• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে ইংরেজি ও বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ধারা


সোনালী বিশেষ জানুয়ারি ১, ২০১৮, ০৪:৪১ পিএম
বাংলাদেশে ইংরেজি ও বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ধারা

ঢাকা : পয়লা বৈশাখ বাঙালির একান্ত নিজস্ব। তবে আজকের দিনে পয়লা জানুয়ারিকেও সাদর অভ্যর্থনা জানাতে সে ভোলে না। শহুরে বাঙালি তাই বছরে দু’বার নববর্ষকে বরণ করে।

বাংলাদেশের মানুষ অর্থাৎ বাঙালি অন্যদের তুলনায় এই ভেবে অনায়াসে গর্ব করতে পারে যে, তাদের নিজস্ব বর্ণমালা এবং বর্ষপঞ্জি রয়েছে, যা বিশ্বের অনেক বিখ্যাত জাতিরও নেই। নিজস্ব বর্ষপঞ্জি থাকার কারণে বাঙালি বছরে দু’বার বর্ষবরণ করে। এক তার পয়লা বৈশাখ। আরেকটা হলো ১লা জানুয়ারি। বাঙালি একবার বলে শুভ নববর্ষ। আরেকবার বলে হ্যাপি নিউ ইয়ার। অনেকে অবশ্য ১লা জানুয়ারিতেও শুভ নববর্ষ বলে কিন্তু ১লা বৈশাখে হ্যাপি নিউ ইয়ার কখনোই নয়। ১লা বৈশাখে সরকারি ছুটি। ১লা জানুয়ারি ছুটিহীন।

যে বর্ষে ৩১শে ডিসেম্বর পেরিয়ে ১লা জানুয়ারি আসে, সেই বর্ষটিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি বলে ইংরেজি সাল। প্রায় প্রত্যেকটা দৈনিক পত্রিকা ইংরেজি নববর্ষকে স্বাগত জানায়। অনুষ্ঠানমুখর টিভি চ্যানেল ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানো হয়। অনেকগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলিতে নববর্ষ উপলক্ষ্যে তাদের বিজ্ঞাপনে বলে থাকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা।

তবে সব পত্রিকা বা সব টিভি চ্যানেলই যে ইংরেজি নববর্ষ বলে তা কিন্তু নয়। তারা বলে খ্রিষ্টীয় নববর্ষ। তাদের যুক্তি ইংরেজি নববর্ষ বলে কিছু নেই। এ দেশে ইংরেজদের দুশো বছরের শাসনের সূত্রেই খ্রিষ্টীয় সাল ইংরেজি সাল নামে পরিচিত গেছে। জার্মান অথবা ফরাসিরা কি সালটাকে ইংরেজি সাল বলে? আমরা কি এখনো ইংরেজদের অধীনে?

বাঙালি একই সঙ্গে জাতিক এবং আন্তর্জাতিক। ফলে দুটো নববর্ষই প্রচুর সমারোহের সঙ্গে উদযাপিত হয়। তবে উদযাপনের ধরনটা সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলা নববর্ষ বরণ করা হয় সূর্যোদয়ের পর। দেশের নানান প্রান্তে আয়োজন করা হয় নানা ধরনের লোকজ অনুষ্ঠানের। রাজধানী ঢাকার রমনায় মাটির সানকিতে পান্তাভাত আর ইলিশ মাছ খেয়ে অনেকে স্বাদ বদল করে বাঙালি সংস্কৃতির অনুগত হওয়ার চেষ্টা করে। ঢাকায় দেখাদেখি দেশের অন্যান্য বড়ো শহরেও অনেক বাড়িতে পয়লা বৈশাখের দিন পান্তাভাতের চল শুরু হয়েছে। তবে এ সবই শহরের ব্যাপার। বাংলাদেশে যাদের দিন আজীবন পান্তাভাতেই সমর্পিত তারা নববর্ষ পালন করে কি না অথবা স্বাদ বদলের জন্য তাদের জন্য সেদিন লোভনীয় কিছু জোটে কি না সে খবর কোথাও ছাপা হয় না, কোনো চ্যানেল প্রচারও করে না।

আন্তর্জাতিক যে খ্রিষ্টিয় নববর্ষ তা বরণ করার আয়োজন শুরু হয় সন্ধ্যার পর প্রধানত ঢাকায় সেই সঙ্গে চট্টগ্রামে এবং কিছুটা অন্যান্য বিভাগীয় শহরে, জেলা শহরে এবং কক্সবাজার ও কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকতে। দেশের সাধারণ মানুষ যখন ঘুমানোর আয়োজন করে কিংবা ঘুমিয়ে পড়ে তখন শুরু হয় ৩১শে ডিসেম্বরে রাতের অংশ যা এদেশে থার্টি ফার্স্ট নাইট নামে সমধিক নামে পরিচিত।

তারপরেই আসে ১লা জানুয়ারি। শুরু যায় হ্যাপি নিউ ইয়ার। ১লা জানুয়ারি কিংবা থার্টি ফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠান যে গুলো পাঁচতারা হোটেলে হয় সেখানে প্রচুর পানভোজনের আয়োজন থাকে তবে তা আদৌ পান্তাভাত নয়, সেখানে থাকে ভিনদেশি পানি ও পানীয়। ঢাকার ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী আর বারিধারার প্রত্যোকটি দামি হোটেল রেষ্টুরেন্ট সজ্জিত হয় বহুবর্ণিল আলোকমালায়। থাকে নাচ গানের উদ্দাম আয়োজন। আরো থাকে আতসবাজি ও লেজার শো। এই আয়োজনে সামিল হয় সমাজের বিত্তবান তরুণ সমাজ।

তবে যাদের বিত্ত তেমন নেই কিন্তু চিত্ত বিত্তহীন নয় তারা জড়ো হয় ঢাকায় প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় টি.এস.সি চত্বরে এবং বেশ কিছু এলাকায় আয়োজিত কনসার্টে। এ সব কনসার্টের আয়োজক বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানি। এরা অবশ্য ‘ধর্মেও আছে জিরাফেও আছে’ কারণ হাল আমলে এরা ১লা বৈশাখেও কনসার্টের আয়োজন করে এবং এতে পয়সা ঢালে। বেশ কয়েক বছর হলো তরুণদের থার্টি ফার্স্ট নাইট কিছুটা অখ্যাতির কারণ হয়েছে।

কারণ হিসেবে সংবাদপত্রে বলা হয়, ধনীর সন্তানদের উচ্ছৃঙ্খলতা। আর পুলিশের ভাষায় তা রাস্তায় অজ্ঞাত তরুণদের বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি। এগুলো ঠেকাতে বেশ কয়েক হাজার পুলিশ নামাতে হয় ৩১শে ডিসেম্বরের সন্ধ্যায়। পুলিশের থার্টি ফার্স্ট নাইটও নেই, নিউ ইয়ারও নেই। বাংলাদেশে নিউ ইয়ার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিও রয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ব্যাংকগুলো নতুন বছর উপলক্ষ্যে নানান রঙের ও ঢঙের ক্যালেন্ডার ছাপে, ডায়রি বানায়। সরকারের তরফ থেকেও ছাপা হয় ক্যালেন্ডার। সরকারের বড়ো এক পাতার ক্যালেন্ডার শোভা পায় সব অফিস কক্ষে। এগুলো বাজারেও বিক্রিও হয়। ব্যাংকের বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্যালেন্ডার ও ডায়রি বিলি হয়। মক্কেলরা তা পেয়ে থাকেন। আর পান কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন। প্রতিষ্ঠানগুলো নিউ ইয়ার উপলক্ষে শুভেচ্ছা কার্ডও ছাপে এবং গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের কাছে পাঠায়।

ব্যক্তিগত পর্যায়েও শুভেচ্ছা কার্ড পাঠানো হয়। এ সব কার্ড বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। তবে ইদানিং এস.এম.এস, ই-মেইল আর ফেসবুকের চাপে কার্ডের বাজার এখন মন্দা। টিভি চ্যানেলগুলিতে শুরু হয় বিশেষ অনুষ্ঠান। সংবাদপত্রগুলো বের করে বিশেষ নববর্ষ সংখ্যা বাড়তি কয়েক পাতা নিয়ে। এতে থাকে বছরের সালতামামি এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনার মূল্যায়ন। অনেক পত্রিকার সঙ্গে এক পাতার রঙিন ক্যালেন্ডার পাওয়া যায় বিনামূল্যে। কিছু সাপ্তাহিক ও পাক্ষিকে ভাগ্যবিড়ম্বিত নিম্নবিত্তদের জন্য অতিরিক্ত সংখ্যা হিসেবে বের করা রাশিচক্র।

খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপনের আন্তর্জাতিকতার নানান ছোঁয়া এখন বাংলাদেশেও। বিভিন্ন দামি বুটিক হাউস এবং আসবাবপত্রের দামি দোকানে থাকে বিশেষ ‘সেল’। পরস্পর দেখা হলে কিংবা টেলিফোনে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। এগুলো বেশি হয় অফিসে অফিসে কর্মকর্তাদের মধ্যে। একজন পিয়ন কিংবা একজন সহকারী তার অফিসারকে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলছে এমন নজির পাওয়া মুশকিল।

নববর্ষ উদযাপনের এই ব্যাপারটা রয়ে গেছে নিতান্তই সমাজের সীমিত অংশে। অধিকাংশের কাছে ৩১শে ডিসেম্বর আর ১লা জানুয়ারিতে বিন্দুমাত্র তফাত নেই। ঢাকা শহরে যাদের বাস তাদের কাছে এই নিউ ইয়ার ভয়াবহ বিভীষিকা। কারণ নববর্ষ উপলক্ষ্যে বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াকে হ্যাপি নিউ ইয়ার বলে বাড়িভাড়া হাসতে হাসতে বাড়িয়ে দেয়। তারপরেও নববর্ষ আসে। মুখে হাসি এনে বলতে হয় স্বাগত ২০১৮।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!