য জেএমবির প্রশিক্ষণ কমান্ডার নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নেসা শিলা। রূপনগরের আস্তানায় শিলার স্বামী নিহত হওয়ার পর তিনি আজিমপুরে তাদের কাছে আশ্রয় নেন। তবে পুলিশের অভিযানের আগেই শিলা আজিমপুরের আস্তানা ছেড়ে চলে যান।

র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ৬ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর ফার্মগেট ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে নারী জঙ্গি মারজিয়া আক্তার ওরফে সুমি, তার স্বামী শরিফুল ইসলাম, নাহিদা সুলতানা ও তার স্বামী আমিনুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদেও নারী জঙ্গি কার্যক্রমের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।

জঙ্গি মারজিয়া ওই সময় জানিয়েছিলেন, তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে সংযুক্ত হন। পরে অন্তর্ভুক্ত হন জেএমবির থ্রিমা ও টেলিগ্রাম অ্যাপের বিশেষ দলে। পরে তাকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের বিভিন্ন দৃশ্য, আহত শিশুদের ছবি, মেয়েদের ছবি, অসহায় মানুষের ছবি, কিছু হাদিস, যুদ্ধের বিভিন্ন ভিডিও ও খিলাফত-সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে দীক্ষা দেওয়া হয়। এরপর তিনি গত ২০ আগস্ট ‘জিহাদে’র জন্য বাড়ি ছাড়ে। পরে সে সংগঠনের সিদ্ধান্তে শরীফুলকে গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকায় গিয়ে বিয়ে করেন।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!