• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
গেট খুলে দিয়েছে ভারত

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, বাড়ছে বানভাসিদের কষ্ট


নিউজ ডেস্ক জুলাই ১১, ২০১৭, ১১:১৩ এএম
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, বাড়ছে বানভাসিদের কষ্ট

ঢাকা : উজানের পাহাড়ি ঢল ও অভিরাম বর্ষণের ফলে দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। আরও অবনতির আশঙ্কা করছেন বন্যা কবলিতরা। বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে ভাঙন। বন্যার পানি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়ায় তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম ডুবে যাওয়ায় মানুষ বাঁধে ও বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ আশ্রয় নিলেও খাবার বিশুদ্ধ পানি ও ত্রাণের চরম সঙ্কট বিরাজ করছে। বিভিন্ন বন্যাকবলিত এলাকায় ভয়াবহ ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

ভারিবর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩২ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল সোমবার (১০ জুলাই) দুপুরে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৭২ সেন্টিমিটার। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩২ সেমি উপরে।

পানিবৃদ্ধি পাওয়ায় তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলো বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় ১৫-২০ হাজার পরিবার পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্র জানায়, ভারত গজল ডোবা ব্যারেজের অধিকাংশ গেট খুলে দেয়ায় গত রোববার রাতে তিস্তার পানি প্রবাহ হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। যা গতকাল সকাল ৬টায় বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার উপরে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়। পরবর্তী ৩ ঘণ্টা পর বেলা ১২টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৭২ সেমি। যা বিপদসীমার ৩২ সেমির উপর দিয়ে বইছে।

পাটগ্রাম উপজেলায় অবস্থিত বহুল আলোচিত বিলুপ্ত ছিটমহল আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম, হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিঙ্গিমারী, সির্ন্দুনা, পাটিকাপাড়া ও ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নের চর, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, সদর উপজেলার রাজপুর, খুনিয়াগাছ, গোকুন্ডা ইউনিয়ন ও কালীগঞ্জ উপজেলার চরাঞ্চলের এলাকার প্রায় ১৫-২০ হাজার পরিবার পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। কয়েক হাজার একর আমন ধানের বীজতলাসহ অনেক ফসলী ক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে।

হাতীবান্ধার ধুবনীগ্রামের আলকাছ উদ্দিন ও আজিমুদ্দিন জানান, বাড়ি থেকে বন্যার পানি নামতে না নামতেই তৃতীয়বারের মতো আবারও বন্যার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন তারা। গত সপ্তাহে দুই দফায় ৪-৫ দিন পানি বন্দি ছিলেন এসব পরিবার। আবার পানি বন্দি হয়ে পড়েছেন। দ্রুত ত্রাণ সহায়তা পৌছাতে সরকারের প্রতি দাবি জানান তারা। শুধু তিস্তাই নয়, ধরলা, বুড়ি তিস্তা, সানিয়াজানসহ লালমনিরহাটের সকল নদ নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

সিঙ্গিমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন দুলু জানান, তৃতীয় দফায় বন্যার পানিতে ঢুবে গেছে নিম্নাঞ্চল। নতুন নতুন এলাকাও পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

হাতীবান্ধা উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ফেরদৌস আলম জানান, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে পানিবন্দি পরিবারের তালিকা করা হচ্ছে। পানিবন্দি পরিবারগুলোর জন্য ত্রাণ চেয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পত্র পাঠানো হয়েছে।

তিস্তা ব্যারাজের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গত রোববার রাত থেকে তিস্তার পানি প্রবাহ তৃতীয় দফায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তার পানি প্রবাহ বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরকম অবস্থায় তিস্তা ব্যারাজ রক্ষার্থে সতর্ক অবস্থায় থাকতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য রেড এলার্ট জারী করা হয়।

এদিকে বন্যাকবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করে বিকেলে জেলা প্রশাসক আবুল ফয়েজ মোঃ আলাউদ্দিন খান জানান নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোর পরিবার পরিজনদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়ার পাশাপাশি তাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের প্রস্তুতি চলছে।

তিস্তার পানি বিপদসীমার উপরে : উজানের ভারী বর্ষণ আর পাহাড়ী ঢলে নীলফামারীতে তিস্তা নদীর পানি এখনও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

আজ মঙ্গলবার (১১ জুলাই) সকাল ৯টা থেকে তিস্তা নদীর পানি  ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্ট বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।  এতে করে নদীর তীরবর্তি নীলফামারী দু’টি উপজেলার অন্তত ২৫টি গ্রামের ১০ সহস্রাধিক মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া  ডিভিশনের বন্যাপূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ সূত্র জানায়, উজানের ঢল ও ভারি বর্ষণে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সোমবার সকাল ৬টায় তিস্তা সেচ প্রকল্পের ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্ট বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আজ মঙ্গলবার পানি কমে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইয়ে চলেছে নদীর পানি।

নদীরপানি বৃদ্ধির ফলে জেলার ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছচাপানী, গয়াবাড়ি ও জলঢাকা উপজেলার, গোলমুণ্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী ২৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের ১০ সহস্রারাধিক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে অন্তত পাঁচ সহস্রারাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রামের নজরুল ইসলাম ইসলাম (৪০) বলেন, নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে ছোটখাতা গ্রামের ছয় শতাধিক বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। পানিবন্দী এসব পরিবার চুলা জ্বালাতে না পেরে দু’দিন ধরে  শুকনা খাবার খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।

একই ইউনিয়নের পশ্চিম বাইশপুকুর গ্রামের সমসের আলী বলেন, পূর্ব বাবইশপুকুর ও পশ্চিম বাইশপুর গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবার তিস্তার বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বানের পানির ঢলে ওই গ্রামে সেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাধটি হুমকির মধ্যে পড়েছে।

ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান বলেন, নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে ইউনিয়নের পশ্চিম বাইশপুকুর, পূর্ব বাইশপুকুর, সতিঘাট, সুপুরটারী গ্রামের বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। এসব গ্রামের বাড়িঘরে পানি থাকায় দু’দিন ধরে চুলা জ্বালাতে পারছে না পরিবারগুলো। ফলে তারা না খেয়ে দিন কাটাছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন,  তিস্তার পানি বৃদ্ধির কারণে ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রেখে পানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।  আরো পানি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, বন্যার পূর্বাভাস থাকায় নদীরতীরবর্তী এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক করা হয়েছে। তাঁরা এলাকার মানুষকে  সতর্ক করছেন নদীর পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে নিরাপদ স্থানে সড়ে যেতে।

কুড়িগ্রামে বন্যার অবনতি : কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তাসহ সবকটি নদ-নদীর পানি আবারও বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ১১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২ সেমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুর, নাগেশ্বরী ও সদর উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের ২ শতাধিক গ্রাম। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এসব এলাকার প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ। বন্যাকবলিত বেশির ভাগ মানুষ গত ৪দিন ধরে পানিবন্দী থাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে পড়েছে।

নিম্নাঞ্চলের পথঘাট ও ঘরবাড়ি তলিয়ে থাকায় দুর্ভোগ বেড়েছে তাদের। বন্ধ রয়েছে জেলার শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান। এখন পর্যন্ত বন্যার্তদের মাঝে সরকারী ও বেসরকারী ভাবে কোনো ত্রাণ-তৎপরতা শুরু হয়নি। এদিকে ত্রাণ সহায়তা না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বন্যা দুর্গতরা।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বলেছেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে যেখানে যতটুকু প্রয়োজন ত্রাণ-সহায়তা অব্যাহত রাখতে। সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলাম জানান, স্বাস্থ্য বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে ৮৮টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। যারা বন্যার্ত মানুষের জন্য কাজ করছে।

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শফিকুল ইসলাম জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ১১ সেমি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

নুন খাওয়া পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৯ সেন্টিমিটার, সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি ২৬ সেমির এবং কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ১১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জামালপুরে নতুন করে প্লাবিত ২০ গ্রাম : যমুনা নদীর পানি না বাড়ায় জামালপুরে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ি ও জামালপুর সদর উপজেলার চরাঞ্চলের আরও ৬টি ইউনিয়নের অন্তত ২০ গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এ নিয়ে জেলার ৫ উপজেলার ২৩টি ইউনিয়নের কমপক্ষে ৮০ হাজার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ৫ দিন ধরে পানিবন্দি থাকায় বানভাসী মানুষরা চরম দূর্ভোগের শিকার হচ্ছে।

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, যমুনা নদীর পানি রোববার ২ সেন্টিমিটার কমলেও সোমবার তা আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৭ সিন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।

জামালপুর সদর উপজেলার লক্ষীচর, তুলশীচর, মেলান্দহের মাহমুদপুর, মাদারগঞ্জের বালিজুরী, জোড়খালী, সরিষাবাড়ি উপজেলার পিংনা ও পোগলদিঘা ইউনিয়ন এবং দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার পৌর এলাকার ২টি ওয়ার্ডসহ ২০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে।

হুমকীর মুখে পড়েছে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চিকাজানি ইউনিয়নের খোলাবাড়ি-মন্ডলবাড়ি বাজার সড়ক বাঁধ। এই বাঁধটি ভেঙে গেলে পুরো ইউনিয়নটি বন্যাকবলিত হওয়ার পাশাপাশি উপজেলা সদরের সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এই বাঁধটি রক্ষার দাবিতে ইউনয়নবাসী সোমবার বিকেলে বাঁধের ওপর মানববন্ধন বর্মসূচী পালন করেছে।

দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুর কালাম আজাদ জানিয়েছেন, এই সড়ক বাঁধটি সংস্কারের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে দরপত্র আহবান করে কার্যাদেশ দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত ঠিকাদার কাজ শুরু না করায় বাঁধটি এখন হুমকির মুখে। তিনি বাঁধটি রক্ষায় দ্রুত কাজ শুরুর আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় প্রতি পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেয়া শুরু হচ্ছে।

বন্যাকবলিত এলাকায় কোনো কাজ না থাকায় বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষরা। পুরো চরাঞ্চল পানিতে সয়লাব হওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের।

তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বন্যার্তদের জন্য দ্বিতীয় দফায় ৪০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার পানিবন্দি মানুষের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের বরাদ্দকৃত এসব ত্রাণ সামগ্রী প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।

জামালপুরের সিভিল সার্জন ডা. মোশায়েল উল ইসলাম রতন জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত বন্যাকবলিত এলাকায় কোনো রোগ-বালাই দেখা দেয়নি। যাতে রোগ ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্য ৬৯টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে এবং তারা এলাকায় কাজ করছেন।

বগুড়ায় যমুনার পানি আবার বাড়ছে : গত রোববার রাতে বগুড়ার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ১ সেন্টিমিটার কমলেও গতকাল দুপুরের পর থেকে আবারও বাড়তে শুরু করেছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত সেখানকার পানি বিপদসীমার ২৪ সেমির উপরে থাকলেও সন্ধ্যায় তা বেড়ে বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিতে সারিয়াকান্দির বয়রাকান্দি পয়েন্টে যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্প এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়ায় উপজেলার বয়রাকান্দি, ধলিরকান্দি ও বড়ইকান্দি গ্রামের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে বয়রাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি এবতেদায়ী মাদ্রাসা নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে।

পানি বৃদ্ধির কারণে সোমবারও নতুন নতুন এলাকা পাবিত হচ্ছে। সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসসূত্র জানিয়েছে, নতুন এলাকা পাবিত হওয়ায় ৭টি ইউনিয়নের ৫০টি গ্রামের ১০ হাজার পরিবারের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে নিমজ্জিত উপজেলার ৫১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। উপজেলা কৃষি স¤প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় উপজেলার সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমির পাট, আউশ, বীজতলা ও শাকসবজির ক্ষেত তলিয়ে গেছে।

বন্যার কারণে সারিয়াকান্দিতে যমুনার তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের বয়রাকান্দি পয়েন্টে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রকল্প এলাকায় ভাঙন দেখা দেওয়ায় বয়রাকান্দি, ধলিরকান্দি ও বড়ইকান্দি গ্রামের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, বন্যা আসার আগে থেকে ২৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে রৌহাদহ থেকে কর্ণিবাড়ি পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার যমুনার তীর সংরক্ষণ কাজ চলমান রয়েছে। ভাঙনের কারণে এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রুহুল আমীন জানান, বয়রাকান্দি পয়েন্টে নদী তীর জেগে উঠলে জিও ব্যাগ ডাম্পিং শুরু করা হবে। এখন সেখানে পানি প্রবাহিত হওয়ায় কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।

সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সারওয়ার আলম জানান, বন্যা কবলিত এক হাজার পরিবারকে ২০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ আছে।

এদিকে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার সাহেববাড়ি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে বাঁধটির প্রায় দেড় থেকে দুই শ মিটার বাঙালি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। একই সঙ্গে বাঁধের ওই স্থানে আশ্রয় নেয়া বেশ কয়েকটি বসতবাড়িও নদীগর্ভে চলে গেছে। বাঁধটি পুরোপুরি ভেঙে গেলে বগুড়ার শেরপুর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার হাজারো একর ফসলি জমিসহ কয়েক’শ বসতবাড়ি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম জানান, বাঁধে ধস ও বসতবাড়ি নদী গর্ভে চলে গেছে। এখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ধুনটেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ধুনটের ভাণ্ডারবাড়ী ইউনিয়নে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উদ্যোগে গতকাল বন্যা কবলিত ১৯৫টি পরিবারের মাঝে ৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। দকাল সকালে ভাণ্ডারবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রধান অতিথি হিসেবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন বগুড়া-৫ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব হাবিবর রহমান।

সিরাজগস্থিতিঞ্জে পরি অপরিবর্তিত : গত ১২ ঘন্টায় যমুনা নদীর পানি না বাড়লেও পানিবন্দী মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম দুর্ভোগ। বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। কাজিপুরের বৃহত্তম ঢেকুরিয়া হাটে পানি ওঠায় ব্যবসনা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করায় ছাত্র-ছাত্রীদের চরম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে।

জানা যায়, গত এক সপ্তাহ ধরে যমুনার পানিবৃদ্ধি পেলেও রবিবার সন্ধ্যা থেকে পানি স্থিতিশীল রয়েছে। বর্তমানে বিপদসীমার ৩০ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, শাহজাদপুর, বেলকুচি ও চৌহালী উপজেলার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়ে প্রায় ৪ সহস্রাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দ মানুষগুলো চরম দুর্ভোগে পড়েছে। টিউবওয়েব তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।

কাজিপুরের ঢেকুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা আলেয়া ও মালসাপাড়া গ্রামের খাতুন জানান, বসতবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। টিউবওয়েল তলিয়ে যাওয়ায় পানি খেতে কষ্ট হচ্ছে। পানিবন্দি ইনসাফ আলী জানান, কর্ম না থাকায় খুব কষ্টে রয়েছে। সরকারিভাবে কিছু ত্রাণ সহায়তা পেলে খুবই উপকার হতো।

ঢেকুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাতেমা খাতুন বলেন, স্কুলে পানি ওঠায় বইখাতা নিয়ে যাতায়াতে খুব কষ্টে হচ্ছে। স্কুলছাত্রী রুমা জানান, স্কুলে পানি ওঠায় অন্য স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দিতে দিচ্ছে।

ঢেকুরিয়া হাটের ব্যবসায়ীরা জানান, পুরো বাজার পানিতে তলিয়ে গেছে। সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। বেচাকেনায় ধস নেমেছে।

কাজিপুর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন জানান, কাজিপুরের ১০টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে প্রশাসনের কাছে জমা দেয়া হবে। তার বরাদ্দ অনুযায়ী বিতরণ করা হবে।

সিভিল সার্জন ডা. মুনজুর আলম জানান, প্রতিটি উপজেলায় স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও ৯৫টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দীকা জানান, ইতোমধ্যে প্রায় সহস্রাধিক পরিবারের মধ্যে ১০ কেজি করে চাউল ও নগদ টাকা এবং শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও উপজেলা প্রশাসনের বিপরীতে ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তারা অচিরেই বিতরন কার্যক্রম শুরু করা হবে।

গঙ্গাচড়ায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি : উজান থেকে নেমে আসা পাহারী ঢল ও বৃষ্টির পানিতে তিস্তা নদীতে বন্যা দেখা দিয়েছে। র্তমানে তিস্তার পানি বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পরেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী সকালে তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে সকাল ৬টায় বিপদ সীমার ৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

এতে তলিয়ে গেছে উপজেলার হাজার হাজার একর ফসলী জমি রাস্তাঘাটসহ বিদ্যালয়। জানা যায়, গত রোববার মধ্য রাত থেকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে উপজেলার লক্ষীটারী ইউনিয়নের চরইচলী, শংকরদহ, জয়রামওঝা, চল্লিশসাল; কোলকোন্দ ইউনিয়নের চর মটুকপুর, চিলাখাল, বিনবিনা; গঙ্গাচড়া সদরের ধামুর, মর্নেয়া ইউনিয়নের ছোট রূপাই, রামদেব, কামদেব, নরসিংহ নিলারপার; আলমবিদিতর ইউনিয়নের হাজিপাড়া, ব্যাংকপাড়া; নোহালী ইউনিয়নের মিনার বাজার, চর বাগডহড়া, চর নোহালী এলাকার প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি মানুষ খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে ভুগছে। এদের অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গৃহপালিত পশু-পাখিসহ পাশর্^বর্তী উঁচু জায়গায় ও তিস্তা প্রতিরক্ষা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে।

এ বিষয়ে লক্ষীটারী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী জানান, তার ইউনিয়নের চর শংকরদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বর্তমানে তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে হুমকির মুখে রয়েছে। এছাড়াও ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তিনি বিদ্যালয়টি রক্ষাসহ পানিবন্দি লোকজনের সহায়তায় দ্রুত সরকারি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র রায় জানান, পানিবন্দি পরিবারগুলোকে সহায়তার জন্য ২০ মেট্রিক টন চাউলসহ ২ লক্ষ টাকা চেয়ে আবেদন পাঠানো হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!