• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাবা মার আরেকটু ভালোবাসা পেলে অনেক বড় হতে পারতাম...


ফেসবুক থেকে ডেস্ক জানুয়ারি ১২, ২০১৭, ০৭:৩০ পিএম
বাবা মার আরেকটু ভালোবাসা পেলে অনেক বড় হতে পারতাম...

বাবা-মায়ের আদেশ বা নির্দেশ যখন সন্তানেরা শুনতে চায়না তখন সেটা তাদের জন্য খুবই হতাশাজনক হয়। কিছু বাবা-মা সন্তানের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় হতাশ হয়ে কঠিন কোন কাজ করে ফেলেন। আবার কিছু বাবা-মা চিৎকার করে বিরক্তি প্রকাশ করে থাকেন। বাবা-মায়ের কিছু ভুলের কারণেই আসলে এই রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আর বাবা মায়ের এই সব ছোট ছোট ভুলই কোন কোন সন্তানের কাল হয়ে দাঁড়ায়।

আবার অনেক সন্তানের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। কিন্তু এমনই ভুল বাস্তবে বরগুনা জেলার সনামধন্য একটি পরিবারে ঘটে। কিন্তু তাই বলে সেই বাবা-মায়ের সন্তানের জীবনে কিন্তু নেমে আসেনি অন্ধকার। বরং শত কষ্টের মধ্যেও নিজেকে তৈরি করেছে দক্ষ ও মেধাবী একজন আইনজীবী হিসেবে।  বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) অ্যাড. মো. মাইনুল ইসলাম তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে তার জীবনের কয়েকটা কষ্টের অংশ তুলে ধরেছেন তার বন্ধুদের সামনে। তার সেই স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

সবেমাত্র এসএসসি পাস করে কলেজ ক্যাম্পাসে পা রাখবো বলে ভাবছি। মা বাবার অবহেলিত সন্তান আমি, তাই যেকোন ভাবে বাড়ি থেকে তাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে। অন্যদিকে চলছে বাল্যপ্রেমিকার মায়ের কুপরামর্শ। সবমিলিয়ে বরিশালের অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পা রাখার দুর্ভাগ্যটা হল বটে।

বাবা বেশ একটা অবহেলার সাথেই গীর্জামহল্লার শত বছরের পুরানো বি.আই হোস্টেলে ছেড়ে এলেন আমাকে। কিছুই চিনতাম না বরিশাল শহরের। বাবা বেশ সম্পদশালী ছিলেন বলেই জানতাম। কিন্তু বাল্যপ্রেমের অপরাধে আমার জন্য বাবার বরাদ্দটা এতই কমে গেল যে, পড়ালেখা তো দূরে থাক তিন বেলা পেট ভরে খাবারটাই বড় চিন্তা হিসেবে সামনে দাঁড়ালো। তার উপরে বাল্যপ্রেমিকার লালজামার বায়না আর হবু শ্যালকশ্যালিকার খেলনার বায়না, সবমিলিয়ে এক করুন জীবনযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল আমার।

দুটো বিষয়ের প্রাইভেট, ৩০ দিনের খাবার, হোস্টেলে ছিট ভাড়া সব মিলিয়ে আমার জন্য বাবার বরাদ্দ ১৫শ’ টাকা। যাতায়াতের একমাত্র বাহন বাইসাইকেলটা বিক্রি করে বাল্যপ্রেমিকার জন্য শাড়ী কিনে দিয়েছিলাম আগেই। তাই প্রতিদিন দুইয়ে দুইয়ে চার কিঃমিঃ পার হয়ে কলেজে আর তিন তিন ছয় কিঃমিঃ পার হয়ে দুটো প্রাইভেটে যাবার জন্য দুই পাই ছিল একমাত্র ভরসা।

পথিমধ্যে একটা সিঙ্গারা খাওয়ার সামর্থ্য পকেটের ছিলনা। দিন শেষে বড়ই ক্লান্ত মনে হত তাই পড়ার টেবিলে বসার শক্তি প্রায়শই হতনা। কিছুদিন পরে বকেয়া বিলের দায়ে ম্যাচ ম্যানেজার বন্ধ করে দিলো আমার দুপুরের খাবার। অবশিষ্ট রইলো সকাল আর রাতের খাবার। এক বন্ধুর মাধ্যমে হাসপাতাল রোডে একটা টিউশনি জুটিয়ে নিলাম। সকাল ৮টায় পড়াতে হত ৮ম শ্রেণির তাপশিকে। ম্যাচের সকালের সবজি, ডাল আর ভাত রুমে এনে জমিয়ে রাখতাম দুপুরের জন্য। সকালের নাস্তাটা তাপশিদের বাসার কলা, রুটিতেই হয়ে যেত। দুপুরে ফিরে দেখতাম জমানো খাবারে পিঁপড়ে ভাগ বসিয়েছে। তারপরেও পেট বলে কথা।

কত দিন যে চিড়ে ভিজিয়ে খেয়ে কাটিয়েছি হিসেব নেই। বন্ধু অ্যাডভোকেট রিয়াদ আজও বলে ‘চিড়ে খাবি?’ বড় সখ ছিল মাসের প্রথমে টাকা পেলে হোটেলে বসে চটপটি আর পুড়ি খাব। আমার বড় বোন থাকতেন বনমালী হোস্টেলে। মায়ের বানানো পিঠা আর নাড়ুর পার্সেলটা নিয়ে ডাকবিভাগের লোক একবারও আসেনি আমার ঠিকানায়। মাঝে মাঝে বড় বোনের হাতে পিঠা, নাড়ু দেখে জানতে চাইতাম কে পাঠিয়েছে? খেয়েও নিতাম দু,চারটা। প্রায়শই তাকিয়ে থাকতাম হোস্টেলের সামনের জেমিনিস নামক দোকানে টানানো দামী প্যান্ট, গেঞ্জির দিকে। ১৫শ’ টাকা মাসের ১০/১২ তেই ফুরিয়ে যেত তাই দামী পোশাকের কথা মাথায় আনতে সাহস হতনা। আজও বাড়ীর দোতালায় ছোট ভাইয়ের ফেলে রাখা এক/দেড়শ দামী জিংস প্যান্টের দিকে তাকিয়ে সেই দিনগুলির কথা খুব মনে পড়ে। শুনেছি এখন বাবার টাকায় নাকি সিগারেট কোম্পানির বেচাকেনাও ভালই হয়। মনের অজান্তে কখন যে চোখ ভিজে যায় জানিনা।

একদিন পেটের বায়নায় ম্যাচের ডায়নিংয়ে অবশিষ্ট ডাল ভাত খেতে গিয়ে ভাত চুরির অপবাদ ও মাথা পেতে নিতে হয়েছিল। দাড়াতে হয়েছিল হোস্টেল সুপারের বিচারের কাঠগড়ায়। একবার অতিকষ্টে এক হাজার টাকা জমিয়েছিলাম তাও এক বড় ভাই ট্রাংক থেকে চুরি করে নিয়েগিয়েছিল। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বরগুনায় এসেছিলাম।

আজও বরিশাল গেলে আমার সেই প্রিয় হোস্টেলের জন্য একবার হলেও কিছু সময় বরাদ্দ রাখি। আজও কিন্তু আমার হোটেলে চটপটি, পুড়ি খাওয়ার কপাল হয় না। কারণ সেদিন হোটেল খোলা ছিল কিন্তু পকেটে কিছুই ছিলোনা। আর আজ যখন কাজ শেষে ভরা পকেটে ফিরে আসি তখন হোটেলগুলো সব শাটার লাগানো থাকে।

জলভরা চোখে শুধু বলি বাবা মা তোমাদের পায়ের নিচে আমার জান্নাত। আর একটু যদি ভালোবাসা দিতে হয়ত আরো অনেক বড় হতে পারতাম।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!