• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
বাবা দিবসের গল্প

বাবার সাথে প্রথম দেখা লাশঘরে


মো. গোলাম মোস্তফা (দুঃখু ) জুন ১৮, ২০১৭, ০৬:৩৩ পিএম
বাবার সাথে প্রথম দেখা লাশঘরে

আমি যখন ছোট তখন দেশের বাইরে থাকতেন বাবা। আমি থাকতাম মার সাথে, আমাদের শহরের বাড়িতে। আট বছর বয়সে মাকে প্রায়ই বলতাম, মা, আমার বাবা কোথায়?  মা আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেন না। আবার কখনো বলতেন, তোর বাবা জাহাজে থাকে। তাই আসতে পারে না।

মা খুব সুন্দর করে কথাগুলো বলতেন। একদিন বললেন, আজ তোর বাবার গল্প বলবো। সেদিন দিনের বেলা সব কাজ তাড়াতাড়ি সেরে ফেলি। কারণ আজ রাতে মা আমাকে বাবার গল্প শোনাবেন। রাতে যখন ঘুমুতে যাই, তখন মা আমার পাশে বসেন। আমি মায়ের পায়ে মাথা রেখে শুয়ে আছি। মা আমাকে বাবার গল্প বলা শুরু করলেন।

আমার বয়স যখন নয় মাস তখন বাবা জাহাজে যান। যাবার পর একমাস পর ফোন করেছিলেন বাবা। এরপর আর ফোন করেননি মার কাছে। মা আমাদের পরিবারের সববকিছু নিজের হাতে সাজিয়ে রেখেছেন। বাবার ঘরটি এখনো মা সাজিয়ে রাখেন। মার বিশ্বাস, বাবা একদিন ফিরে আসবেন।

এতটুকু শোনার পর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে মা আমায় বলছিলেন, হিমেল, তুমি রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলে। তাই বাকি গল্পটুকু শুনতে পারোনি। মাকে বললাম, মা আমার বাকি গল্প তুমি। তুমি থাকলে আমার জীবনের সব গল্প থাকবে। এ কথা বলার পর মা ঘরে চলে গেলেন।

আমি সোজা চলে এলাম নদীর পাড়ে। সকালে নদীর পাড়ে যখন আসি, তখন নদীর পানির সাথে কথা বলি। পানি হয়তো উত্তর দেয় না আমার। তবে আমি পানির ভাষা বুঝে নিই। পানি আমার অনেক পছন্দ। এর মাঝেই যে আমার বাবা ভেসে আছেন। আমরা জানি না, বাবা কেমন আছেন। হয়তো ভালো আছেন, সবসময় দোয়া করি বাবা তুমি যেখানে থাকো ভালো থাকো। আমি মাকে খুব মিস করি।

দুপুর হয়ে এলো। ফিরে এলাম বাড়িতে। মাকে বলে আবারো বের হয়ে গেলাম। আজ আমার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। রেজাল্ট দেখার সময় খুব ভয় করছিলো। যদি চান্স না পাই, তাহলে মা কষ্ট পাবেন। নেটে রেজাল্ট দেখলাম, আমি ঢাকা মেডিকেল চান্স পেয়েছি। তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম বাসায়।

মাকে খবরটা দেয়ার পর, মা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন বাবার রুমে। আমি মার পিছনে পিছনে গেলাম। মাকে বললাম, মা, তুমি কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয়। মা আমার বুকে মাথা রেখে বলতে থাকেন, তোমার বাবা আমায় বলে গিয়েছিলেন, আমার ছেলেকে ডাক্তার বানাবে। আমি থাকি আর না থাকি। সে আজ কোথায় আমি জানি না। তবে তার স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে।

আমি মা কে বললাম, মা কাল কলেজে ভর্তি হতে যেতে হবে। মা বললেন, আমি তোমার সাথে যাবো। কলেজে ভর্তি হলাম। তের দিন পর ক্লাস শুরু হলো। প্রথম দিন পরিচিতি ক্লাস। এর বেশি কিছু হয়নি। তিন চারটি ক্লাসের পর আমরা লাশ কাটা রুমে গেলাম ক্লাস করার জন্য। আমার বন্ধু ফাহিম বলছিলো লাশটি কত্ত লম্বা দেখ। আমরা সবাই বললাম, হ্যাঁ, তাই তো।

এরপর স্যার রুমে প্রবেশ করলেন। ক্লাস নেয়ার সময় স্যার বললেন, এই লাশটি জাহাজ থেকে আনা হয়েছে। এ কথা শোনার পর স্যারকে বললাম, কীভাবে স্যার? স্যার বললেন, জাহাজে এ লোকটি মারা যান। লাশটিকে অনেকদিন পর  এই ল্যাবে আনা হয়েছে।

স্যারকে বললাম, লোকটির বাড়ির লোকজন খবর পেয়েছিল? স্যার বললেন, না, চেষ্টা করেছি পাইনি। তারপর বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে ল্যাবে আনা হয়। ক্লাস শেষ। বাড়ি গিয়ে বিষয়টা মার সঙ্গে শেয়ার করি। মা বার বার বলতে লাগলেন, আমাকে নিয়ে যাবি তোদের ল্যাবে?

মাকে পরদিন ল্যাবে নিয়ে গেলাম। স্যারের অনুমতি নিয়ে লাশের রুমে ঢোকার পর কেন জানি ভয় ভয় লাগছিল। মার হাত ধরে আছি। লাশের কাপড়টা নিজ হাতে সরালাম। মাকে দেখতে বললাম। মা আস্তে আস্তে লাশের কাছে এলেন। মুখের দিতে তাকালেন। মা কেমন জানি চঞ্চল হয়ে গিয়েছিলেন। কিছু না বলে লাশের হাত-পা দেখছিলেন। কিন্তু কোনো কথা বললেন না। চুপ করে আছেন। 

মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, মা কী হয়েছে তোমার? কথা বলছো না কেন? এবার মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। লাশের রুমে সে চিৎকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। মা চিৎকার করে বললেন, হিমেল রে, এটা তোর বাবার লাশ!

মার মুখে বাবার লাশের কথা শুনে মাটিতে বসে পড়ি। মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকি, মা তুমি ঠিক ঠিক দেখেছো তো? ভুল হচ্ছে না তো? মা আমার গালে ঠাস করে চড় দিলেন। বললেন, আমি আমার স্বামীকে চিনতে ভুল করবো? কী করে বললি এ কথা? মার কথা শোনার পর লাশের কাছে গেলাম। 

বাবা, বাবা গো, তুমি লাশ হয়ে আছ কেন? এই দেখ আমি তোমার ছেলে। তোমার হিমেল। মাকে জড়িয়ে আবারো বলি, দেখ মা, বাবা আমার কথা শুনছে না। বাবা, ও বাবা, তুমি সেই ছোট বেলা আমাকে রেখে গিয়েছিলে। এই দেখ তোমার হিমেল কত বড় হয়েছে। সে তোমার স্বপ্ন পূরণ করছে....।

পরে মাকে নিয়ে কলেজের অধ্যক্ষ স্যারের সঙ্গে দেখা করি। সবকিছু বলার পর কলেজ থেকে বাবার লাশটি দিয়ে দেন। আমি আর মা বাবার লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরি। এর কিছুদিন পর মাকে বললাম, মা, দেখ আমার কেমন কপাল! আমার বাবার সঙ্গে প্রথম দেখা লাশ ঘরে! মা কিছু না বলে চুপ করে থাকলেন। তখন রাত হয়ে গিয়েছে। মা আমার রুমের আলো নিভে দিয়ে চলে গেলেন। আমি ঘুমের মধ্যে বাবাকে দেখার চেষ্টা করলাম...!

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা বিভাগ, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম।

Wordbridge School
Link copied!