• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলা ভাষা: ধীরেন্দ্রনাথ থেকে রফিকুল


জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭, ০৭:০৪ পিএম
বাংলা ভাষা: ধীরেন্দ্রনাথ থেকে রফিকুল

ইতিহাসের জেলা এবং ঐতিহ্যের জেলা কুমিল্লা। আমাদের জাতীয় মননের প্রতীক একুশের চেতনা মিশে আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে। আমাদের জাতি সত্ত্বার শ্রেষ্ঠতম পরিচয় বাহক অমর একুশের নেপথ্যে জড়িয়ে আছে এই কুমিল্লা। একুশের গোড়ায় ছিলেন কুমিল্লার কৃতিসন্তান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। আজ আমরা মায়ের ভাষায় প্রাণখুলে কথা বলতে পারছি যে সকল কালজয়ী মহান ব্যক্তির অক্লান্ত ত্যাগের কল্যাণে; তাদের অন্যতম শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ছয় মাসের মাথায় নবগঠিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নে গঠিত হয় ‘পাকিস্তান গণপরিষদ’। গণপরিষদ অধিবেশনে বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার দাবি আনুষ্ঠানিক ভাবে উত্থাপন করেন সেদিন।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবটি দাখিল করেন। মূল প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, উর্দুর সাথে ইংরেজিও পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে বিবেচিত হবে। একই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের তাঁর সংশোধনী পস্তাবে ২৯ নং বিধির ১ নং উপ-বিধিতে উর্দু ও ইংরেজির পর ‘বাংলা’ শব্দটি যুক্ত করার দাবি জানান।

তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন, পাকিস্তানের ৫টি প্রদেশের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী। সুতরাং বিষয়টিকে প্রাদেশিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাংলাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে দেখা উচিত। তাই তিনি গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্তির দাবি করেন। তৎকালীন পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলীম লীগ সদস্যরা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। ১১ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা উর্দু বিল পাশ হয়ে যায়।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত করাচীর অধিবেশন থেকে ঢাকায় ফিরে এলে, বিমান বন্দরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জানান। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত মূলতঃ সেখান থেকেই।

অবশেষে ১৯৫০ সালে গণপরিষদে আরবি হরফে বাংলা লিখার প্রস্তাব উত্থাপিত হলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তীব্র প্রতিবাদ করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে রক্ত ঝরে। ২২ ফেব্রুয়ারি এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের অধিবেশন বয়কট করেন এবং এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।

কীভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে গেল
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্বপ্নের বাংলাভাষা ৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রক্ত ঝরার মধ্য দিয়ে মাতৃভাষায় রূপ লাভ করে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ১৯৫২ সনের এই আত্মত্যাগের দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২০০০ সালে স্বীকৃতি পায়। ভাষা সংগ্রামের দিনটি কীভাবে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেলো, কারা ছিলো এর পেছনে। সে ইতিহাসটুকু আমাদের অনেকেরই অজানা।

সবকিছুর পুরোধা ছিলেন ক্যানাডা নিবাসী বাঙালি, কুমিল্লার রফিকুল ইসলাম। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে এক রফিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বাংলা ভাষার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন। ঠিক তার ৪৬ বছর পরে ১৯৯৮ সালে আরেকজন রফিক কানাডায় বসেও ভেবেছেন বাংলা ভাষাকে বিশ্ব অঙ্গণে দেয়া যায়।

১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি রফিক জাতিসংঘের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে রফিক ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে কফি আনানকে প্রস্তাব করেন ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে র্জাতিক স্বীকৃতি দেয়ার।

একাত্তরে দেশ-মাতৃকাকে মুক্ত করতে যুদ্ধ করেছেন পাক বাহিনীর সাথে। পরবর্তী কালে এই লোকটি একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত করার সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন।

নব্বই শতকের শেষ দিকের কথা। সে সময় কফি আনানের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন হাসান ফেরদৌস। রফিকুলের চিঠিটি নজরে আসে তার। তিনি রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকেও একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন। ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি রফিক তাঁর সহযোদ্ধা আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে একটি সংগঠন দাঁড় করান। যার নাম দেন “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড”। এই সংগঠনের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেন একজন ইংরেজীভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী লোককে। পরে তারা ওই সংগঠনের পক্ষ থেকে আবারো একটি চিঠি লেখেন। যার একটি কপি ইউএনওর ক্যানাডিয়ান অ্যাম্বাসেডর ডেভিড ফাওলারের কাছেও পাঠান।

এক বছর পর ১৯৯৯ সালে হাসান ফেরদৌসের পরামর্শে রফিক এবং সালাম ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের জোশেফ পডের সাথে দেখা করেন। জোশেফের পরামর্শে ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করেন। তিনি তাদের কথা মন দিয়ে শোনেন। পরে তার পরামর্শে ভারত, ক্যানাডা, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং বাংলাদেশ এই ৫টি সদস্য দেশ থেকে ভাষার প্রস্তাবটি আনার ব্যবস্থা করেন।

সে সময় বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী এম এ সাদেক এবং শিক্ষা সচিব কাজী রকিবুদ্দিন, অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারিয়েটের তৎকালীন ডিরেক্টর মশিউর রহমান, ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোজাম্মেল আলি, কাউন্সিলর ইকতিয়ার চৌধুরী, ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনেরালের শীর্ষ উপদেষ্টা তোজাম্মেল হক সহ অন্য অনেকেই জড়িত হয়ে পড়েন। তাঁরা রাত দিন পরিশ্রম করে আরো ২৯ টি দেশকে প্রস্তাবটির স্বপক্ষে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন।

এতো পরিশ্রমের পরও ইউনেস্কোর প্রস্তাব উত্থাপনের শেষ দিন ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রস্তাটি পৌঁছায়নি। কারণ প্রস্তাবটিতে প্রধানমন্ত্রীর সই’ই বাকি; আর প্রধানমন্ত্রী তখন সংসদে। এদিকে সংসদ শেষ করে স্বাক্ষর করে পাঠাতে পাঠাতে সময় মত ইউনেস্কোতে পৌঁছুনো যাবে না। সেখানে প্রস্তাব উত্থাপনের সময়সীমা পার হয়ে যাবে। সব পরিশ্রম জলে যাবে। এদিকে ব্যাপারটি নিয়ে এক শ্বাসরুদ্ধকর বিনিদ্র রজনী অতিক্রম করে চলেছেন প্রস্তাবক রফিক-সালাম।

প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে অনুরোধ করা হলো তিনি যেন প্রস্তাবটিতে স্বাক্ষর করে ফ্যাক্স করে দেন ইউনেস্কোর দপ্তরে। অফিসের সময়সীমা শেষ হবার মাত্র একঘণ্টা আগে ফ্যাক্সবার্তা ইউনেস্কোর অফিসে এসে পৌঁছালো। ১৬ নভেম্বর সময়াভাবে ইউনেস্কোর সভায় উত্থাপন করা হলো না। রফিক-সালামেরা আরো একটি শ্বাসরুদ্ধকর বিনিদ্র রজনী পার করলেন।

অবশেষে ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ এক ঐতিহাসিক দিনের শুভ সুচনা হলো। প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হলো, খোদ পাকিস্তনসহ ১৮৮টি দেশ এতে সমর্থন জানালো। ইউনেস্কোর সভায় সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রস্তাব গৃহীত হলো।

এভাবেই একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত হলো। কিন্তু এতো কিছুর পরেও একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল উদ্যোক্তা রফিক এবং সালাম সবার কাছে অচেনাই রয়ে গেলেন। বহু বাংলাদেশি, বাংলাভাষী এবং প্রবাসীদের কাছে ব্যাপারটা এখনও অগোচরে- পর্দার অন্তরালে। অথচ কেউ কেউ মিটিং মিছিলে গলা ছেড়ে বক্তব্য দেন, শোনান কতো রূপকথার গল্প।

সদস্য সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবুদ্দিন (তৎকালীন শিক্ষা সচিব) সম্প্রতি কুমিল্লায় আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ের বহুতল ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও এর সাথে তাঁর নিজের সম্পৃক্ততার কথা তুলে ধরে এর নেপথ্যের নানা বাস্তবতার স্মৃতিচারণ করেন।
কাজী রকিবুদ্দিন বলেন, আমি এই কুমিল্লায় আমার চাকরি জীবন শুরু করি। স্বাধীনতা পরবর্তী এ জেলার প্রথম জেলা প্রশাসক হিসেবেও আমি দায়িত্ব পালন করি। সেসব কারণে এ জেলার প্রতি আমার দূর্বলতা রয়েছে। তবে, রফিকুল ইসলাম কুমিল্লার ছেলেন এতো দিন তা আমার জানা ছিলো না।  

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার (তৎকালীণ ত্রিপুরা) ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার রামরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১০ সালে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কিছু সময় শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি প্রথম পাকিস্তান আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথমবার তিনি পাকিস্তান মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

তাঁর নাতনি আরমা দত্ত জানান, ‘পেশা, রাজনীতি এবং আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে শুরুকরে সবই ছিলো কুমিল্লা কেন্দ্রিক। আমৃত্যু তিনি কুমিল্লার ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড় তাঁর নিজহাতে গড়া এই বাড়িটিতে ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ২৯ মার্চ রাতে পাঁক হানাদাররা বাংলা ভাষার প্রাণপুরুষ, মহান ভাষা আন্দোলনের মহা নায়ক বৃদ্ধ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তকে কুমিল্লার ওই বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হানাদাররা নির্মম ভাবে তাঁকে হত্যা করে।’

১৯৪৮ সারাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম রক্ত ঝরেছিল কুমিল্লায়। কুমিলল্লা আরেক কৃতী পুরুষ রফিকুল ইসলাম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তুলেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষা আন্দোলনের সুতিকাগার এই কুমিল্লায় ভাষার প্রাণপুরুষদের স্মৃতি চরম অবহেলিত।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে যে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পাক হানাদাররা হত্যা করেছিলো, সেই ঐতিহাসিক বাড়িটি এখন পরিণত হয়েছে রিকশা গ্যারেজে। বাড়িটিতে রয়েছে পৃথক তিনটি ভবন। পশ্চিম উত্তর এবং পূর্ব পার্শ্বে তিনটি পাঁকা ভবনের মোট ৬টি কক্ষ অত্যন্ত জরাজীর্ণ অবস্থা। পানি জমে এমন হয়েছে যে, দেখে মনে হবে ছোটখাট পুকুর আর নর্দমা। সে মহান মানুষটির স্মৃতি চিহ্ন এমনকি বাস্তুভিটাও অযত্নে অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। বর্তমানে বাড়িটির অত্যন্ত করুণ দশা। বাড়িটি দেখভালে দায়িত্বে একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবার। তারা বাড়িটিকে রিকশা গ্যারেজে পরিণত করেছেন।

ধীরেন দত্তের বাড়ির সামনের রাস্তাটি এবং কুমিল্লা স্টেডিয়ামটির নামকরণ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে করা হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের প্রষ্টোয় কুমিল্লা স্টেডিয়মটির নামকরণ করা হয় ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম’।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনত সংগ্রাম; সর্বশেষ পাক হানাদারদের হাতে শহীদ হয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।

ইতিহাসের মহানায়ক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আজ নেই। তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশে আজ পতপত করে উড়ছে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের পতাকা। তাঁরই স্বপ্নের বাংলা ভাষা আজ শুধু রাষ্ট্র ভাষাই নয়; ভাষা আন্দোলনের সে দিনটি আজ আন্তার্জাতিক ভাবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছ। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনের মহানায়কের যথাযথ মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

এখন এ বাড়িটি যথাযথ সংরক্ষণের বিষয়ে সরকারের হস্থক্ষেপ কামনা করছেন কুমিল্লাবাসী। নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. আলী হোসেন চৌধুরী, গল্পকার ও উপন্যাসিক প্রফেসর এহতেসাম হায়দার চৌধূরী, মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রিয় কমান্ড কাউন্সিল এর সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল আহসান পাখি, দৃষ্টির নির্বাহী পরিচালক নারীনেত্রী পাপড়ী বসু, বিএমএ’র সাবেক সভাপতি ডা. ইকবাল আনোয়ার, সাপ্তাহিক আমোদ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাকীন রাব্বী, শহীদ  ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি রক্ষা পরিষদের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট নাজমুল বারী চৌধুরী, কুমিল্লাস্থ মুরাদনগর যুবসমিতির আহবায়ক অ্যাডভোকেট সৈয়দ তানভীর আহাম্মদ ফয়ছালসহ কুমিল্লার সচেতন নাগরিকরা তাঁর স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটি এভাবে অযত্নে ফেলে না রেখে এখানে একটি সমৃদ্ধ যাদুঘর স্থাপন জরুরি মনে করছেন। তারা বলেন, কুমিল্লার যে মহান পুরুষটি ভাষা আন্দোলনে প্রথম বীজ বপন করেছেন তাঁর বাড়িটিই আজ চরম অবহেলিত, রিকশার গ্যারেজ! বিষয়টি সুশীল সমাজের কেউ মানতে পারছেন না।

তবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্তরসূরীরা বাড়িটি সরকারি ব্যাবস্থাপনায় দিতে বরাবরই অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন।

ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশ নেয়া ভাষা সৈনিক তৎকালীন ত্রিপুরা জেলা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মুক্ত বংলাদেশে কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক অ্যাডভোকেট আহাম্মদ আলী বলেন, ভাষা আন্দোলন যদি স্বাধীনতার মূল হয় তাহলে কুমিল্লার অবদান সবচাইতে বেশি। একদিকে ধীরেন বাবু (ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত) অন্যদিকে রফিকুল ইসলাম। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা আন্দোলনে প্রথম বীজ বপন করেছেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম রক্ত ঝরেছিল কুমিল্লায়। তারই ধারাবাহিকতায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তার্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির প্রথম দাবি তুলেছিলেন কুমিল্লার রফিকুল ইসলাম।

অ্যাডভোকেট আহাম্মদ আলী বলেন, আমি যখন প্রশাসক ছিলাম তখন ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম মালাটা (ফুল) দিয়েছিলাম ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িতে, তাঁর প্রতিকৃতিতে। তারপর শহীদ মিনারে গিয়েছি। আহারে সেই ঐতিকাসিক বাড়িটির আজ কি দশা! দেখে মায়া লাগে।

কতিপয় নব্য ইতিহাস লেখক/গবেষকের দ্বারা ভাষা আন্দোলনে কুমিল্লার ইতিহাস বিক্রিত করার অভিযোগ করেন অ্যাডভোকেট আহাম্মদ আলী। তিনি ধীরেন্দ্র নাথ দত্তকে যথাযথ মূল্যায়ন না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ভাষা সৈনিকদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাবে মরনোত্তর সম্মানা প্রবর্তনের, সঠিক ইতিহাস পূনরোদ্ধারেরও দাবি জানান তিনি। ইতিহাসের মহানায়ক ধীরেন দত্তের স্মৃতি সংরক্ষনের দাবি করেন এই প্রবীণ ভাষা সৈনিক। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠা উচিৎ ছিলো, কুমিল্লা বাসীর সচেতনতার অভাবে এই দাবিটি কার্যকর হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।

দৃষ্টির নির্বাহী পরিচালক নারীনেত্রী পাপড়ী বসু বলেন, ৫২’র সেই ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১’এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এ অর্জনের জন্যে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে শুধু গণপরিষদে কিংবা রাজপথে আন্দোলন নয়; একাধিকবার কারা বরণ করতে হয়েছিলো। শুধু তাই নয়, ১৯৭১’এ যুদ্ধ চলাকালে কনিষ্ঠ ছেলে দীলিপ দত্তসহ ২৯ মার্চ রাত দু’টোয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী এবং পরে কুমিল্লা সেনানিবাসের অন্ধকার বন্দিশিবিরের নির্মম বর্বরতায় শহীদ হন তিঁনি।

পাপড়ী বসু বলেন, আমি মনে করি বাংলাদেশের স্থপতি যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; তেমনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্থপতি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমার সৌভাগ্য হয়েছে এই পরিবারটির সাথে ওৎপ্রোতভাবে মেশার। আমার বাবা ও শ্বশুর বাড়ি সূত্রে। আজকে এই ভাষার মাসে আমি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি। যিনি বাংলা ভাষার জন্য রেখেছেন অসাধারণ ভূমিকা।

বর্তমানে বাংলাদেশে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ছেলে সঞ্জিব দত্তের মেয়ে আরমা দত্ত, ছেলে রাহুল দত্ত ও তাদের মা প্রতিতি দেবী ছাড়া শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের একমাত্র মেয়ে মনিষা পুরকায়স্থ বর্তমানে কলকাতার যোথপুর পার্ক এলাকায় শ্বশুর বাড়িতে বসবাস করেন।

‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি রক্ষা পরিষদ, কুমিল্লা’র সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট নাজমুল বারী চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতার ৪ দশক অতিবাহিত হতে চলেছে। কিন্তু এ বাড়িটি অবহেলা, অযত্ন আর ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এর সবকিছুর পেছনেই রয়েছে আমাদের মানসিক দৈন্যতা ও গুণীজনকে কদর করতে না পারার মানসিকতা। সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এই বাড়িটি পরিদর্শন করে গেছেন। এই বাড়িটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ, তত্ত্বাবধান ও এখানে একটি আন্তার্জাতিক মানের ভাষা যাদুঘর স্থাপনের দাবি কুমিল্লার মানুষের দীর্ঘদিনের। কুমিল্লা বাসীর দাবি এ মহান ব্যাক্তির সম্মানে এখানে একটি আন্তজার্তিক মানের ভাষা যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হোক।

অ্যাডভোকেট নাজমুল বারী চৌধুরী জানান, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটি সংরক্ষণে সংগঠণের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনও করা হয়েছে।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটি নিয়ে কুমিল্লাবাসীর অনেক আবেগ রয়েছে। বাড়িটি নিয়ে প্রশাসনসহ যারাই উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেসব জোড়ালো ছিলো না- উল্লেখ করে বাড়িটি নিয়ে অনেক স্বপ্নের কথা জানান কুমিল্লার সাবেক জেলা প্রশাসক হাসানুজ্জামান কল্লোল। তিনি বলেন, আমার বাড়িটির সম্মানিত ওয়ারিশানদের সাথে কথা বলেছি। বাড়িটি নিয়ে আইনি জটিলতা আছে। এসব সমস্য শেষ হলে বাড়িটি নিয়ে ভালো কিছু করা সম্ভব।

লেখক- সাংবাদিক ও পরিচালক, ঐতিহ্য কুমিল্লা
ইমেইল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!