• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

পৃথিবীর ভয়ঙ্কর মাংসখেকো সব উদ্ভিদ


শেখ সুজন এপ্রিল ১০, ২০১৭, ০৩:২৫ পিএম
পৃথিবীর ভয়ঙ্কর মাংসখেকো সব উদ্ভিদ

ঢাকা: পৃথিবীতে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রায় সাড়ে চার লাখ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে এক বিশেষ অংশ দখল করে আছে বৈচিত্র্যময় মাংসাশী উদ্ভিদ সম্প্রদায়। পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশ জুড়ে প্রায় ৬০০ প্রজাতির মাংসাশী উদ্ভিদ ছড়িয়ে আছে। মাংসাশী বলতে এরা যে সরাসরি জীবন্ত প্রাণী জাপটে ধরে খেয়ে ফেলে তা বুঝায় না। এদের শরীরে কিছু বিশেষ যান্ত্রিক ফাঁদ ব্যবস্থা আছে, যেগুলো বিভিন্ন পোকা-মাকড় ও জীবন্ত প্রাণী আটকা পড়তে সাহায্য করে। এসব উদ্ভিদের দেহ হতে নিঃসৃত বিভিন্ন হজম সহায়ক এনজাইম সেই আটকা পড়া প্রাণীর দেহ গলিয়ে তা থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে। গঠনগত দিক দিয়েও অনেক বৈচিত্র্যের ও আকর্ষণীয় অধিকারী হয় এসব উদ্ভিদ। চলুন, সবচেয়ে পরিচিত কয়েকটি মাংসাশী গাছের কথা জেনে নেয়া যাক।

ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ (Venus Flytrap)

মাংসাশী গাছগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রখ্যাত বলা যায় এই ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপকে। সবচেয়ে বেশি গবেষণাও হয়েছে একে নিয়েই। এর অসাধারণ সৌন্দর্যকে বাদ দিয়ে দেখার কোনো অবকাশ নেই। অবিকল মানুষের মুখগহবরের মতো গঠন এর পাতাগুলোর। পাতাগুলোর মাঝ বরাবর দরজার কব্জার মতো ব্যবধায়ক আছে যার মাধ্যমে পাতাগুলো দ্রুত খুলতে ও বন্ধ হতে পারে। এই পাতাগুলোর ভেতরের পৃষ্ঠজুড়ে অনেকগুলো সংবেদনশীল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্ত লোমের মতো অঙ্গ থাকে। মাছি, পোকামাকড় বা এই জাতীয় কোনো শিকার এসব লোমের সংস্পর্শে আসা মাত্র অতি দ্রুততার সাথে শিকারসহ পাতার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। পাতার অভ্যন্তরীন ক্ষরণে তখন ভেতরে আটকা পড়া শিকারটির শরীরের নরম অংশগুলো খসে পড়তে থাকে। ধীরে ধীরে শিকারের দেহ বিগলিত হয়ে হজম হয়ে যায়। হজম কাজ সম্পন্ন করতে এর প্রায় ১০ দিন সময় লাগে। একবার হজম হয়ে যাওয়ার পর পাতাটি পুনরায় উন্মুক্ত হয়ে যায় নতুন শিকারের অপেক্ষায়। প্রশ্ন উঠতে পারে, বৃষ্টির পানি বা শিকার ব্যতীত যাবতীয় কিছু পাতার লোম স্পর্শ করলেও কি পাতা বন্ধ হয়ে যায়? অবশ্যই না। প্রকৃতির রাজ্যে অহেতুক কসরতের ঘটনা খুবই কম। কোনো বস্তু ফ্লাইট্র্যাপের পাতার একটি লোম স্পর্শ করার ২০ সেকেন্ডের মধ্যে যদি আরও দুই বা ততোধিক লোম আলোড়িত হয়, তবেই শুধু পাতাটি বন্ধ হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে প্রকৃতির এক অনন্য প্রকৌশল ব্যবস্থা এই ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ।

পিঙ্গিকুলা (Pinguicula)

এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকায় জন্মানো এই পিঙ্গিকুলা গণের অধীনে ৮০টি প্রজাতির মাংসাশী উদ্ভিদ রয়েছে। এরা ‘বাটারওয়ার্ট’ নামেও বহুল পরিচিত। এসব উদ্ভিদের পাতা গ্রন্থিসমৃদ্ধ ও বেশ বড়সড় হয়। এদের পাতার অগ্রভাগ থেকে আঠালো মিউসিলেজ নিঃসরিত হয় যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তন্তুর ন্যায় অংশে শিকার আটকাতে সাহায্য করে। বেশিরভাগ পিঙ্গিকুলাতে এক ধরণের দুর্গন্ধ থাকে যা শিকারকে আকর্ষণে ভূমিকা রাখে। পিঙ্গিকুলার ফাঁদ প্রকৌশল দুই ধরণের গ্রন্থি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রথমটির নাম পেডানকুলার গ্রন্থি। এটি থেকে মিউসিলেজ ও হজমকারী এনজাইমসহ এক রকম পদার্থ ক্ষরণ করে থাকে যা পাতার উপরে ছোট ছোট তরল কণিকারুপে বিরাজ করে। এই আঠালো তরলের কণাগুলো পোকামাকড়কে আকৃষ্ট করে। যখনই কোনো পোকামাকড় পাতায় বসে, সঙ্গে সঙ্গে পেডানকুলার গ্রন্থি আরও বেশি করে মিউসিলেজ ক্ষরণ করে পোকাটিকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে। এরপরই সিসাইল নামক দ্বিতীয় গ্রন্থিটি কার্যকর হয়ে একগাদা হজমকারী এনজাইম ক্ষরণ করে যা ধীরে ধীরে পোকাটির দেহকে ভেঙে শোষণ করতে সাহায্য করে। যতটা মোহনীয় এর রুপ, ঠিক ততটাই ভয়ানক এর ফাঁদ।

নেপেন্থেস (Nepenthes)

এরা ‘মাংকি কাপ’ বা ‘ট্রপিক্যাল পিচার প্ল্যান্ট’ নামেও পরিচিত। ন্যাপেন্থেস গণভুক্ত প্রায় ১৫০টি প্রজাতি রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত, চীন, মাদাগাস্কার, সিচেলেস ও অস্ট্রেলিয়ায় এদের দেখা মেলে। এদের দেহের অংশবিশেষের পিচার বা কলসের মতো গঠনের কারণে এদের পিচার প্ল্যান্ট বলা হয়। এই কলসাকৃতি অংশটিই মূল ফাঁদ। এর ভেতরে জমে থাকা বৃষ্টির পানি প্রায়ই বানররা খেতে আসে বলে এদের এর আরেক নাম হয়েছে মাংকি কাপ। এই কলসের উপরের অংশটি পিচ্ছিল থাকে। শুধু বানরই নয়, পানি খেতে আসা যেকোনো প্রাণী পিচ্ছিল অংশটির সংস্পর্শে এলেই কাজ হয়ে গেলো! ফাঁদের নিচের অংশে থাকে কয়েকটি গ্রন্থি। এসব গ্রন্থি দিয়ে শিকারের দেহ থেকে পুষ্টি শুষে নেয় গাছটি। ছোট প্রজাতির নেপেন্থেসগুলো সাধারণত এভাবে পোকামাকড়ের শিকার করে থাকে। তবে বড় প্রজাতিগুলোকে ছোট ছোট পাখি ও ইঁদুরদের ভোজ হিসেবে গ্রহণ করতে দেখা যায়।

ইউট্রিকুলারিয়া (Utricularia)

এরা ব্ল্যাডারওয়ার্ট নামে বেশি পরিচিত। বিভিন্ন মহাদেশে এই ইউট্রিকুলারিয়া গণের অধীনে প্রায় ২০০ প্রজাতি রয়েছে। মাংসাশী উদ্ভিদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রজাতি ইউট্রিকুলারিয়ার অন্তর্ভুক্ত। জলে ও স্থলে উভয় স্থানেই এরা জন্মায়। এই উদ্ভিদের দেহে ব্ল্যাডার বা থলির মতো গঠনবিশিষ্ট ফাঁদ থাকে। এই ফাঁদের মুখে গ্রন্থি ও সংবেদী লোমসমেত প্যাঁচানো অ্যান্টেনার মতো গঠন থাকে। এই অ্যান্টেনা শিকারকে ফাঁদের দরজায় নিয়ে আসতে সাহায্য করে। এরপর সংবেদী লোমে টান পড়া মাত্র ঘটনা ঘটে যায়। বাইরের তুলনায় থলির ভেতরে চাপ কম থাকে বিধায় টান পড়া মাত্র থলি নিজ দায়িত্বে শিকারকে ভেতরে টেনে নেয়। প্রোটোজোয়া, মশার লার্ভা ও ছোট ছোট মাছ এভাবে ইউট্রিকুলারিয়ার শিকারে পরিণত হয়। পুরো ব্যাপারটা খুবই কম সময়ের মধ্যে সংঘটিত হয়।

হিলিয়ামফোরা (Heliamphora)

এই দীর্ঘজীবি, চিরসবুজ ও দ্বিবার্ষিক উদ্ভিদটি দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া যায়। এর আরেক নাম ‘সান পিচার’, বাংলায় ‘সূর্য কলস’। এদের ফানেলের মতো নলাকৃতি পাতাগুলোতে পানি ভরা থাকে, আর এ পাতাগুলোই শিকার ধরায় ফাঁদের কাজ করে। কীট-পতঙ্গ এসব মোহনীয় পাতার আকর্ষণে কাছে এসে ভেতরে পড়ে গেলে পাতায় জমা পানিতে বিরাজমান ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে এদের দেহ হজম করে নেয় হিলিয়ামফোরা। এদের মূলতন্ত্র অতি উন্নত। হিলিয়ামফোরা গণের অধীনে ২৩টি প্রজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র একটি প্রজাতি ‘হিলিয়ামফোরা টেটেই’ ব্যাকটেরিয়ার সাহায্য নেয় না। এরা হজমের জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইম নিজেই তৈরি করে।

সারাসিনিয়া (Sarracenia)

সারাসিনিয়া উদ্ভিদ বিশেষভাবে উত্তর ও পূর্ব আমেরিকায় পাওয়া যায়। এই গণের অধীনে ১০টি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। এদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো এদের নলাকৃতি পাতা ও পাতার মাথায় ছাতার মতো গঠন। এসব উদ্ভিদ ঘ্রাণ, নেকটার রস ও বর্ণ দ্বারা কীট-পতঙ্গকে আকৃষ্ট করে। গ্রীষ্মকালে এদের পাতা গাঢ় লাল ও বেগুনীর মিশ্র বর্ণ ধারণ করে। এতে কীট-পতঙ্গ আরও বেশি করে আকৃষ্ট হয়। কীট-পতঙ্গ পাতায় এসে বসার পরে পিচ্ছিল গাত্র আর সূক্ষ্ম রোমের কারণে আর উড়ে যেতে পারে না। নলাকার পাতার ভেতরে হজমকারী এনজাইমসমৃদ্ধ তরল থাকে। এই তরলে দ্রবীভূত হয়ে শিকার ধীরে ধীরে হজম হয়ে যায়। এটাও লক্ষ্য করা যায় যে, কীট-পতঙ্গের উপর এই তরলের নেশা সৃষ্টিকারী ও অবশকারী প্রভাব আছে। অপরুপ মোহনীয়তায় এভাবেই শিকার ধরে উদরপূর্তি করে সারাসিনিয়া।

ড্রসেরা (Drosera)

ড্রসেরের প্রায় ২০০টি প্রজাতি রয়েছে। এদের নিঃসন্দেহে মাংসাশী উদ্ভিদ সম্প্রদায়ের রত্ন বলা যায়। সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফাঁদ ব্যবস্থার অধিকারী ড্রসেরা উদ্ভিদগুলোকে ‘সানডিউ’ বলেও ডাকা হয়। কারন এদের পাতায় সরু কাঠির ন্যায় উপাঙ্গের মাথায় এক ধরণের আঠালো, হজম সহায়ক এনজাইম জমে থাকে। দেখে মনে হয় বিন্দু বিন্দু শিশির জমে আছে। রোদে ঝকমক করা এমন শিশিরভেজা উদ্ভিদ দেখে কারও মনেই কোনো খারাপ আশঙ্কা আসে না। আশঙ্কা পোকামাকড়দেরও আসে না। তাই তারা এগিয়ে আসে, আর আটকা পড়ে যায়। পাতার পৃষ্ঠে আঠালো গ্রন্থি থাকে যা পোকামাকড়দের আটকে ফেলে আর শিশির বিন্দুর ন্যায় এনজাইমগুলো পোকার দেহ হজম করে ফেলে। ড্রসেরা স্ব-পরাগায়ণ ও স্ব-নিষেক করতে সক্ষম।

প্রকৃতির বিচিত্র রাজ্যে নিঃসন্দেহে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এই মাংসাশী উদ্ভিদ সম্প্রদায়। তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এসএস

Wordbridge School
Link copied!