• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাজেট: অনেক প্রশ্ন, মেলেনি উত্তর


জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জুন ২, ২০১৭, ০৮:৩৮ পিএম
বাজেট: অনেক প্রশ্ন, মেলেনি উত্তর

সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত

ঢাকা: জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পেশের পর সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রথা অনুযায়ী শুধু সাংবাদিকদের জন্য এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও সাংবাদিকদের অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি মন্ত্রীদের কাছ থেকে।

শুক্রবার (২ জুন) বিকেলে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ ছাড়াও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান উপস্থিত ছিলেন। তাদেরকে সহযোগিতা করতে পাশেই একটু পিছনে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব কাজী শফিকুল আযম প্রমুখ।

নিজে প্রশ্ন নিলেও অর্থমন্ত্রী কোনো কোনো সময়ে কৃষি, পরিকল্পনা ও শিল্পমন্ত্রীকে উত্তর দেয়ার জন্য বলেছেন। পাশাপাশি এনবিআর চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে বলেছেন উত্তর দেয়ার জন্য। সাংবাদিকরা সরাসরি অনেক প্রশ্ন করলেও কিছু প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন, কিছু প্রশ্নের উত্তরে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন, আবার কিছু ক্ষেত্রে দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে গণমাধ্যমের সহযোগিতা চেয়েছেন। যেনো সরকারের কিছুই করার নেই।

সাংবাদিক আনিস নূর প্রশ্ন করেছিলেন, অর্থমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশু। এ হিসাবে ঢাকা শহরে ৮০ লাখ শিশু রয়েছে, নতুন নতুন আবাসিক প্রকল্পে তাদের খেলার জন্য কোনো মাঠ নেই। ঢাকা শহরেও মাঠ কমছে। সামাজিক নিরাপত্তা দিতে এই বাজেটে কোনো নির্দেশনা আছে কি-না?

এর উত্তরে অর্থমন্ত্রী হ্যাঁ সূচক বক্তব্য দিলেও নীতি নির্ধারণে কোনো সুর্নিষ্ট কথা বলেননি সরকারের এই  প্রভাবশালী মন্ত্রী।

কয়েকজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, হঠাৎ করেই চালের দাম বেড়েছে, গত বছরের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে এবার কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে । এ প্রশ্নের উত্তর দিতে কৃষিমন্ত্রীকে বলেন অর্থমন্ত্রী। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, হাওরে বন্যার জন্য চালের দাম বাড়তে পারে। আমাদের যথেষ্ট খাদ্য মজুদ আছে, জি-টু-জি পদ্ধতিতে ভিয়েতনাম থেকে চাল আনার জন্য সরকার দরপত্র ওপেন করেছে। হাওর অঞ্চলে আমরা ওএমএস এর মাধ্যমে হতদরিদ্র্যদের মাঝে কম দামে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাম বাড়িয়ে বলার অভ্যাস আছে আমাদের।

এসময় এক সাংবাদিক মনে করিয়ে দেন, হাওরে মাত্র ১৫ লাখ টন শস্য নষ্ট হয়েছে, কিন্তু তার প্রভাব এতো দ্রুত চালেরবাজারে পড়ার কথা নয়। সরকারের তো খাদ্য মজুদ আছে। ব্যবসায়ীরা মাঝখান থেকে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে সরকারের করণীয় কী?

এর উত্তরে কৃষিমন্ত্রী একই কথা বলেন। 

লোডশেডিং নিয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময়ে লোডশেডিং ছিল ১৬ ঘণ্টার, এখন ১৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে..তাহলে এতো লোডশেডিং কেন? তাহলে কী রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদন করছে না? 

এর উত্তরে কৃষিমন্ত্রী বলেন, আপনারা জানেন, কয়েকদিন আগে একটি বিদ্যুতের বড় টাওয়ার ভেঙে গিয়েছিল, সেজন্য বিদ্যুৎ সরবরাহে সমস্যা হয়েছিল। আগে তো বিদ্যুৎ উৎপাদনই হতো না, বিদ্যুৎ ছিল না, তাই হিসাব ছিল না। এখনবিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, তাই লোডশেডিংয়ের হিসাব করা হচ্ছে।

একাধিক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি পূরণে সৎ করদাতাদের টাকা অসৎ কর্মকর্তার দুর্নীতির জন্য দেয়া হবে কেন? এভাবে কতদিন চলবে?

এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য পরিকল্পনামন্ত্রীকে বলেন অর্থমন্ত্রী। পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো সরকারের অনেক কাজ করে টাকা ছাড়া। সকল ভাতা প্রদান, বেতন ও টেন্ডারসহ অনেক কাজ করে। তারা বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো লাভজনক কাজ করতে পারে না। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে মূলধন দেয়া হয়।

এ উত্তরের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরও একমত পোষণ করেন।

প্রসঙ্গত, মানসম্পন্নভাবে ঋণ বিতরণ না করায় ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে পড়েছে সরকারি ব্যাংকগুলো। এতে খেলাপী ঋণ বেড়েছে অনেক। রাজনৈতিক চাপে ঋণ বিতরণ করায় খেলাপী হয়েছে বেশি। ব্যাংকগুলো লাভজনক হলেও মুনাফার টাকা চলে যাচ্ছে ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে। গত ডিসেম্বরেও রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যংক লাভজনক ছিল। কিন্তু সর্বশেষ মার্চ মাসে এসে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। রাজধানীর বনানীতে আলোচিত ধর্ষণ মামলার ঘটনাস্থল হোটেল রেইন্ট্রির মালিক হলেন, সরকার দলী সংসদ সদস্য বিএইচ হারুন। ক্ষমতার প্রভাব কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই ৩০ কোটি টাকা ঋণের ১৫ কোটি টাকা ছাড় করিয়ে নেন রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক থেকে। শাখা ম্যানেজার দিতে না চাইলে তাকে অন্যত্র বদলী করে রূপালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পরে নতুন ম্যানেজারের মাধ্যমে এই ঋণ দেয়া হয়।

এভাবেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খেলাপী ঋণে জর্জরিত। রাষ্ট্রের কাজতো নামে মাত্র। সকল শাখাও সরকারের সব কাজে সমানভাবে জড়িত থাকে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ বাণিজ্যিক ও দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ১৪ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেও (২০১৬-১৭) সরকার সরকারি ব্যাংকগুলো ২ হাজার কোটি টাকা মূলধন যোগানের জন্য বরাদ্দ রেখেছে।

এমন বাস্তবতায় মন্ত্রী ও গর্ভনরের বক্তব্যে উপস্থিত সাংবাদিকদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়।

গ্যামের দাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১জুন তারিখ থেকেই বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী কোনো কথাই বলবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।

এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, সরকার বর্তমানে ১০৪৩টি পণ্যকে ভ্যাটের আওতামুক্ত করেছে বলে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু এমন অনেক পণ্য আছে যা, কোনো নাগরিকের কোনোদিনই প্রয়োজন হবে না। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে, এমন পরিস্থিতিতে সরকার কিভাবে মূল্যস্ফীতি আগামী বাজেটে ৫.৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনবে? এর উত্তরে অর্থমন্ত্রী কোনো কিছু না বলে পরিকল্পনামন্ত্রীকে বলতে বলেন।

পরিকল্পনা মন্ত্রীও বলেন, বিগত সময়ে মূল্যাস্ফীতি ৭ শতাংশের ওপরে ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তা নামিয়ে এখন ৬ শতাংশের নিচে এনেছে। তাই এই সরকার পারবে মূল্যস্ফীতি কমাতে। এসময় প্রশ্ন করা হয়, পরিকল্পনা কমিশন গঠনের ১৯৭৪ সাল থেকেই মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রতিমাসেই প্রকাশ করা হচ্ছে। এবারই প্রথম ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে করা হচ্ছে কেন? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি উপস্থিত চারমন্ত্রীদের একজনও।

অবশ্য শিল্পমন্ত্রী এক প্রশ্ন প্রসঙ্গে বলেন, পুরো মুসলিম বিশ্বের মানুষ ১১ মাস ব্যবসা করে, রামজান মাসে ছাড় দেয়। আর আমাদের দেশে উল্টো। রমজান মাসেই তারা ব্যবসা করে। এদের নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন দরকার। বাংলাদেশে আইন ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। দেশের মানুষের দেশপ্রেমে ঘাটতি রয়েছে। এজন্য আকারেণই জিনিপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। বিষয়টি পত্রিকায় ভালোভাবে লেখার জন্য তিনি সাংবাদিকদের সহযোগিতা চান।

এছাড়াও বিএনপি সরকারের সময়ে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ৯১ সালে প্রথম ভ্যাটের ওপর জোর দেয়া শুরু করেন। তখন  আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থেকে এই ভ্যাটের বিরোধিতা করেছিল। এখন এই সরকার আবার কেন ভ্যাট নির্ভর হচ্ছে সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী কিছুই বলেননি।

এভাবেই চলতে থাকে অর্থমন্ত্রীর পৌনে দুই ঘণ্টার বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন। সোয়া তিনটার দিকে শুরু হওয়া সংবাদ সম্মেলন শেষ হয় বিকেল ৫ টার সময়ে।

এসময় দর্শক সারিতে প্রথমদিকে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, মূখ্যসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম ছাড়াও ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত রয়েছেন।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/তালেব

Wordbridge School
Link copied!