• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকাশনায় অদম্য এক নারী


হৃদয় আজিজ মার্চ ৮, ২০১৭, ০১:২৭ পিএম
প্রকাশনায় অদম্য এক নারী

শরীফা বুলবুল

ঢাকা: শিল্প-সাহিত্য বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ব্যবসা-বাণিজ্য রাজনীতি-নির্বাচন- কোথায় নেই আজ বাংলাদেশের নারীরা? কিন্তু অবাক করার মতো হলেও সত্য, ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে থাকলেও সৃজনশীল প্রকাশনা ব্যবসায় এতোদিন নারীদের উপস্থিতি ছিল একেবারেই নগন্য। সে ক্ষেত্রে অসীম সাহস নিয়ে এগিয়ে এসেছেন এক অদম্য সাহসিনী। তিনি শরীফা বুলবুল; বলাকা প্রকাশন-এর কর্ণধার।

শরীফা বুলবুল একাধারে সাংবাদিক, কবি ও গল্পকার। নেশা আর বাবার স্মৃতি ধরে রাখতেই দীর্ঘদিন জড়িত আছেন প্রকাশনা ব্যবসায়। যদিও সীমাহীন প্রতিকুল পথ পেরিয়েই তাকে আসতে হয়েছে এখানে। তবে কোনো বাধাই তাকে টলাতে পারেনি।

শরীফা বুলবুলের জন্ম চট্টগ্রাম জেলার ফতেনগর গ্রামে। বাবা মৃত নুরুচ্ছফা চৌধুরী ও মা ফরিদা খানম। পাঁচ সন্তানের মধ্যে শরীফা বুলবুল তৃতীয়। তিনি একজন কবি, সাংবাদিক, প্রকাশক ও লেখক। বর্তমানে দৈনিক ভোরের কাগজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে কাজও করছেন। 

দীর্ঘ দুই যুগব্যাপী প্রকাশনার পথ চলা নিয়ে সোনালীনিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন দেশে সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পে সামনে এগিয়ে থাকা শরীফা বুলবুল।

সোনালীনিউজ: দেশের অন্যসব পেশায় থাকলেও প্রকাশনা পেশায় নারীদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। নারীদের অচেনা এই পেশায় আপনি কীভাবে এলেন?
শরীফা বুলবুল: এটা আসলে ঠিক আমার পেশা নয়; বলতে পারেন এক ধরনের নেশা। কেন নেশা - এ কথার উত্তর দিতে হলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। বলাকা ছিল মূলত আমার বাবার প্রেসের নাম (বলাকা প্রিন্টিং প্রেস)। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে যেটি ছিল চট্টগ্রামে হাতেগোনা কয়েকটি প্রেসের একটি। প্রেসটি নিয়ে বাবার (প্রয়াত নুরুচ্ছফা চৌধুরী) অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন নানা কারণে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। বাবাকে দেখতাম সেই না-পারার কষ্টে এপাশ-ওপাশ করতে। পরবর্তীকালে তার অসুস্থতার কারণে প্রেসটি বন্ধই হয়ে যায়। বাবার অপূর্ণতার কষ্ট আমার ছোট্ট মনে বড়ো বেশি দাগ কাটে। বলা যায়, চিরস্থায়ীভাবেই কষ্টটা গেঁথে যায় বুকের ভেতর। নিজে যেহেতু লেখালেখি করি, অনেকটা সাহস নিয়ে বাবার ওই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেই ১৯৯৪ সালে বলাকা নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ করি। এভাবেই প্রকাশনায় আসা। তাই বলাকা আমার কাছে অনেক বড়ো একটি স্বপ্নের নাম। ওই স্বপ্নের ধারণাকে পরিচ্ছন্ন করতে গিয়ে কতো কষ্টের এপাশ-ওপাশ! নিজের অলংকারও বিক্রি করেছি। চট্টগ্রামের মতো ছোট শহরে ওই ছোট পত্রিকাকে নিয়ে বড় বড় কথা বলতে পারার মতো ছোট লোক আমি কম দেখিনি। তবু থেমে থাকিনি।

সাহিত্যিক আহমদ ছফা আমাকে উৎসাহিত করে এক দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন, এর শেষ একটি লাইন এরকম- ‘একবার যখন বেরিয়েছ পথে, থামবে না। মনে রাখবে তোমাকে অনেক দূর যেতে হবে।’ হয়তো থামবো না। তবে অনেক কষ্টে জেনেছি, কোনো কাজ সোজা নয়, সোজা করে নিতে হয়। বাবার স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখতে তাই আমি অবিরাম ছুটি। আমি এই বলাকাকে একটি পর্যায়ে দাঁড় করাতে চাই। পত্রিকাকে টিকিয়ে রাখতেই প্রকাশনায় এলাম। এটাকে পেশা নয়, নেশা বলতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করি আমি। আমার পেশা সাংবাদিকতা।

সোনালীনিউজ: এবার বাংলা একাডেমির বইমেলায় অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম কবে থেকে শুরু?
শরীফা বুলবুল: সেই ২০০৫ সালে শুরু। এরপর প্রতিবছরই বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশ নিয়ে আসছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রতিবারই ডবল স্টলের জন্য আবেদন করি, কিন্তু কোনোবারই পাই না। রহস্যটা কী, বুঝলাম না।

সোনালীনিউজ: নারী বলে এ পেশায় কেমন সমস্যায় পড়তে হয়?
শরীফা বুলবুল: কেবল নারী বলেই তো আমাকে এতো বাধার পাহাড় ঠেলতে হয়েছে এবং হচ্ছে। আর কিছু না পেরে এখানে সহজেই চরিত্রে কলঙ্কের কালি লেপন করা হয়। নষ্ট পুরুষদের ফিসফিসানি কানে বাজে। কিন্তু আমি জানি, চরিত্র গাছের কোনো ফল নয় যে, টুপ করে ঝরে পড়লেই সব শেষ হয়ে যাবে। এমনকি ২০১০ সালে আমার স্টল দখল পর্যন্ত করে ফেলে এক (প্রকাশক) দুর্বৃত্ত। সম্প্রতি আরেক দুর্বৃত্ত আমার প্রতিষ্ঠানই দখল করে ফেলেছে। ওতে ঘি ঢেলেছে এই শহরের বেশ কিছু প্রভাবশালী প্রকাশক এবং দুয়েকজন ডক্টরেট। তারা অবশ্য জানেন না, আসল সত্য কী। তাদের কাছে আমার সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছিলো। এর জন্য অনেক ভোগান্তি হয়েছে আমার। বই প্রকাশে পিছিয়ে পড়েছি। তবে আমি অনড় ছিলাম। কারণ, আমি জানি অন্যায় করিনি। আমার সব কাগজপত্র ঠিক ছিলো। যে কারণে বাংলা একাডেমি পাশে ছিলো। অর্থাৎ সত্যের পাশে ছিলো। এসব ‘কাজ’ একমাত্র মেয়ে বলেই করতে পেরেছে গায়ের জোরে। আমি অন্য মেয়েদের বলবো, কারো কথায় কান না দিয়ে এগিয়ে যেতে। লক্ষ্যে অনড় থাকতে। সততা এবং লক্ষ্য স্থির থাকলে কোনো বাধাই ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। সাময়িক অসুবিধায় ফেলে বটে, কিন্তু সৎ সাহসের পরাজয় নেই।

সোনালীনিউজ: পরিবার কিংবা কারো কাছ থেকে কোনো প্রেরণা পেয়েছেন কি?
শরীফা বুলবুল: প্রেরণাহীনতাই আমার প্রেরণা। তারপরও পরিবার থেকে যে সহযোগিতা পেয়েছি তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আমি যা কিছু করেছি অনেকটা জোর করেই করেছি, করছি। আমার স্বপ্ন পূরণ এবং লক্ষ্যে না পৌঁছানো অবধি এ লড়াই চলবে, চালিয়ে যাবো। আমি যে অদম্য, কোনো বাধাই আমাকে টলাতে পারবে না।

সোনালীনিউজ: বলাকা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কত?
শরীফা বুলবুল: এ পর্যন্ত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০০।

সোনালীনিউজ: বই প্রকাশ করতে গিয়ে কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়?
শরীফা বুলবুল: পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ধাক্কা প্রকাশনার মতো সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এ ধাক্কা সামলাতে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভীষণ বেগ পেতে হয়। যে কারণে অনেক সময় ভালো বই প্রকাশ করতে গিয়েও হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাছাড়া উপযুক্ত প্রণোদনা কিংবা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নারী প্রকাশকদের দেয়া হচ্ছে না। ঘুরে-ফিরে রাঘববোয়ালরাই পায়। পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে নারী উদ্যোক্তারা দাঁড়াবে কী করে?

সোনালীনিউজ: আপনার প্রকাশন কী ধরনের বই প্রকাশ করে? কেবল কি নারীদের বই প্রকাশ করা হয়?
শরীফা বুলবুল: প্রথমত বলি, আমরা হরে-দরে বই করি না, করবোও না। আমাদের যাত্রা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে মূলত তরুণদের নিয়েই। তরুণরাই আমাদের শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীপ্ত তরুণদের বই-ই আমরা বেশি প্রকাশ করেছি। সেক্ষেত্রে নারী লেখক আর পুরুষ লেখক বিবেচ্য নয়, লেখাটাই বিবেচ্য। তবে আমাদের প্রকাশের তালিকায় গবেষণাধর্মী বই কিন্তু কম নেই। এছাড়া কোনো মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক লেখকের জন্য বলাকা নিষিদ্ধ। সে নারী হোক আর পুরুষই হোক। চেতনাগত দিক থেকে এ বিষয়টির সঙ্গে আমরা আপস করি না, করবোও না।

সোনালীনিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
শরীফা বুলবুল: আমাদের যা কিছু পরিকল্পনা, সবই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মাথায় রেখেই নেয়া হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে এমন লেখকদের নিয়ে আমরা এগিয়ে যাবো। দেশ সমাজ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকবে না এমন লেখককে আমরা প্রত্যাখান করবো। এক্ষেত্রে কোনো আপস নয়।

সোনালীনিউজ: এ যাবৎ আপনার নিজের প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা কত? এ বছর আপনার কী বই বেরিয়েছে?
শরীফা বুলবুল: আমার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ১৫টি। এর মধ্যে কাব্য ৬টি, গল্পগ্রন্থ ১টি এবং সম্পাদিত গ্রন্থ ৭টি। এবারের বইমেলার জন্য নিজের ৬টি বই প্রকাশের প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু কাজের চাপে শেষ অবধি ‘বীরাঙ্গনা নয় মুক্তিযোদ্ধা’ বইটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। 

সোনালীনিউজ: কোন কোন বই প্রকাশের অপেক্ষায় আছে?
শরীফা বুলবুল: গল্পগ্রন্থ ‘পূর্ণিমা এখনও ভোটার হয়নি’, উপন্যাস ‘নীল রঙের পৃথিবী’ সাক্ষাতকারগ্রন্থ 'ভাষা আন্দোলনে বাঙলার নারী’, ইতিহাস ঐতিহ্যের বই ‘কান পেতে শুনি পুণ্ড্রনগর’, হুমায়ুন আজাদের জীবনী ‘অবিনাশী হুমায়ুন আজাদ’ প্রকাশের পথে। আগামী বই মেলায় এসব বই পাওয়া যাবে।

সোনালীনিউজ: এবারের মেলায় আপনার প্রকাশনী থেকে কতগুলো বই বেরিয়েছে?
শরীফা বুলবুল: ৪০টিরও বেশি।

সোনালীনিউজ: আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সোনালীনিউজের পক্ষ থেকে আপনাকে শুভেচ্ছা, অভিনন্দন।
শরীফা বুলবুল: আপনাকে ধন্যবাদ। সেই সঙ্গে সোনালীনিউজের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুন এই কামনা করছি।

সোনালীনিউজ ডটকম/ঢাকা/এআই

Wordbridge School
Link copied!