• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বাড়ছে উড়াউড়ি

প্রজাপতি তুমি পাখনা মেলো না!


নিয়ন মতিয়ুল নভেম্বর ২৫, ২০১৬, ০৭:৫৪ পিএম
প্রজাপতি তুমি পাখনা মেলো না!

ঢাকা: প্রজাপতি, রঙিন প্রজাপতি। নামটা শুনলেই মনটা কেমন উড়তে থাকে। রঙধনুর বিচিত্র রঙ ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ঘিরে ধরে। বড় অদ্ভুদ সে অনুভূতি। এর মধ্যেই আবার গুন গুন করে ওঠে মনটা। সেই যে সোনামনিদের গানটা- টুকটুকে লাল-নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা/ প্রজাপতি প্রজাপতি কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা..। কিংবা লতা মঙ্গেশকারের চিরচেনা সেই গানটা- ও প্রজাপতি প্রজাপতি পাখনা মেলো/ আমার এই মনের আঁধার কোণে কোণে, রঙে রঙে রঙ মশাল জ্বালো..।

সুর আর রঙ ছুঁয়ে যাওয়া প্রজাপতির পাখা। এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় শব্দ। তাহলেই মনে পড়ে সুকুমার রায়ের সেই কবিতাটা- এমন যদি হতো/ ইচ্ছে হলে আমি হতাম প্রজাপতির মতো/ নানান রঙের ফুলের পরে/ বসে যেতাম চুপটি করে/ খেয়াল মতো নানান ফুলের সুবাস নিতাম কতো...।

ছেলেবেলাটা বড্ড বেশি গেঁথে আছে ছন্দবদ্ধ এ শব্দগুলোর মধ্যে। তবে নির্মলেন্দু গুণের ‘সেই প্রজাপতি’ পড়তে গিয়ে বড়বেলাটাও যে এসে ধাক্কা দেয়- রূপান্তরে পুড়িবে তোর ক্লান্ত দু’টি ডানা/ চিত্রিত নয় কালো রঙের পৃথিবী একটানা/ আমি কেবল আমি কেবল/ আমি কেবল দেখি/ ভালোবাসার দেয়াল জুড়ে/ একটি প্রজাপতি...।

এতো গেল স্বপ্নের কথা। ছেলেবেলার স্বপ্নময় পৃথিবীর কথা। তাহলে কি গদ্যময় পৃথিবীতে নেই প্রজাপতি? হ্যাঁ তাও আছে। রবীঠাকুরও যে লিখেছেন- ...সন্ধ্যাবেলা বাতির আলোয় অকস্মাৎ/ ঘরে ঢুকে সারারাত/ কী ভেবেছে কে জানে তা-/ কোনোখানে হেথা/ অরণ্যের বর্ণ গন্ধ নাই,/ গৃহসজ্জা ওর কাছে সমস্ত বৃথাই/ বিচিত্র বোধের এ ভুবন/ লক্ষকোটি মন/ একই বিশ্ব লক্ষকোটি করে জানে/ রূপে রসে নানা অনুমানে...।

বিচিত্র বোধের এ ভুবনে রূপে-রসে নানা অনুমানে আমাদের ঘরে আসে প্রজাপতি অতিথি। হোক সে অরণ্যের কাছে কিবা দূরে কিংবা যান্ত্রিক কোলাহলে। মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয়, ছেলেবেলাকার স্বপ্নের পৃথিবীর স্পর্শ দিয়ে যায়।

খোলা আকাশ ছেড়ে, সবুজ মাঠ পেরিয়ে আমাদের ঠাঁই নিতে হয়েছে যান্ত্রিক শহরে। তবে ভুলতে তো পারিনি প্রজাপতির ডানা, প্রজাপতিমাখা দিন। তাই তো বিচিত্রবর্ণের এ সঙ্গিটিও আমাদের পিছু নিয়েছে। উড়ে উড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে এসেছে। আমাদের ক্লান্তি কিংবা বিষণ্ণতার অবসান ঘটাতে। আশ্রয় নিয়েছে কৃত্রিম ফুলেল উদ্যানে, ছাদের বাগানে কিংবা হঠাৎ দেখা ঝোপে ঝাড়ে।

লোভ, হিংসা, জিঘাংসাময়তা নির্মুল করে সভ্যতা নির্মাণে চেষ্টায় রঙিন প্রজাপতি আমাদের স্বপ্নযাত্রার সঙ্গী। সুন্দরের সঙ্গী। তাই তো দেখা যায় প্রজাপতি মেলা। প্রকৃতি প্রেমিকদের ভালোবাসা আর ভরসায় বিলুপ্তির আশঙ্কামুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখে রঙিন প্রজাপতিরা। দিন দিন আমরাও সদয় হচ্ছি প্রজাপতির প্রতি। হয়তো ঠেকাতে চাই প্রজাপতির প্রতিকূলতা। বাঁচাতে চাই ওদের। সুন্দর পৃথিবীর বড় উপাদান ওরাও।

বেশ কিছুদিন হলে প্রজাপতি নিয়ে কেমন আলোচনা বেড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কেউ বলছেন ঢাকা শহরে প্রজাপতি বেড়ে যাচ্ছে। কেউ বলছেন রাত নেই দিন নেই প্রজাপতি উড়ছে। এসব আলোচনা কি প্রজাপতির সুসংবাদ না দুঃসংবাদ? পরিবেশ দূষণ, আবাসন ক্ষতিগ্রস্তসহ কত বিপদ এ প্রাণিটির। দিন দিন তো উঠছে বিলুপ্তির তালিকায়। এর মধ্যে যান্ত্রিক এ শহরে প্রজাপতির বেশি উড়াউড়ি কিছুটা ভাবনায় ফেলে দিচ্ছে বটেই।

গত ২২ নভেম্বর সাংবাদিক Mahmuda Akhter তার ফেসবুক পেইজে লিখেছেন, ‘যান্ত্রিক এই শহরে হঠাৎ করেই প্রজাপতি বেড়ে গেছে কেন কে জানে! সবুজ নাই-ফুল নাই-লতা নাই -পাতা নাই বেচারীরা কি করে! শেষে কাচের জানলা গলে ঢুকে পড়ে কংক্রিটের বাড়িগুলোতে। এরপর কি? এরপর মৃত্যু। আজও একটা মরে পড়ে আছে আমার মোজাইক মেঝেতে।’

এই স্ট্যাটাসে কমেন্ট করেছেন অনেকেই। আরেক গণমাধ্যমকর্মী ‘ইরতাজ মৌ’ লিখেছেন, ‘আমি প্রতিদিন ৮-১০ প্রজাপতি দেখি’। আবার Nurun Nahar Lilian লিখেছেন, ‘হুম আপু সত্যি। বুঝলাম না অনেক প্রজাপতি আমার বাসায় ও’। Badrul Amin লিখেছেন, ‘প্রজাপতিরাও ভালো মন্দ খুঁজে বেড়ায়। দেখে কংক্রিটের মানুষগুলোর মন কংক্রিট হয়ে গেছে কিনা’। Shahnaz Poly লিখেছেন, ‘আমিও বিষয়টা আন্দাজ করছি’।

আবার একই স্ট্যাটাসে কমেন্ট করেছেন Ratan Pronoy. তিনি লিখেছেন, ‘এটা আমার বাসাতে ঘটছে। টিকটিকির পেটের খাবার হচ্ছে, না হয় পাখার আঘাতে মরছে’।

ছাদে চিলেকোঠায় বসবাস করেন আরেক সিনিয়র সাংবাদিক শরীফা বুলবুল (Sharifa Bulbul)। তার ছাদ জুড়ে টবে লাগানো বাগান। ইদানিং দেখছেন প্রজাপতির উড়াউড়ি বেড়ে গেছে। রাতেও আনাগোনা হয় ঘরে। তিনিও ভাবছেন শীত আসছে তাই হয়তো প্রজাপতির কর্মতৎপরতা বেড়ে গেছে। তবে চিন্তিত হয়ে পড়েন যখন রাতে ঘরে চলে আসে নানা রঙের প্রজাপতি।

মনজিৎ মিত্রের হাতে প্রজাপতি

গত ২৪ নভেম্বর মধ্যরাতে সাংবাদিক Monojit Mitra- এর ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে প্রজাপতি। বেশ অবাক হন তিনি। নির্ভয় প্রজাপতির ছবিটা ফেসবুকে পোস্ট দেন। লিখেছেন, ‘মাঝরাত্তিরে আঙুলে এসে বসলো প্রজাপতি’।

শীত জেঁকে বসছে প্রকৃতিতে। চারদিকে ফুটছে নানা ফুল। মধু খেতেই হয়তো উড়াউড়ি বেড়েছে প্রজাপতিদের। তাই বলে, একেবারে যান্ত্রিক শহরে এ দস্যিপনা কেমন বেমানান লাগে। তাই তো অবাক অনেকেই। দস্যিপনা নাকি বিপদাপন্ন- জানা নেই তো আমাদের। ডানায় রাতের শিশির জমে ওরা তো মারাও পড়তে পারে। কিংবা ধেড়ে কীটপতঙ্কের আহার হয়ে যেতে পারে।

সুদর্শন প্রজাপতি ঘুরে বেড়ায় গাছে গাছে, বন কিংবা ঝোঁপ-ঝাড়ে। ডিম পাড়ে নির্দিষ্ট গাছে। আর পান পান করতে ছুটে যায় পাশের খাল-বিলে। কিংবা ঢাকা শহরে তো কোনো খালবিল নেই। তাহলে কোথায় থাকে এসব প্রজাপতি। আবাস ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভরাট করা হয়েছে খাল-নদী। দূষিত হয়ে পড়েছে পানি। তাই রঙিন পাখার ওড়াউড়ি অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে গেছে। ‘সুন্দরবনের কাক’ নামে পরিচিত প্রজাপতি চলে গেছে তাই অতি বিপন্নের তালিকায়। এ তালিকায় আছে সোনালি পাখার ‘কনকচাপা’, সাদা বাঘ ‘সুষমা’ রঙিন গোলাপ ‘আলসিন্দুরা’ কমনবার্ড ‘সোনাল’।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক মনোয়ার হোসেনের মতে (যিনি প্রজাপতি মনোয়ার নামে পরিচিত) বিলুপ্তির হুমকির তালিকায় রয়েছে দেশের ১৮৮টি প্রজাপতি। এর মধ্যে একটি প্রজাতি মহাবিপন্ন তালিকায় আর ১১২টি বিপন্ন। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ৭৫টি প্রজাতি।

বাংলাপিডিয়ায় প্রজাপতি: প্রজাপতি Lepidoptera বর্গের দিবাচর, বড় আকারের আকর্ষণীয় রঙের পতঙ্গ। মথের মতো এদেরও আছে প্যাঁচানো শুঁড়ের মতো মুখোপাঙ্গ। শুঙ্গ ক্লাভেট (clavate) ধরনের। সাধারণত প্রজাপতির শরীর লম্বাটে, উজ্জ্বল রঙের, ওড়ে দিনের বেলা। কোনো কোনো প্রজাপতি একটি এলাকা নিয়মিত পাহারা দেয়। নিজ প্রজাতির অন্যান্য সদস্য বা অন্য প্রজাতির প্রজাপতির অনুপ্রবেশ ঠেকায়। প্রজাপতিরা অনেক জাতের ফুলের পরাগযোগ ঘটায়। তারা সৌন্দর্যের জন্যও নন্দিত এবং মূল্যবান পণ্য। পৃথিবীর কোথাও কোথাও প্রজাপতি পূর্ণাবস্থায় ও লার্ভা পর্যায়ে খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিছু প্রজাপতি ফল ও ফসলের ক্ষতিকর পতঙ্গের দলভুক্ত। প্রজাপতিরা সাধারণত ১২টি গোত্রে বিভক্ত। বাংলাদেশে এদের প্রায় ১২৪টি প্রজাতি রয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার চির-সবুজ ও আধা-চিরসবুজ বন এবং মধুপুরের পত্রমোচী বনে এদের প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়।

জাবিতে প্রজাপতি মেলা

প্রজাপতি মেলা: ‘উড়লে আকাশে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে গেল ৪ নভেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তমবারের মতো উদ্বোধন করা হয় প্রজাপতি মেলা-২০১৬। প্রজাপতি সংরক্ষণে গণসচেতনতা বাড়াতে প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ২০১০ সাল থেকে ক্যাম্পাসে প্রজাপতি মেলার আয়োজন করে আসছে। 

সোনালীনিউজ/এমএন

Wordbridge School
Link copied!