• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘বাংলাদেশ ইজ বেস্ট, আই লাইকড দোজ থিংস’


ফেসবুক থেকে ডেস্ক জুলাই ১৭, ২০১৭, ০৪:০০ পিএম
‘বাংলাদেশ ইজ বেস্ট, আই লাইকড দোজ থিংস’

ঢাকা: বাংলাদেশের পরিচয় কি? এ দেশটি নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর। ছয় ঋতুর এমন দেশ পৃথিবী নামক গ্রহের আর কোথাও মেলে না। আছে আতিথেয়তায় জগৎজোড়া খ্যাতিও। কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানি, কি নেই এ দেশে।

এ দেশের মেধাবী তরুণরা বিদেশে গিয়ে নানা ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করে চলেছে স্বাধীনতার পর থেকেই। এ দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবিসহ বিভিন্ন সংস্থা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সফলতার সঙ্গে দায়িত্বপালন করছে।

বিদেশে একটি প্রশিক্ষণে গিয়ে সম্মানিত হয়েছেন একজন চৌকস পুলিশ অফিসার। তার সে অভিজ্ঞতা ও বুকভরা গৌরবের কথা অকপটে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে পাবলিকলি জানিয়েছেন তিনি। ওই পুলিশ কর্মকর্তা সোমবার (১৭ জুলাই) দুপুরে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এ সংক্রান্ত একটি পোস্ট করেছেন।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অন্যতম সদস্য ও অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন-এর পোস্টটি হুবহু পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:-
 
‘দেখতে দেখতে ইন্টারন্যাশনাল নাইট চলে এলো একটি টেবিলে সাদা রং-এর কাপড় বিছানো, আর পিছনে ফ্ল্যাগ স্ট্যাণ্ডে একটি জাতীয় পতাকা ঝুলিয়ে ২৪টি স্টল সাজানো হয়েছে। মূলত: ২৪টি দেশের ২৪ জন বিদেশী প্রশিক্ষণার্থীর জন্য এই আয়োজন করা হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রসহ মোট ২৫টি দেশে ট্রেনিং-এ অংশগ্রহন করলেও একাডেমী কর্তৃপক্ষ নিজ দেশের জন্য সেখানে কোন স্টল রাখেনি। তারা এই দিনটি বাদে সব সময়ই হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিল।

যাহোক, বিদেশী প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে আমরা ২৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা সেদিন সকাল সকাল অনুষ্ঠানস্থলে চলে গেলাম। কোন স্টলটা আমাদের কার জন্য বরাদ্ধ ছিল তা বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হল না। কারণ, পতাকা দেখেই বুঝা যাচ্ছিল কোনটা কার স্টল।
সবাই যার যার স্টল বুঝে নিলাম।

এবার শুরু হল সাজসজ্জা। আমি ছাড়া সবাই যার যার দেশের ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য হুইস্কি, বিয়ার, ওয়াইনসহ নানা ধরণের খাদ্যদ্রব্য দিয়ে স্টল ভরে ফেলল। আমার ডান পাশে মেক্সিকো, বাম পাশে জার্মানী, সামনে ফ্রান্স ও তুরস্ক এবং পিছনে ইউকে ও ব্রাজিলের স্টল দেখে আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম।

দূর থেকে ইরাক এবং ইউক্রেণের স্টলদু'টি খুব বেশী আকৃষ্ট করছিল। সেগুলো ছিল খুব গোছান এবং নানা রং-এর জিনিস দিয়ে ভরা। দু'জনই নারী পুলিশ কর্মকর্তা সেগুলোর প্রতিনিধি হওয়াতে তাদের স্টলের সাজসজ্জার বৈচিত্র‍্য ছিল লক্ষণীয়।

যাই হোক, সবার স্টল গোছানো প্রায় শেষ হয়ে এলো। এবার সবাই ঘুরে ঘুরে অন্যান্যদের স্টলও একটু দেখতে লাগলাম। সেসব দেখে আমি একটু হতাশই হয়ে গেলাম। সবাই কত বাহারি রকমের বৈচিত্র‍্যপূর্ণ জিনিস দিয়েই না স্টল সাজিয়েছে! নিজের স্টলটা আমার মনে তুচ্ছতায় গড়াগড়ি খেতে লাগল?

যাই হোক, আমি চানাচুর, চিড়া, খেজুরের গুড়, মুড়ি, মুড়ালী, সন্দেশ প্রভৃতি জিনিস দিয়ে আমার টেবিলটা ভরে ফেললাম। খুব সস্তা দামের জিনিস। তেমন জৌলুস নেই। তাই খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম। বাকি সব দেশের স্টলের এত শানশৌকতের মাঝে আমি নিস্প্রভ হয়ে গেলাম। এ নিয়ে মনের ভিতর একটা অস্বস্তি কাজ করতে লাগল। তবুও মনোবল হারালাম না।

এদিকে স্টলের সাজসজ্জা শেষ করে রুমে গিয়ে আবার নিজেদেরও সজ্জিত হয়ে আসতে হল। কেউ পরল তার জাতীয় ড্রেস, আবার কেউবা পুলিশের সেরেমোনিয়াল কিংবা ওয়ার্কিং ড্রেস। আমি আমাদের ওয়ার্কিং ইউনিফর্মটি পরে স্টলের অলঙ্কার হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।

বাকিদের ড্রেসের রং এবং ধরণের কাছে নিজের ড্রেসটা কেন যেন খুব সাদামাটা মনে হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও হাসি হাসি মুখ নিয়ে পতাকার সম্মানার্থে একটা আন্তর্জাতিক যুদ্ধের দামামাতে নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিলাম।

অতি আকাঙ্ক্ষিত ‘ইন্টারন্যাশনাল নাইট’ শুরু হয়ে গেল। অল্প সময়ের মধ্যে চারিদিক লোকারণ্যে ভরে গেল। দর্শক কিংবা অতিথি হিসেবে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৯ জন সিনিয়র পুলিশ অফিসার যারা সবাই আমাদের কোর্সমেইট-বন্ধু, ২৫-৩০ জন এফবিআই ন্যাশনাল একাডেমীর ফ্যাকাল্টি মেম্বার/আয়োজক, আর ৮/১০ জন এফবিআই হেডকোয়ার্টার, ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আসা উচ্চদস্ত কর্মকর্তা।

তবে উপস্থিত সবাই পরষ্পরকে ভালভাবেই চিনতাম এবং জানতাম। তাই সকলের চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল মুগ্ধ হবার আগাম প্রস্তুতির ছাপ।

ঘুরে ঘুরে সবাই স্টলগুলো দেখা শুরু করল। যার যে খাবারটা পছন্দ হচ্ছে তা খাচ্ছে। যার যে স্যুভেনির ভাল লাগছে সেটা হাতে তুলে নিচ্ছে। কেউ ছবি তুলছে, আবার কেউ অনুসন্ধিৎসু মনে নানা প্রশ্ন করছে।

মুহূর্তে মধ্যেই আমার স্টলের সামনে একটা জটলা বেঁধে গেল। মদ, হুইস্কি, বিয়ার আর শুকরের মাংস দিয়ে বানানো খাবারের মাঝে আমার স্টলের খাবারগুলোর বৈচিত্র‍্য সবাইকে খুব মুগ্ধ করে বসল। সবাই খুব উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে আমার স্টলের খাবারগুলো দেখতে লাগল।

এলিয়েনদের মত ভাব নিয়ে তারা দেখছে আর প্রশ্ন করছে- এটা কি, ওটা কি, এটা কি দিয়ে বানানো ইত্যাদি। মুহুর্তের মধ্যে আমার স্টলের সবগুলো খাবার প্রায় শেষ হয়ে এল। আমি বেকার হয়ে শূণ্য স্টলের সামনে বুক ভরা গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

এরপর আমার স্টলের সামনে আরেকটা ছোটখাট লাইন লক্ষ্য করলাম। সবাই আমার সাথে ছবি উঠানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমার সেই অখ্যাত ইউনিফর্মটা নাকি তাদের খুব মনে ধরেছে। পুলিশের এই স্টাইলের ইউনিফর্ম নাকি তারা আগে কখনও দেখেনি। ইউনিফর্মের ডিজাইন, রং, পরিধান স্টাইল - সবই নাকি অন্য রকম। তাই আমার সাথে একটা ছবি তুলে তারা সেটা সংরক্ষণ করতে চাইল।

আমি তৃপ্ত, মহা তৃপ্ত হয়ে পতাকা ঘেষে দাঁড়িয়ে তাদের সাথে ছবি তুলতে থাকলাম যাতে প্রতিটা ছবিতে আমাদের পতাকাটা দেখা যায়। টেবিলে বাংলার ঐতিহ্য, গায়ে ভালবাসার ইউনিফর্ম আর কাঁধের উপর পতাকার উঁকিঝুঁকি আমাকে শ্রেষ্ঠত্বের সম্মানে বসিয়ে দিল। বৈচিত্র‍্যগত দিক দিয়ে আমি বেস্ট স্টলের মর্যাদা নিয়ে প্রোগ্রাম শেষ করে রুমে ফিরে গেলাম।

সেদিনের সেই ভাললাগাটুকুর রেশ রয়ে গেল প্রায় বেশ কদিন। যেখানেই যে দেখে সে-ই বলে উঠে "ব্যাংলাদেশ ইজ বেস্ট। আই লাইকড দোজ থিংস"।

সেদিন বুঝেছিলাম কোন দেশ বা জাতির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি কখনও ছোট হতে পারে না, বরং এসবের মধ্যে যত বেশী বৈচিত্র্য থাকবে ততই বেশী আকর্ষণীয় এবং অনুকরণীয় হবে। সংস্কৃতিতে জৌলুস আর গর্জিয়াস ভাবটা থাকার চেয়ে ব্যতিক্রমী আর বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়াটাই জরুরী।

এ কারণে ছোট ছোট জাতিও তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি দিয়ে বড় কোন জাতিকেও গ্রাস করতে পারে। যে সুযোগটা আমাদের আছে বলেই সেদিন ‘বেস্ট’ হয়েছিলাম।’


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন

Wordbridge School
Link copied!