• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী রাজনীতিকের মুখোচ্ছবি


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৭, ১০:৩৪ এএম
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী রাজনীতিকের মুখোচ্ছবি

ঢাকা : চলে গেলেন রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন সবার দাদা- কিশোরের, যুবকের, বয়স্কের, বিভিন্ন প্রজন্মের। নানা কারণে এ দেশের সব শ্রেণির মানুষের প্রিয়ভাজন ছিলেন তিনি। বহুমাত্রিক গুণাবলি ও বিরল স্বভাবের অধিকারী  সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান, নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক ও নিষ্ঠাবান সংগঠক। সমাজবাস্তববাদী চেতনায় পূর্ণ ছিল তার মনোজগৎ। সারাটি জীবন তিনি মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। পাশাপাশি নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায়। এ সব কিছু ছাপিয়ে মানুষ হিসেবেই অনেক বড় ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে আমরা একজন ভালো মানুষকে হারিয়েছি। তিনি আমাদের মাঝে নেই, এখন আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে তিনি রেখে গেছেন তার রাজনৈতিক দর্শন এবং অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামের এক অসামান্য জীবনকে। তার রাজনৈতিক দর্শন এবং জীবনকে আমরা যতই ধারণ করব, ততই তাৎপর্যপূর্ণ হবে তার জীবনস্মৃতি।

মানুষ হিসেবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রতীক ছিলেন তারুণ্যের, প্রতীক ছিলেন যৌবনের, প্রতীক ছিলেন আশার। একা একা হেসে যেত তার কৌতূহলী চোখে, আর শান্ত মুখাবয়ব। শিশুর সরলতামিশ্রিত প্রাণখোলা হাসি ছিল তার। যে হাসিতে ছিল প্রাণের প্রাচুর্য আর জীবনের উচ্ছ্বাস। নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন তেজস্বী, দক্ষ, দৃঢ়চেতা, ধৈর্যশীল, সহিষ্ণু, সংযমী, বিচক্ষণ, আপসহীন ও স্পষ্টভাষী। তার ছিল অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, গল্প বলার নিপুণ দক্ষতা এবং সদা প্রফুল্ল কৌতুকবোধ। প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে তার উপস্থিত বুদ্ধির তৎপরতা ছিল একেবারে অনলস। এসব কারণে শুধু নিজ দলের সহকর্মীরাই নন, তার ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক মত ও পথের মানুষ। রাজনৈতিক কারণে তিনি প্রায়শই নানা রকম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু সব কিছু সামলে নিয়েছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং দৃঢ়তাই যে পারে সব বৈরিতার গণ্ডি অতিক্রম করতে, নেতা হিসেবে তিনি এই উদাহরণ আমাদের সামনে রেখে গেছেন।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৪৬ সালের ৫ মে সুনামগঞ্জের আনোয়ারাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা কমিটির অন্যতম সদস্য সুরঞ্জিতের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বামপন্থি রাজনীতির মধ্য দিয়ে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে ছিলেন অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য। এরপর স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদসহ চার দশকের প্রায় সব সংসদেই নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। 

তিনি দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম জাতীয় সংসদসহ মোট সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর তিনি রেলমন্ত্রী ছিলেন। ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতি থেকে উঠে আসা এই নেতা সর্বশেষ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং বর্তমান সংসদে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন।

১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ল পাসের পর কিছুদিন তিনি আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ভিপি প্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) পিকিং ও মস্কো ধারায় বিভক্ত হলে মওলানা ভাসানীর পক্ষ ত্যাগ করে সুরঞ্জিত অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন অংশে যোগ দেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে ন্যাপ থেকে বিজয়ী হন। পরে ন্যাপের ভাঙনের পর গণতন্ত্রী পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৬ ও ১৯৯১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জয়ী হন।

পঞ্চম সংসদের সদস্য থাকাকালেই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রথমে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে সুরঞ্জিত সেন ভোটে হেরে গেলেও পরে হবিগঞ্জের একটি আসনে উপনির্বাচন করে তিনি বিজয়ী হন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন তিনি।

২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর সুরঞ্জিত আইন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান। পরে ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন সুরঞ্জিত। সর্বশেষ ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি পুনরায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে তিনি আবারও আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেনগুপ্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ডক্টরেট। তিনি একটি বেসরকারি সংস্থার শিক্ষা বিভাগে সমন্বয়কারী পদে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের একমাত্র সন্তান সৌমেন সেনগুপ্ত নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং কানাডা থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি ব্যবসা করছেন। সৌমেনের স্ত্রী রাখী মৈত্রী সেনগুপ্ত পেশায় চিকিৎসক। 

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!