• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাবা-মা নেই, আমার জীবনে ছিল শুধু মিতু


নিজস্ব প্রতিবেদক মার্চ ১৫, ২০১৮, ০৬:১২ পিএম
বাবা-মা নেই, আমার জীবনে ছিল শুধু মিতু

ঢাকা: আমার জান, আমার কলিজা, কেন তুমি আমাকে ভীষণ একা করে দিয়েছ? তুমি ছিলে আমার জীবনের সেরা পাওয়া। তুমি সবসময়, প্রতিটি দিন, প্রতিটি সেকেন্ড আমাকে পরিপূর্ণ করেছ। তুমি প্রতিমুহূর্ত আমার বেঁচে থাকার কারণ। তুমি তো জানতে, তা হলে কেন আমার বুক থেকে সারাজীবনের জন্য আকাশে লুকিয়ে গেলে?

এসব কথা লিখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন কাঠমান্ডুতে বিমান বিধ্বস্তে নিহত বিলকিস আরা মিতুর প্রবাসী স্বামী আজিজুল হক। তিনি নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফেরার পথে স্ত্রীকে নিয়ে বুধবার ফেসবুকে ইংরেজিতে একটি মর্মস্পর্শী স্ট্যাটাস দিয়েছেন। 

তিনি লিখেন, তোমাকে বলেছিলাম- আমি এতিম-অনাথ এবং তুমিই একমাত্র যে আমার দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছ। আমার কলিজা, আজ তোমার জন্মদিন। কিন্তু আমি কীভাবে সবসময়ের মতো আজ তোমার জন্মদিনটি উদযাপন করব। কীভাবে আমি কেকের টুকরো তোমার নাকে লাগিয়ে দেব, কীভাবে আমি দুষ্টুমি করে কেক খাইয়ে দেব?’

আজিজুল লেখেন, ‘বেহেস্তে তুমি শান্তিতে থাক। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া কিছুতেই আমি থাকতে পারছি না। কোনোভাবে বোঝাতে পারছি না।’

গত সোমবার (১২ মার্চ) ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিএস ২১১ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এতে ৫১ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে ২৬ জন বাংলাদেশি নিহত ও ১০ বাংলাদেশি আহত হন। 

কিন্তু তখনও আজিজুল হক জানতেন না তার প্রিয় স্ত্রী বিলকিস আরা মিতু (২৬) মর্মান্তিক ওই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। ফ্লাইট বিধ্বস্তের পর ফেসবুকে স্ট্যাটাসে নিজের মর্মাহত হওয়ার কথা লেখেন আজিজুল।

তিনি লিখেছিলেন- ‘মাঝে মাঝে কিছু সকাল অভিশপ্ত মনে হয়। তেমনি একটা সকাল শুরু হল দুটি অত্যন্ত বাজে মর্মান্তিক দুঃসংবাদ দিয়ে। ঢাকার মিরপুর-১২ আগুনে পুড়ে তছনছ, আবার ইউএস-বাংলার একটি বিমান নেপালের কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের রানওয়েতে বিধ্বস্ত হয়েছে যাতে অনেক বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’ 

রাজশাহীর শাহ মাখদুম থানার সপুরা এলাকার নওদাপাড়া রোডের মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া ও মনোয়ারা বেগমের দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে মিতু ছোট। নিউইয়র্কের হাডসনে স্বামীর সঙ্গে বসবাস করতেন মিতু। দিন কয়েক আগে মায়ের অসুস্থতার কারণে তিনি বাংলাদেশে আসেন। এরপর সোমবার নেপালে বেড়াতে যাচ্ছিলেন তিনি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সক্রিয় থাকার সুবাদে মিতু ছিলেন নিউইয়র্কে অনেকের পরিচিত। তার মৃত্যু সংবাদে নিউইয়র্কের ঘনিষ্ঠজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। মিতুর স্বামী আজিজুল হক ফায়ারম্যানস এসোসিয়েশন অব দ্য স্টেট অব নিউইয়র্কের স্টাফ নার্স।

গত ১১ মার্চ ভোর ৩টা ২৩ মিনিটে নিজের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আপলোড করে স্ট্যাটাস দেন মিতু ইসলাম। সেখানে তিনি লিখেন, ‘আহা পারিতাম, যদি পারিতাম/ আঙুলগুলো ছুঁয়ে থাকতাম/ বিষাদের জাল, টালমাটাল/ এ কোন দেয়াল, এ কোন আড়াল/ ছাই হয় গোধূলি, কারে যে বলি/ এ কোন শ্রাবণ পথে হয়ে চলি...।’

বিমান দুর্ঘটনার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও মিতু ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন। মিতুর নিউইয়র্ক প্রবাসী এক বান্ধবী রোববার দিবাগত রাত ১২টা ৪৬ মিনিটে অর্থাৎ সোমবার বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা ৪৬ মিনিটে নিজের কয়েকটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন। তার কিছুক্ষণ পরেই ওই পোস্টে কমেন্ট করেন মিতু। তিনি লিখেন, ‘ওয়াও, লাভলি অ্যান্ড স্মার্ট অ্যান্ড কিউট’।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিতুর ওই বান্ধবী বলেন, ‘আমি ফেসবুকে কয়েকটি ছবি পোস্ট করার পর দ্বিতীয় কমেন্টটি ছিল মিতুর। এরপর আমি তার সাথে ম্যাসেঞ্জারে কথা বলি। কিন্তু সে যে এভাবে চলে যাবে ভাবতে পারছি না।’ 

জানা গেছে, আর দুদিন পরই মিতুর জন্মদিন। ১৫ মার্চ জন্মদিনটি তার ঢাকায় বাবা-মা ও একমাত্র ভাইয়ের সঙ্গে পালন করার কথা ছিল।

পারিবারিক সূত্র জানা গেছে, ২০১৪ সালে নিউইয়র্ক প্রবাসী মার্কিন নাগরিক আজিজুল হকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নিউইয়র্কে পাড়ি জমান মিতু। হঠাৎ পারিবারিক কারণে তিনি ঢাকা যান। সেখান থেকে ১২ মার্চ সোমবার ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে নেপালের কাঠমান্ডু রওয়ানা দেন।

নিউইয়র্কে আসার পর স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে একাউন্টিং এন্ড ফিনান্স নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন মিতু।

দেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি পত্রিকার প্রতিবেদকের কাছে আজিজুল হক বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমার বাবা-মা নেই, আত্মীয়স্বজন নেই, আমার জীবনে ছিল শুধু স্ত্রী মিতু। আমি তাকে খুব ভালোবেসেছিলাম।

তিনি আরও বলেন, ‘মিতুর সুবিধার জন্য তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বাড়ি কিনে দিয়েছিলাম। মিতু বলেছিল, পড়াশোনার ব্যস্ততায় সে খুব ক্লান্ত। তাই দেশ থেকে ঘুরে আসতে চায়। দেশে যাওয়ার জন্য সে আমার কাছে অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু আমি কেন যে অনুমতি দিয়েছিলাম!’

গত সোমবার নেপালের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত স্ত্রী মিতু তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল বলে জানান আজিজুল।

তিনি বলেন, ‘ফেসবুকে তার বিভিন্ন রকমের ছবি আমাকে ট্যাগ করছিল। রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ছবি, ঘুরে বেড়ানোর ছবি, সব...। কিন্তু সে যে নেপাল যাচ্ছে এ কথাটি আমাকে বলেনি।

সোনালীনিউজ/জেএ

Wordbridge School
Link copied!