• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বহাল তবিয়তেই সেই সুশান্ত পাল!


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৭, ০২:৪১ পিএম
বহাল তবিয়তেই সেই সুশান্ত পাল!

সুশান্ত পালকে মনে আছে? যিনি ৩০তম বিসিএসে রেকর্ড মার্ক পান এবং প্রথম হয়ে ‘কাস্টমস অফিসার’ হিসেবে যোগ দেন সরকারি চাকরিতে। চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক এই শিক্ষার্থী যতটা না মেধার কারণে আলোচিত, তার চেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কটূক্তি করার জন্য। সেই সুশান্ত পাল এখন রংপুর কাস্টমসে বহাল তবিয়তেই আছেন।

গত বছরের ২৩ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় মুখ সুশান্ত পাল তার নিজ ফেসবুক ওয়ালে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে একটি অশোভন মন্তব্য ও কুরুচিপূর্ণ স্ট্যাটাস দেন। তার সেই স্ট্যাটাসে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় সর্বমহলে। একপর্যায়ে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাকে তাৎক্ষণিকভাবে (স্ট্যান্ড রিলিজ) বদলি করা হয়। তবু সুশান্ত পালের অপরাধের শাস্তিকে যথার্থ বলে মেনে নিতে পারেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা।

সুশান্ত পালের সেই স্ট্যাটাসটি ছিল-‘ঢাবিতে অতিমাত্রায় র?্যাগিং হয়। বড় ভাইয়েরা প্রতিবন্ধীদের অযথা নির্যাতন করে। বই খাতা ছুড়ে ফেলে দেয়। শীতের সময় সারারাত নগ্ন করে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে। গেস্টরুমে সবার সামনে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করে। আবার চায়ের সঙ্গে নিষিদ্ধদ্রব্য জোর করে খাইয়ে দেয়।’ ফেসবুক পোস্টে সুশান্ত পালের এ মন্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। যদিও পরে সুশান্ত পাল তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তুলে নিয়ে ক্ষমা চান। 

তার পরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও ক্যাম্পাসে তার বিরুদ্ধে স্লোগান ও দফায় দফায় মিছিল-সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। এ প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থীদের মাঝেও। সুশান্ত পালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ওঠে। অবস্থা বেগতিক দেখে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তাকে শাস্তিমূলক স্ট্যান্ড রিলিজ করে (তাৎক্ষণিক বদলি) রংপুরে পাঠায়।

ঘটনার কয়েক দিন পর গত বছরের ২৭ অক্টোবর সুশান্ত পালের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা, বানোয়াট ও কুরুচিপূর্ণ লেখা প্রকাশ করার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষে মোতাকাব্বির খান নামে একজন ছাত্র শাহবাগ থানায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় একটি মামলা করেন। 

মামলায় অভিযোগ করা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস আর বাংলাদেশের ইতিহাস ওতপ্রতোভাবে জড়িত। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হয়ে সুশান্ত পাল এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ছোট করতে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট লেখা লিখেছেন। এর মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে হেয় করা হয়েছে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের মিথ্যা ও কুরুচিপূর্ণ প্রচারণা যেন কেউ চালাতে না পারে, সে কারণেই এ মামলা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, সাবেক, বর্তমান লাখো শিক্ষার্থী, সবার পক্ষ থেকেই এই মামলা। 

তাতে আরো বলা হয়, সুশান্ত পালের কুরুচিপূর্ণ, মিথ্যা, বানোয়াট ও নোংরা লেখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কর্মকর্তা, শিক্ষার্থী সবাই ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করেন। মানববন্ধন শেষে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ নামে ফেসবুকের গ্রুপ, যেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম, সেখানেও এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়।

মামলা করার কয়েক ঘণ্টা পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ফেসবুকে অশোভন মন্তব্য ও কটূক্তির অভিযোগে কাস্টমসের সহকারী কমিশনার সুশান্ত পালকে তাৎক্ষণিকভাবে (স্ট্যান্ড রিলিজ) বদলির আদেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। একই সঙ্গে তার মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কমিশনারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। 

এদিন এনবিআরের পক্ষে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মইনুল খান গণমাধ্যমকে জানান, বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের কর্মকর্তা সুশান্ত পালকে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বদলি/পদায়ন করা হয়েছে। সুশান্ত পালকে খুলনা থেকে রংপুরে ‘স্ট্যান্ড রিলিজ’ করা হয়েছে। এর অর্থ নতুন কর্মস্থলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে যোগদান করতে হবে। প্রজ্ঞাপনে সুশান্তকে মানসিক চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো জানিয়েছিলেন, সুশান্ত পালের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে চাকরিচ্যুতও করা হতে পারে। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সুষ্ঠু তদন্তের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

সুশান্ত পালের বিরুদ্ধে আর কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চাইলে গতকাল শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের (সিআইআইডি) মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, সুশান্ত পালের অপরাধের শাস্তি হিসেবে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে খুলনা থেকে রংপুরে বদলি করা হয়। রংপুর কাস্টমসের কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। তাই তাকে সেখানে বদলি করা হয়েছে। এখন তিনি সেখানেই কর্মরত আছেন। অন্যদিকে সুশান্তের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে ৫৭ ধারায় দায়ের করা মামলাটি এখন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে। সে বিষয়ে জানতে ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমানকে ফোন করলে তিনি জানান, মামলাটির তদন্ত চলছে। এই মুহূর্তে মামলার সর্বশেষ আপডেট নেই। আজ মঙ্গলবার যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে কাস্টমস সূত্র জানায়, এনবিআরের নির্দেশে সুশান্ত পালের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। পরে তারা এনবিআরকে চিঠিতে জানিয়েছে, সুশান্ত পাল মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার শরীরে কোনো অসুস্থতার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই সুশান্ত পালকে ঢাকায় বদলিরও সুপারিশ করেন চিকিৎসকরা। সূত্রটি বলছে, চিকিৎসকের পরামর্শে বদলি সম্ভব নয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেকটাই প্রমাণিত, তাই সুশান্তকে রংপুরেই থাকতে হবে। তদন্ত শেষে পুরোপুরি দোষী সাব্যস্ত হলে আরো বড় ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে এনবিআর।

কে এই সুশান্ত পাল: সুশান্ত পাল চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন। তিনি যথেষ্ট মেধাবী এবং ভালো বক্তা। ৩০তম বিসিএসে তিনি রেকর্ড নম্বর পান এবং প্রথম হয়ে ‘কাস্টমস অফিসার’ হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। তিনি ‘ক্যারিয়ার আড্ডা’ নামক বিভিন্ন সভা সেমিনার করেন। 

সেসবে সেমিনারে তিনি বিসিএসের প্রতি উৎসাহ-উদ্দীপনামূলক বক্তব্য দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তার লাখ লাখ ফলোয়ার রয়েছে। একটি পোস্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাতে হাজার হাজার লাইক, কমেন্ট, শেয়ার পড়ে নিমিষেই। আর বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় পড়াশোনা-বিষয়ক পাতাটি যেন তার লেখা ছাড়া চলেই না। এসব পাতায় তিনি বিসিএস পরীক্ষার জন্য নানা পরামর্শও দিয়ে থাকেন।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!