• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বন্ধ হচ্ছে নেতা তৈরির পথ


সুজন আকন, নিজস্ব প্রতিবেদক মার্চ ৯, ২০১৭, ১০:৫২ পিএম
বন্ধ হচ্ছে নেতা তৈরির পথ

ঢাকা: সেই বায়ান্ন থেকে একাত্তর- এরপর নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানসহ দেশ ও জাতির যে কোনো সঙ্কটে রাজপথ কাঁপানো প্রতিবাদী ছাত্রদের বজ্রমুষ্ঠি আর স্লোগানের আওয়াজ পাওয়া যায় না। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাইলফলক হয়ে থাকা ছাত্ররাজনীতিও আজ উধাও। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলারও কেউ থাকছে না।

নেতৃত্ব চর্চার কোনো সুযোগ না থাকায় ছাত্ররা দিন দিন হারিয়ে ফেলছে তাদের অধিকার সচেতনতা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার শক্তিও তারা হারিয়ে ফেলছে। এভাবে দক্ষ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক নেতা তৈরির পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে দেশে ছাত্র রাজনীতি অনুপস্থিত। সে কারণে দেশ ও জাতির স্বার্থে বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তর, সত্তর, একাত্তর ও নব্বয়ের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে জেগে উঠতে পারছে না ছাত্ররা। তাদের মতামত, ঐক্যবদ্ধ ছাত্র নেতৃত্বের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজন ছাত্র সংসদ। এর ফলে সৃষ্টি হবে মুক্ত রাজনীতি চর্চার পরিবেশ ও পরিস্থিতি। আর তাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি হবে। অনিবার্য হয়ে উঠবে জঙ্গিবাদসহ দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মুক্তি সংগ্রামের চেতনাবিরোধী শক্তির পতন।

সূত্রমতে, বিগত আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের কোথাও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। এর মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদেই (ডাকসু) নির্বাচন নেই ২৭ বছর ধরে। এছাড়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চাকসু) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাকসু) নেই নির্বাচন। আর গেল ২৫ বছর ধরে নিষ্ক্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু)। এক বছর পরপর নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও গেল দুই দশক ধরেই শীর্ষ চার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই অবস্থা যাচ্ছে দেশের অন্যান্য সরকারি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

সাবেক ও বর্তমান ছাত্রনেতা ও শিক্ষাবিদরা বলছেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ থাকায় ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বের বিকাশ, গণতন্ত্র ও সংস্কৃতিচর্চায় ব্যাঘাত ঘটছে। এমনকি শিক্ষার মান বৃদ্ধি, গবেষণা, উন্নত খাবার, আবাসন সমস্যাসহ শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় নিয়েই কথা বলার কেউ নেই।

অভিজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত ছাত্র রাজনীতিকে হত্যা করে জ্ঞান- মেধা-যুক্তিতর্কের পরিবর্তে অস্ত্রের রাজত্ব কায়েম করার কারণে ক্যাম্পাস ভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দুষ্ট রাজনীতির চক্রে পড়ে মেধাবীরা যখন হারিয়ে ফেলে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তখনই ছাত্ররাজনীতি নিয়ে সমাজে তৈরি হয় নেতিবাচক ধারনা। এ কারণে ধীরে ধীরে মেধাবী ছাত্রদের রাজনীতি জড়ানোর ঘটনা হয়ে ওঠে পরিবার ও সমাজের চোখে অনাকাঙ্ক্ষিত।

তবে অভিযোগ রয়েছে, ছাত্ররাজনীতির নামে ছাত্রদের দিয়ে অস্ত্রের রাজত্ব কায়েম করে সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা। গণতান্ত্রিক উপায়ে সংসদ নির্বাচন হলে তাদের রাজত্ব হারাতে হতে পারে- এ আশঙ্কায় অনেকেই নির্বাচন বন্ধ রাখার পক্ষে মতামত দেন। কেননা, তারা কিছুতেই চান না ছাত্রদের সুসংগঠিত ও কেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াক।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ছাত্ররা কিছুতেই সংঘবদ্ধ হচ্ছে না। কারণ তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা জাগানো যাচ্ছে না। এর কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই। স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক চর্চা না থাকায় সাংস্কৃতিক চর্চাও মুখ থুবড়ে পড়েছে।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতামত হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের লালনভূমি, এই লালন শ্রেণিকক্ষে হয় না। এজন্য চাই ছাত্র সংসদ, যাতে শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবন গঠনের সুযোগ পায়। ছাত্র সংসদ না থাকায় দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগৎ নেতৃত্বশূন্য হচ্ছে।

ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, লাঠিপেটা করে যে শিক্ষা দেয়া হয় সে শিক্ষা কখনোই একজন মানুষকে প্রকৃত শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলতে পারে না। দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে হবে, তাদের সহপাঠ্য কার্যক্রমকে উন্নত করতে হবে। আর সেজন্যই ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাই। ছাত্রদের কেন্দ্রীভূত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র নেতৃত্ব যেমন প্রতিষ্ঠা পাবে; তেমনি ভবিষ্যৎ নেতৃত্বও তৈরি হবে।

ডাকসুর প্রাক্তন আরেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ বলেন, আমার বিশ্বাস মুক্ত রাজনীতি চর্চার পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে জঙ্গিবাদসহ দুর্নীতি ও সন্ত্রাস এবং মুক্তি সংগ্রামের চেতনা বিরোধী শক্তির পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে। তবে বর্তমানে দেশে ছাত্র রাজনীতি অনুপস্থিত। এ কারণে দেশ ও জাতির স্বার্থে সেই ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭০, ৭১ ও ৯০-এর মতো ঐক্যবদ্ধভাবে জেগে উঠতে পারছে না ছাত্ররা। তবে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র নেতৃত্বের জন্য ছাত্র সংসদ দরকার।

অভিজ্ঞ মহলের ধারনা, এভাবে নেতা তৈরি পথ বন্ধ বন্ধ হয়ে গেলে আগামীতে যোগ্য নেতা পাওয়া যাবে না। এতে রাজনীতিতে পেশিশক্তি আর অর্থবাণিজ্যের দাপট বাড়বে। রাজনীতিশূন্য হয়ে পড়লে জাতি পথ হারিয়ে অন্ধকারের দিকে পা ফেলবে।

সোনালীনিউজডটকম

Wordbridge School
Link copied!