• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বিশ্ব বাবা দিবস

বাবাহীন এ কেমন জীবন আমার!


এস এম মোবিন  জুন ১৮, ২০১৭, ০১:১৮ পিএম
বাবাহীন এ কেমন জীবন আমার!

প্রতিদিনের মতো ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে অফিসের পথে রওনা দিলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ মনে হলো রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। একটু একটু করে মনে করতে চেষ্টা করলাম পুরো স্বপ্নটা।

বাবাকে হারিয়েছি যখন আমার বয়স চার কি পাঁচ মাস। বাবা কাকে বলে তা বোঝার ক্ষমতা তখন আমার ছিল না। একটু বড় হওয়ার পর সমবয়সীরা যখন বাবা বাবা বলে ডাকে তখন মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, মা, আমার বাবা নেই কেন? মা কিছু না বলে শুধু বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন। যখন বুঝতে শিখেছি তখন জানতে পারলাম, আমার বাবা ঢাকায় রোড এক্সিডেন্টে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে (১৯৭৯)। 

বাবার অনুপস্থিতি প্রথম প্রবলভাবে অনুভব করলাম কিশোরগঞ্জ বেড়াতে গিয়ে। সেখানে এক ভদ্রলোককে দেখলাম তার মেয়েকে খুব আদর করছেন। এমন দৃশ্য দেখে বাবার কথা মনে এলো। আমি একমনে দেখতে থাকলাম। আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম, ইস! আমার জীবনে এমন যদি কেউ থাকতেন তা হলে আমাকেও এভাবে আদর করতেন। 

ঠিক তখন থেকেই মাথায় এই চিন্তাটা যেন বাসা বেঁধে বসলো। বাবার বয়সের কাউকে দেখলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। মনে মনে ভাবি আমার জীবনে কেন এমন হল!

বাবার আদর আবার চাচাদের কাছেও কিছু পাওয়া যায়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, বাবা মারা যাওয়ার এক বছরের মধ্যে দুই চাচা ও আপু মারা গেলেন। তাই আমার জীবন শুধু শূন্যতাতেই ভরে রইল। 

হ্যাঁ, যা বলছিলাম। বাবার কথা ভাবতাম আর মনে করতাম, বাবা যদি চিরবিদায় না নিয়ে কোথায় হারিয়ে যেতেন এবং এখন আসতেন, তা হলে কতই না মজা হত! সিনেমা বা নাটকে কতই না দেখেছি, এভাবে হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসতে। 

বাবা নেই- এ কথা শুনে এক ভদ্রলোক একদিন বললেন, বাবা নেই তো কী হয়েছে? বাবার বয়সী লোকদের শ্রদ্ধা করো, বাবার আত্মা শান্তি পাবে। আমি এখন তাই করি।

ওই রাতে যখন স্বপ্নে দেখলাম বাবা চলে এসেছেন আমাদের মাঝে তখন মাকে বলেছি, মা, আমি বলেছিলাম না বাবা ফিরে আসবেন। এই দেখ, বাবা ফিরে এসেছেন। বাবা চেয়ারে বসে মিষ্টি মিষ্টি করে হাসছেন। যখন স্বপ্নে দেখেছি তখন এমন ভাবে দেখেছি যেন এটাই বাস্তব। 

সকাল বেলা যখন বুঝলাম আসলে আমি সবকিছু স্বপ্নে দেখেছি ঠিক তখন আর চোখে পানি ধরে রাখতে পারলাম না। দুই চোখ পানিতে ছল ছল করছে। কিন্তু কাঁদতে পারলাম না। সারাটা দিন মনে মনে অনেক কান্না করেছি কিন্তু চোখ দিয়ে পানি পড়তে দিইনি। অফিসের সবাই আমার অন্ধকার মুখটাই দেখেছে, ভাঙা হৃদয়টা দেখাইনি। মনের ভেতরে গুমরে ওঠা চাপা কান্নায় কাটিয়েছি সরাটা দিন।

বাবার বংশে থাকার মধ্যে এখন শুধু বেঁচে আছেন আমার একমাত্র ফুপু; যিনি চট্টগ্রামে বাড়ি করে ছেলে মেয়েদের নিয়ে থাকেন। ছোটবেলা বেড়াতে গিয়েছিলাম সেখানে। ফুপু অ্যালবাম দেখাতে গিয়ে একটা ছবি আমার হাতে দিয়ে বললেন, দেখ তো এটা কার ছবি? আমি চিনি না বলে ছবিটার কোন গুরুত্ব না দিয়ে রেখে দিলাম। বাকি ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম। 

তখন সেই ছবিটা আবার হাতে তুলে দিয়ে ফুপু বললেন, এটা তোর বাবার ছবি। বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আর আমি ও ঠিক থাকতে পারলাম না। তখনো আমি জানতাম না, বাবা দেখতে কেমন ছিলেন? এখন বাবা বলতে সেই ছবিটাকেই বুঝি।

আজও বাবাকে যখন প্রবলভাবে অনুভব করি তখন কম্পিউটারে স্ক্যান করা ছবিটার দিকে তাকিয়ে বাবাকে খুঁজে পাই। ভাবি, বাবার জীবনটাই বা কত দুঃখে গেল, আর আমার জীবনটাই বা কত দুঃখ পেল। এই আমি আজ কত জনকেই না বাবার মত মিলানোর চেষ্টা করি।

শুনলে অবাক হবেন, অফিসের কাজ সেরে এক মামার অফিসে গেলাম দেখা করতে। মামা তার পাশের টেবিলের কলিগকে ডাকছেন, হেবজু সাহেব একটু আসবেন? আমি তো শুনে হতবাক! এ যে আমার বাবার ডাক নাম। মামা এ কাকে ডাকছেন, কে এই ভদ্রলোক? বুকের কোথায় যেন তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম। ত্রিশ বছর আগে যে নামটি মাটিচাপা দিয়েছিল তা আবার কি করে চলে এলো? 

পরক্ষণেই আমার ধ্যান ভাঙলো এবং হাজির হলেন বাবার বয়সের এক ভদ্রলোক। মুখে দাড়ি, লম্বাচওড়া সুন্দর চেহারার লোকটি যখন আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন, আমি একবার তাকিয়েই যেন আর তাকাতে পারছিলাম না। আমার ভেতরে যেন সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। মামা পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমার ভাগিনা খুব দুঃখী ছেলে, খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছে, তাও আবার আপনার নামে নাম। 

আমি তাকে সালাম দিলাম, উনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সাথে সাথে আমি যেন উনার বুকের মধ্যে ডুকে গেলাম। জীবনের ত্রিশ বছরের শূন্য অনুভূতির কোথায় যেন ভরা ভাদর এলো। মাথায় হাত বোলানো, বুকে জড়ানো .......

আর দেরি না করে চলে এলাম। এখন আমি তাকে মামা বলেই ডাকি। আসলে পৃথিবীতে সবার জন্য সবকিছু আসে না। দুনিয়াতে বাবা একজনই হয়, যার বিকল্প আর হয় না। হেবজু মামার সাথে ফোনে কথা বলি। দেখা করি। কিন্তু আমার আবেগ কি মামাকে সে ভাবে নাড়া দেয়? নাকি দেয় না। হয় তো দেয়। কিন্তু আমার মত লিখে বুঝাতে পারে না। 

আবার কত বাবাই না বৃদ্ধাশ্রমে থাকে ছেলে মেয়েদের ছেড়ে। তাদের সন্তানেরা কি ভাবে আমার মত করে? হয়তো ভাবে না। তা না হলে তারা কি করে বাবা মাকে ছেড়ে বাসায় থাকতে পারে। ঘৃণা জানাই সে সন্তানদের যারা এ নিষ্ঠুর কাজটি করে থাকে। ধন্যবাদ ও দোয়া জানাই মুকুল চাচাকে; যে কিনা বৃদ্ধাশ্রম দিয়ে দুঃখী বাবা মায়েদের পাশে থাকেন। 

বাবার কথা যখনই মনে হয়, তখনই কম্পিউটারে স্ক্যান করা ছবিটা সামনে মেলে ধরি, দেখি আর ভাবি, আমার জীবনটা কেমন? মা আর বড় ভাই ছাড়া যে কেউ নেই এই পৃথিবীতে আদর করার। একটু মাথায় হাত বুলানোর। এই দুঃখ আমি কাকে বলব? কে শুনবে আমার এ দুঃখের কথা? এ কেমন জীবন আমার! একথা যখন লিখছি তখনও বাবার স্মৃতির উপহার নোনা বৃষ্টিতে ভিজে গেল দুচোখ আবারো।

লেখক: এস এম মোবিন, জিএম, সোনালী আইটি, ঢাকা।
ইমেইল: [email protected]

সোনালীনিউজ/এন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!