• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পুলিশের টর্চারে পেশাদার সাংবাদিক


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ২৯, ২০১৭, ০৪:০২ পিএম
পুলিশের টর্চারে পেশাদার সাংবাদিক

ঢাকা: রাজপথে বিক্ষোভ-মিছিল আর আন্দোলন-সংগ্রামের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিক এবং দায়িত্বরত পুলিশকে একই কাতারে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। অপরাধ ও অপরাধীর খবর জানতেও প্রতিনিয়ত পুলিশের শরণাপন্ন হতে হয় সংবাদকর্মীদের। অথচ এই পুলিশের হাতেই প্রতিনিয়ত নির্যাতন, লাঞ্ছনা আর নাজেহাল হতে হচ্ছে দেশের পেশাদার সাংবাদিকদের। 

পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে এভাবেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। পুলিশি আক্রোশ ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দুর্নীতি-অনিয়মের প্রতিবেদন করতে গেলে পড়তে হচ্ছে প্রতিবন্ধকতার মুখে। শিকার হতে হচ্ছে নির্যাতনের। সাংবাদিকদের ওপর এমন নির্যাতনের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এসব হামলায় কখনো কখনো সাংবাদিকদের প্রাণ দিতে হয়। সাংবাদিকদের ওপর অযাচিত আক্রমণ, সহিংস ঘটনার বিচারিক তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে নির্যাতনের ঘটনা কমছে না।

পুলিশি হামলায় সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার পর সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপের কারণে ‘শান্তিপূর্ণ’ সমাধান মিলেছে। সব ক্ষেত্রেই জড়িত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করেই ‘দায়’ সারে সংস্থাটি। পুলিশের হাতে সাংবাদিক নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনাই ঘটেছে পুলিশের কনস্টেবল বা এসআই পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সাংবাদিকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণে অনেকটা ‘ম্যাচিউরড’ বিসিএস থেকে আসা পুলিশ কর্মকর্তারা। হয়তো তারা সাংবাদিক বোঝেন। কিন্তু এই বড় কর্মকর্তাদের মধ্যে নবীন কর্মকর্তার আচরণও অনেক সময় বেপরোয়া হয়ে উঠে।

পুলিশের হাতে শুধু সাংবাদিকরাই আক্রান্ত হচ্ছেন না। কিছুদিন আগে আদালতপাড়ায় পিতাকে বাঁচাতে গিয়ে পুলিশের হাতে নিরীহ তরুণীর শ্লীলতাহানি দেখেছে দেশবাসী। গাজীপুরে আসামিকে ধরে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিয়েছে পুলিশ। পরে সন্ত্রাসীদের চাপাতির কোপে নিহত হন সেই যুবক। আর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র লিমন-কাদেরদের দিয়ে র‌্যাব-পুলিশের অপকর্মের ফিরিস্তিও ভুলেনি কেউ। 

সম্প্রতি সাংবাদিকদের পেটানোর পর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি আবারও আলোচনায় আসছে। কারণ এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কোনো সুরাহা হচ্ছে না। রহস্য উদঘাটনে পুলিশ ও সরকারের নির্লিপ্ত থাকার ব্যাপারটি উঠে আসছে। সাংবাদিক হত্যা বিষয়টিও এখন নতুন কোনো ইস্যু নয়। এর আগে দক্ষিণাঞ্চলে সাংবাদিক মানিক সাহা, হুমায়ূন কবির বালু, শামছুর রহমান, গৌতম দাসদের হত্যা করা হয়েছে। অনেক নির্যাতন-হত্যার মধ্য দিয়েই সাংবাদিকদের এগুতে হচ্ছে। 

স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে ব্যবহৃত পুলিশ বাহিনীটি নিজেদের অজান্তেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আর সে কারণেই ভাড়াটে মাস্তানদের মতো সময়ে সময়ে, সরকারের প্রয়োজনে পুলিশ হয়ে উঠছে ‘পেটুয়া বাহিনী’ হিসেবে। কেউ কেউ বলেন, অতি উৎসাহী পুলিশ সরকারকে ডোবানোর জন্য এ কাজগুলো করছে। সাংবাদিক এবং পুলিশের মধ্যে বন্ধুত্বসুলভ সৌহার্দ্যরে সেতু তৈরি করাই এখন সরকারের দায়িত্ব।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, গেল বছর পুলিশের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯ জন পেশাদার সংবাদকর্মী। আর ফোনে হুমকি, সংবাদ প্রকাশের জেরসহ বিভিন্ন কারণে ক্ষমতাসীনদের আক্রোশের শিকার হয়েছেন ১০৯ জন সাংবাদিক। 

এর আগের বছর পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন ১৮ জন সাংবাদিক। আর ক্ষমতাসীনদের হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন আরো ২২৪ জন। ২০১৪ সালে ২১ জন সাংবাদিককে পুলিশের হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। আর বিভিন্ন কারণে হামলা-মামলায় জড়ানো হয়েছে আরো ২১৮ জন সাংবাদিককে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, নির্যাতক পুলিশের শাস্তি না হলে সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধ হবে না। এ জন্য নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক এবং তার আইনজীবীকে সাহস করে বিচারকের কাছে বলতে হবে যে, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হলে সেটা বিচারকের কাছে তুলে ধরতে হবে। নইলে পুলিশের হয়রানি ও প্রতিহিংসা বন্ধ করা কঠিন।

শাহবাগ থানায় দুই সাংবাদিককে নির্যাতন : বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) বাগেরহাটের রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে হরতাল পালন করে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। রাজধানীর শাহবাগে হরতালের সমর্থনের মিছিলে বাধা দেয় পুলিশ। টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুঁড়ে মিছিলকারীদের ওপর। 

ওই ঘটনার ছবি ক্যামেরায় ধারণ করায় এক টিভি রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যানকে বেধড়ক পিটিয়েছে পুলিশ। সাংবাদিক পরিচয় দিয়েও রেহাই পাননি তারা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর দেড়টায় শাহবাগ থানার সামনে দুজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এটিএন নিউজের ক্যামেরাম্যান আবদুল আলিম ওই ঘটনার ভিডিও করতে যান। এ সময় পুলিশ সদস্যরা তার ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে তাকে মারধর শুরু করেন। 

সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও তার পিঠ ও মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকে পুলিশ। ক্যামেরাপারসনকে বাঁচাতে গিয়ে একইভাবে পুলিশের হামলার শিকার হন সেই টিভির রিপোর্টার ইশান দিদার। হামলার শিকার দুই সাংবাদিক জানিয়েছেন, ২০-৩০ জন পুলিশ সদস্য মিলে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। পরিচয় দেওয়ার পর তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। এ ঘটনায় এক এএসআইকে বরখাস্ত করেছে ডিএমপি।

২০১৫ সালের ২০ নভেম্বর রাতে শাহবাগ মোড়ে সাংবাদিকদের মারধর করেন একজন এএসপি। তিনি শুধু সাংবাদিকদেরই মারেননি, মেরেছেন পুলিশের সদস্যদেরও। সেই রাতে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শাহবাগ মোড়ে নিরাপত্তা সম্পর্কিত সংবাদ সংগ্রহের সময় এ ঘটনা ঘটে। মোটরসাইকেলে সাধারণ পোশাকে ছিলেন এএসপি। তার সঙ্গে ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগের এক নেতা। তারা প্রেস লেখা মোটরসাইকেলে ছিলেন। 

পুলিশ চেকপোস্টে তাদের তল্লাশির ছবি ধারণ করতে গেলে একটি বেসরকারি টিভির ক্যামেরাম্যানকে গালাগাল ও মারধর করেন তিনি। একই টিভির সিনিয়র এক রিপোর্টার এগিয়ে গেলে তাকেও মারধর করা হয়। এমনকি ঘটনা শুনে শাহবাগ থানার ওসি এগিয়ে এলে তাকেও মারধর করেন এই এএসপি। তার আচরণে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন।

এদিকে ২০১৬ সালের ১১ জুন সাপ্তাহিক মুক্তমন ও টাইমসনিউজ২৪ডটকমের সিনিয়র রিপোর্টার এ কে এম সীমান্তকে থানার ভেতরে নিয়ে নির্যাতন করে রাজধানীর কমলাপুরের রেলওয়ে থানা পুলিশ। পুলিশি বর্বরতার শিকার সাংবাদিক এ কে এম সীমান্ত জানান, ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর সাপ্তাহিক মুক্তমনে ‘মাদকে ভরপুর স্টেশন কমলাপুর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তিনি। 

এর জেরেই কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি আবদুল মজিদ ও তার একজন এসআই রাজিব আহমেদ গত বছরের ১১ জুন ইফতারের ঠিক আগমুহূর্তে ফোনে তাকে স্বর্ণ উদ্ধার হয়েছে বলে সংবাদ সংগ্রহের কথা বলে থানায় ডেকে পাঠায়। তিনি থানায় যাওয়ার পরপরই ওসি মজিদ ও এসআই রাজিবসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাকে কিলঘুষি ও লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করেন। পরে তিনিসহ তার সঙ্গে থাকা একজন নিরীহ যুবককে মাদক ও চাঁদাবাজির মামলা দেন। ওই ঘটনায় ৭ দিন জেল খাটেন তিনি। এখনো পুলিশি নির্যাতনের সেই ভয়াবহতা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন সাংবাদিক সীমান্ত।

২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন, দৈনিক জনতা এবং মৌলভীবাজার থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘পাতাকুঁড়ির দেশ’ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার সাইফুল ইসলামকে থানায় নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালায় শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশ। এরপর সেই সাংবাদিককে গাড়িতে পেট্রোল বোমা হামলা এবং পুলিশ অ্যাসল্টের দুটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। এরপর পুলিশি নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে ৩৮ দিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্ত হন সাংবাদিক সাইফুল। একপর্যায়ে সাইফুলের বিরুদ্ধে আনা পুলিশের সেই মামলাও খারিজ হয়ে যায়।

সাংবাদিক নির্যাতনের আরো কয়েকটি চিত্র : ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ইংরেজি দৈনিক নিউএইজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক নাজমুল হুদা ও তার বন্ধু খায়রুজ্জামান শুভকে পিটিয়ে আহত করেছে পুলিশ। পুলিশের দৃষ্টিতে তাদের ‘অপরাধ’ ছিল, হেলমেটবিহীন অবস্থায় দুজন পুলিশ সদস্য মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই আইন ভঙ্গের ছবি তোলায় সাংবাদিক-শিক্ষার্থীকে প্রকাশ্যে পেটায় পুলিশ। এর পর সেই দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে ‘দায়’ সারে ডিএমপি। 

২০১৫ সালে বিভিন্ন সময়ে কুষ্টিয়ায় একুশে টিভির রিপোর্টার অখিল পোদ্দার, রাজধানীর কারওয়ানবাজারে এসএ টিভির রিপোর্টার সালাউদ্দিন মাহমুদ মীম, পান্থপথে আর টিভির রিপোর্টার নাজিব ফরায়েজি এবং কাকরাইলে রমনা থানা পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন একজন অনলাইন সাংবাদিক। 

২০১২ সালের ২৬ মে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের সময় প্রথম আলোর তিন ফটোসাংবাদিক খালেদ সরকার, সাজিদ হোসেন ও জাহিদুল করিমকে বেধড়ক মারধর করে পুলিশ। পরে সেই তিন সাংবাদিককে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর ভয়াবহ সেই পুলিশি হামলার ঘটনায় ৯ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করেই ‘দায়’ সারে ডিএমপি।

১৯৯২ সালের ২১ জুন তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীর নির্দেশে পুলিশ জাতীয় প্রেসক্লাবে হানা দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায়। পুলিশের সেই বেপরোয়া লাঠিপেটায় ১০-১২ জন সাংবাদিকসহ জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যরা গুরুতর আহত হন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এখনো ওই হামলার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। এরপর থেকে দেশের সাংবাদিক সমাজ ২১ জুনকে ‘সাংবাদিক নির্যাতন দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এআই

Wordbridge School
Link copied!