• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
২০১০ সালের পদধ্বনি!

ফের ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে দেশের পুঁজিবাজার


শেখ আবু তালেব জানুয়ারি ১৭, ২০১৭, ১১:৪৮ এএম
ফের  ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে দেশের পুঁজিবাজার

ঢাকা: একটানা কয়েক মাস ধরেই দেশের পুঁজিবাজারে উর্ধ্বমুখি লেনদেন হচ্ছে। মূল্য সূচকগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গড় লেনদেন হচ্ছে হাজার কোটি টাকার উপরে। বিষয়টি বাজারের জন্য ভালো হলেও কোনো কারণ ছাড়াই দুর্বল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কিছু কোম্পানির শেয়ার দর বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন বিশেষজ্ঞরা। বাজারে টাকার প্রবাহ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকাকে অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন তারা। বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকেও ভাবিয়ে তুলছে। এটিকে ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধ্বসের পূর্ববর্তী সময় কি-না তা নিয়ে চলছে আলোচনা।

বর্তমানে আমাদের পুঁজিবাজার জাতীয় অর্থনীতিতে মোট জিডিপির এক পঞ্চামংশ অর্থ্যাৎ বিশ শতাংশের মতো। পার্শ্ববর্তী দেশে ভারতে যা প্রায় ৭০ শতাংশের মতো। আগামী তিন বছর অর্থ্যাৎ ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার জিডিপির ৫০ শতাংশ হবে বলে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কে এ এম মাজেদুর রহমান। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫০ শতাংশ পুঁজিবাজার অবদান রাখবে বলে মনে করেন তিনি।

গত ৮ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে মাজেদুর রহমান বলেন, ৭ শতাংশ জিডিপিতে বর্তমানে পুঁজিবাজারে অবদান ২০ শতাংশ। আগামী তিন বছর পর এ অবদান বেড়ে হবে ৫০ শতাংশ। এই লক্ষ্যে ডিএসই কাজ করছে। কিসের ভিত্তিতে তিনি এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সাংবাদিকদের এমন জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বর্তমানে ৭ শতাংশের উপরে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে আমাদের দেশের জিডিপি ৮-৯ শতাংশে বৃদ্ধি করতে হবে। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে বিদেশি কিছু ও বহুজাতিক কিছু কোম্পানি পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার চেষ্টা করবো।

পুঁজিবাজার সবচেয়ে স্পর্শকাতর একটি জায়গা। বর্তমানে ভালো কোম্পানি ও নিয়মিত ভালো লভ্যাংশ প্রদানকারী কোম্পানির সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। যে কয়েকটি কোম্পানি বেশি লভ্যাংশ ঘোষণা করে, তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার একেবারেই নগণ্য। যেমন গত বছর ৩৭০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণাকারী বার্জার পেইন্টসে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার রয়েছে এক শতাংশেরও কম। অর্থ্যাৎ মাত্র ০.৪৯ শতাংশ। এমন অবস্থায় ডিএসই এমডির এ ঘোষণাকে বাজার কারসাজিদের উৎসাহিত ও বিনিয়োগকারীদের ভুল পথে পরিচালিত করেত পারে বলেই মনে করছেন অনেকে।

সর্বশেষ রোববার (১৫ জানুয়ারি) সপ্তাহের প্রথম দিনে দেশের প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। এর আগের দিন হয়েছে এক হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টকে লেনদেন হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক কোম্পানি বিশেষ করে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা খাতের কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে। অভিহিত শেয়ার দরে থাকা অনেক ব্যাংকের শেয়ার বেড়েছে উল্লেখ করার মতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই ৫৫ কোটি পরিশোধিত মূলধন নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রি গত কয়েক বছর ধরেই বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। তারপরেও সাম্প্রতিক সময়ে কোনো কারণ ছাড়াই দুর্বল মৌল ভিত্তির কাম্পানিটির শেয়ারের দাম ৩১ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে ১০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার ১৪ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে।

অস্বাভাবিকভাবে দর বৃদ্ধি হয়েছে জিলবাংলা সুগার, শ্যামপুর সুগার, মেঘনা কনডেন্স মিল্ক, মেঘনা পেট, ইমাম বাটন, ফাইন ফুডস ও বিডি অটোকার্স। আরও বেড়েছে স্টাইল ক্র্যাফট, আজিজ পাইপ, কাসেম ড্রাইসেল, দেশ গার্মেন্টস, শাহজিবাজার পাওয়ার, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক, সোনালী আঁশ, অ্যাপেক্স স্পিনিং, মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিস ও খুলনা পাওয়ার কোম্পানির। এর পাশাপাশি বেশ কিছু লোকসানী কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে।

বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কোম্পানিগুলোর কাছে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আছে কি-না তা জানতে চেয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন(বিএসইসি)। ফলাফল শূন্য। সব প্রতিষ্ঠানই চিঠির উত্তরে বলেছে তাদের কাছে মূল্য সংবেদনশীল কোনো তথ্য নেই। তাহলে এসব কোম্পানির শেয়ার দর কেন বাড়ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বোদ্ধা-মহলে। শেয়ার কারসাজিকারকদের ভূমিকা আছে, এমন কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বড় কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউস ও বরাবরই কারসাজির সঙ্গে জড়িত কয়েকজন বড় বিনিয়োগকারী মিলে এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। নিজেরাই আঁতাত করে এসব কোম্পানির শেয়ার দর বাড়িয়ে চলেছেন। এক নিজেদের সিন্ডিকেটের আওতার বাইরের বিনিয়োগকারি পেলেই চড়া দামে শেয়ার সেল করে দিবেন। এভাবেই চলছে নানা-মুখি ষড়যন্ত্র। আইনের ফাঁক গলিয়ে শেয়ার লেনদেন করতে কোনো নিয়মেরই তোয়াক্কা করছে না। এরফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে শেয়ারবাজার।

অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞারা বলছেন, পুঁজিবাজার নিয়ে ইতিবাচক প্রচারণা করতে হবে। কিন্তু উচ্চাভিলাষী কথা বাজারের জন্য কোনোভাবেই ভালো নয়। কোনো কিছু অর্জনের আগে নয়, অর্জন করার পরে তা বিনিয়োগকারীদের বলতে হবে। তাহলে বাজারের প্রতি আস্থা বাড়বে। বর্তমানে বাজার ভালো হলেও, এ অবস্থাকে স্থিতিশীল বলা যাবে না। আরও কয়েক মাস একই গতিতে চলতে থাকলে মূল্যায়ন করার মতো পরিবেশ হতে পারে। তবে বাজার যেভাবে দ্রুতগতিতে বাড়ছে তা উদ্বেগজনক।
সর্বশেষ ১৬ জানুয়ারি উর্ধ্বমুখি বাজার নিয়ে স্টেকহোল্ডার সঙ্গে আলোচনায় বসতে হয়েছে বিএসইসিকে। সভায় ডিএসই, সিএসই, ডিবিএ এবং বিএমবিএর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের বিষয়ে এসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, আমরা বিনিয়োগকারীদের সতর্কতার সঙ্গে লেনদেনের অনুরোধ জানিয়েছি। আমাদের মনে হচ্ছে বাজার ওভার ভ্যালুয়েডে হয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে বিনিয়োগকারী এবং হাউজগুলোকে সতর্ক অবস্থানে যাওয়া দরকার। আমরা বাজারের স্থায়ী স্থীতিশীলতা চাই। এজন্য এই মুহূর্তে বিনিয়োগকারীদেরও সতর্ক অবস্থানে যাওয়া উচিত।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো কোম্পানির শেয়ার দর, তাদের মৌল ভিত্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়া মানেই হলো এখানে সন্দেহযুক্ত কিছু আছে। যা কারসাজিকে উদ্বুদ্ধ করে। তারা বলছেন, ২০১০ সালের পূর্বেও বাজারের একই আচরণ করেছিল। তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থাও পাইকারি হারে ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সারা দেশে শাখা খোলার অনুমোদন দিয়েছিল। পরোক্ষভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে। লাভের আশায় অনেক চাকরিজীবী পেনশনের টাকা পর্যন্ত খাটিয়েছিলেন এ বাজারে।

বহু বেকার চাকরি খোঁজা বাদ দিয়ে সংসার চালিয়েছিলেন এ বাজারে বিনিয়োগ করে। পরবর্তীতে বাজার ধ্বসে পথে বসেছিলেন সহস্র বিনিয়োগকারী। সহায়-সম্বল হারিয়ে বেশ কয়েকজন আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছিলেন। এজন্য বাজার ধ্বসের আগেই নজরদারী বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাজার সংশ্লিষ্ঠ সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সোনালীনিউজডটকম/আতা

Wordbridge School
Link copied!