• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশ্নের মুখে কিছু ক্রিকেটারের তারকাখ্যাতি


ক্রীড়া প্রতিবেদক জানুয়ারি ২৪, ২০১৭, ১০:২৩ পিএম
প্রশ্নের মুখে কিছু ক্রিকেটারের তারকাখ্যাতি

ঢাকা: গ্রাম থেকে শহর দেশের সব প্রান্তেই কিশোর বয়সী ছেলেরা ব্যাট-বল হাতে দৌড়াচ্ছে যত্রতত্র। রাখাল বালকটিও মাটির ঢেলা নিয়ে হাত ঘুরিয়ে বোলিংয়ের সাধ মেটাতে চায়। ক্রিকেট যেন বাঙালি জাতির আবেগ-অনুভূতি ও আশা-আকাঙ্ক্ষার এক বিশাল ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশদের আবিষ্কার এই ইংরেজ নামীয় খেলাটি বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। বিশ্বের কোটি কোটি ক্রিকেট প্রেমীদের নজর লাল সবুজের দেশের দিকে। কারণ, এই দেশে আছে বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। আছেন কার্টার মাষ্টার খ্যাত মোস্তাফিজুর রহমান। বাংলাদেশের ক্রিকেট যখন তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় কয়েকজন ক্রিকেটার বিতর্কের জন্ম দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে একটা নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে! সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন ক্রিকেটারের কর্মকাণ্ডে ম্লান হচ্ছে টাইগারদের গৌরব গাঁথা সাফল্য।

অর্থ, প্রতিপত্তি আর তারকা খ্যাতির ভার সইতে না পেরে একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন একাধিক ক্রিকেটার। এতে বিশ্বে মর্যাদা হারাচ্ছে বাংলাদেশ। অতি সম্প্রতি দেশের তিন জন ক্রিকেটারকে বিভিন্ন অভিযোগে কারাবরণ করতে হয়েছে। সর্বশেষ সেই তালিকায় যোগ হয়েছেন জাতীয় দলের বাঁহাতি স্পিনার আরাফাত সানি। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেছেন নাসরিন সুলতানা নামের এক তরুণী। ওই মামলায় গ্রেপ্তার এখন কারাগারে।

সানির স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়া সেই তরুণীটি তার অভিযোগে বলেছেন, ফেসবুক মেসেঞ্জারে তাদের কিছু অন্তরঙ্গ ছবি পাঠিয়ে তাকে হুমকি দিয়েছেন এই ক্রিকেটার। তবে সানি এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

উল্লেখ্য, গত ২২ জানুয়ারি তথ্য প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় জাতীয় দলের ক্রিকেটার আরাফাত সানিকে। আদালত ওই দিনই তার এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রবিবার দুপুরে তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম প্রণব কুমার হুই এর আদালতে উপস্থিত করে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই মো. ইয়াহিয়া পাঁচ দিনের রিমান্ড চাইলে এ আদেশ দেন আদালত। মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) তার জামিন আবেদন নাকচ করে দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম মো. জাকির হোসেন টিপু এই নির্দেশ দেন।

এর আগে জাতীয় দলের আরেক ফাস্ট বোলার রুবেল হোসেন তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন দমন আইনে করা এক তরুণীর মামলায় জেল খেটেছেন। গৃহকর্মীকে নির্যাতনের অভিযোগে আরেক ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেনকে জেলে যেতে হয়েছিল। তবে ওই মামলার বাদী পরে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিলে তিনি ছাড়া পান।

২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর মিরপুর মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে পেসার রুবেল হোসেনকে আসামি করে মামলা করেন এক তরুণী। ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি রুবেল আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। দুই দিন কারাগারে থাকার পর তিনি মুক্তি পান ১১ জানুয়ারি। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা পেছনে ফেলে রুবেল অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছেন। ভালো খেলে নিয়মিত হয়েছেন জাতীয় দলে।

শাহাদাত হোসেনের ঘটনা কিছুটা ভিন্ন। ২০১৫ সালের মে মাসে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টে চোটে পড়ে দল থেকে ছিটকে পড়েন এই পেসার। পুনর্বাসন চলার সময়ই কারাগারে যেতে হয় তাঁকে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের মামলা হয় শাহাদাত ও তাঁর স্ত্রী জেসমিন জাহানের বিরুদ্ধে। এই মামলায় দুই মাস আট দিন জেল খেটে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর জামিন পান শাহাদাত। গত বছরের ৬ নভেম্বর গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলায় শাহাদাত ও তাঁর স্ত্রীকে খালাস দেন নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল। তার আগে বিসিবি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় সর্বশেষ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরেছেন শাহাদাত।

২০০৭ সালে জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ও বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ওয়ান্ডে সেঞ্চুরিয়ান মেহরাব হোসেন অপি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। অপির প্রথম স্ত্রী সাদিয়া হোসেন রুমনি দায়ের করা নারী ও শিশু নির্যাতন এবং আফজালুর রহমান নামে অপর ব্যক্তির প্রতারণা ও চুরির মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন অপি।

বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেন, ক্রিকেটারদের নৈতিক স্খলন নিয়ে আমরা চিন্তিত। তিনজন খেলোয়াড় যে জেলে গেছে, বিসিবি সেটা দেখেছে। যারা অন্যায় করেছে তারা শাস্তি পাবে। আগেও যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে, সে গুলোতে বিসিবি কিন্তু ছাড় দেয়নি। তাদের অনেক টাকা পর্যন্ত জরিমানা করেছে বিসিবি।’

ক্রিকেটারদের এসব বিতর্ক নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান বলেন, এসব ঘটনা ক্রিকেটকে লজ্জায় ফেলছে। বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা ক্রিকেটাররা অনেকে অল্প বয়েসে খ্যাতি ও প্রচুর অর্থ পেয়ে যাচ্ছে। অনেকে এই সাফল্য ম্যানেজ করতে পারে না, নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা।

তিনি আরো বলেন, ‘ক্রিকেট এত জনপ্রিয় হয়ে গেছে যে ক্রিকেটারদের পেছনে মেয়েরা দৌড়াচ্ছে, ছেলেরা দৌড়াচ্ছে এই হাতছানির মধ্যে নিজেদের সামলে রাখা, এটা অনেকে অনেক সময় পারে না’। ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে আচরণবিধি আছে, কিন্তু তারকাখ্যাতি পাওয়ার পর তার ব্যক্তিগত জীবনে সচেতন থাকা প্রয়োজন আছে, তাই এজন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকা উচিত।

বিসিবির পরিচালক জালাল ইউনুস বলেন, খেলোয়াড়দের জন্য আচরণবিধি আছে যা তারা মেনে চলে। কিন্তু অফ-দ্য-ফিল্ড বা মাঠের বাইরের কোনো কার্যকলাপ যদি আচরণবিধির আওতায় পড়ে তাহলে বোর্ড এ্যাকশন নেয়। অতীতেও তাই হয়েছে।

তবে এসব পদক্ষেপ বা প্রশিক্ষণ দিলেই যে এমন আর ঘটবে না, তা মনে করেন না অনেকেই। সাবেক ক্রিকেটার মিনহাজুল আবেদীন মনে করেন, একজন তারকাকে নিজের মর্যাদার ব্যাপারে নিজেকেই সচেতন থাকতে হবে। ভাবতে হবে দেশের কথা। কারণ, দেশই তাকে অর্থ খ্যাতি এনে দিয়েছে। তাই সবার আগে দেশের মর্যাদার কথা ভাবতে হবে।

বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান এবং জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘তারা এসব করে কেন? তারা কী জানে না, তারা কে? তারা তো এ দেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। তাদের এমন নির্লজ্জ্ব ঘটনায় পুরো দেশই বিব্রত হয়। যখন ঘটনা ঘটায়, তখন তারা কী মনে রাখে না, এ দেশের মান-সম্মান, ইজ্জত অনেক কিছুই জড়িত তাদের সাথে!’

তিনি বলেন, ‘বিসিবি অ্যাকাডেমির কাজটা কী? সেখানে ক্রিকেটারদের কী শেখানো হয়? তারা কী সেখানে নৈতিকতার কোনো কিছুই শেখে না! বিসিবিরও উচিত, একাডেমিতে ক্রিকেটারদের নৈতিকতার বিষয়টি শেখানো। কারণ, ক্রিকেটারদের হাতে ব্যাট-বলই শোভা পায়, হাতকড়া নয়।’

বিসিবির পরিচালক ও সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান আরাফাত সানির গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনাগুলো যখন ঘটায়, তখন কী মাথায় থাকে না, তারা এ দেশের আইকন! তাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের মান-সম্মান, সব কিছু!’ তিনি সঙ্গে সঙ্গে কঠোর বাণীও উচ্চারণ করেছেন, ‘এ ধরনের ঘটনায় বিসিবিও কখনও তাদের পাশে থাকবে না। বরং, দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।’

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআই

Wordbridge School
Link copied!