• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাম শিবিরে ভোটের ঐক্যের সুর


নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ১৪, ২০১৭, ০২:০৩ পিএম
বাম শিবিরে ভোটের ঐক্যের সুর

ঢাকা : দীর্ঘদিন ধরেই বাম গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক ঐক্যের চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এতদিন সফলতা হয়নি। তবে বাম শিবির ও সংশ্লিষ্ট প্রগতিশীলরা এবার আশাবাদী, বছরের পর বছর ধরে চলা এই আখাঙ্খা অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে কয়েকজন নবীন-প্রবীণ বিশিষ্ট নেতার হাত ধরে।

গত তিন মাস ধরে চলা এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় তিনটি নাম উঠে এসেছে। এরা হলেন- গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নেয়া এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানা গেছে।

উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, প্রথমত কয়েকটি রাজনৈতিক চাহিদাকে সামনে রেখে নির্বাচনমুখী এই জোট বর্তমান সরকারকে ‘স্বৈরাচারী’ এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটকে ‘জনবিরোধী ও জনগণের স্বার্থরক্ষায় ব্যর্থ’ মনে করে; এই দুই জোটের বাইরে বিকল্প একটি শক্তিশালী ও কার্যকর জোট গড়ে তুলবে। দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চাহিদার মূল্যায়ন করে রাজপথে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা। চতুর্থত, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল, জাতীয় নির্বাচনের স্থায়ী পদ্ধতি প্রণয়নে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং আগামী নির্বাচনে জোটবদ্ধভাবে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা করা। পুরো প্রক্রিয়াটিই এখন পর্যন্ত ছোট-ছোট বৈঠক ও ঘরোয়া আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও চলতি রমজানের ঈদের পর আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করবেন উদ্যোক্তারা। তবে পুরো প্রক্রিয়াটি পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নভাবে গুছিয়ে আনার আগ পর্যন্ত কেউ-ই এ ব্যাপারে বিস্তারিত কথা বলতে ইচ্ছুক নন।

জানা গেছে, পুরো উদ্যোগে তিনজন রাজনীতিক অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। এরা হলেন- ড. কামাল হোসেন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও জোনায়েদ সাকি। আদর্শবাদী রাজনীতির তিনধারার এই তিনজনের ইতিবাচক অবস্থানের কারণেই মূলত ঐক্য নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছে রাজনীতি-পর্যালোচকেরা। ড. কামাল হোসেন বিভিন্ন সময় জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে সাড়া না পেলেও এবারের চিত্র ভিন্ন হবে- এমন প্রত্যাশা উদ্যোক্তাদের; এমনকি আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান এই আইনজীবীরও।

উদ্যোক্তারা আশা করছেন, এ বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ বাম-প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক দলগুলোর ঐক্য বাস্তবে রূপ নেবে। এই প্রক্রিয়া গত ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ শুরু হয় বলে জানিয়েছেন তারা। প্রক্রিয়াধীন এই জোটে গণফোরাম, সিপিবি-বাসদ জোট, সাতদলীয় জোট গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, নাগরিক ঐক্য, জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ঐক্য-ন্যাপসহ আরও কয়েকটি দল থাকতে পারে।

প্রসঙ্গত, সাতদলীয় জোট গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার শরিক দলগুলো হচ্ছে-  বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ-মার্কসবাদী, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণসংহতি আন্দোলন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, আমরা চাই অর্থপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনের শাসন, এটি ঐক্য ছাড়া সম্ভব হবে না। ৭০ এর অনুচ্ছেদ সংশোধন, এই সংশোধনের জন্য ঐক্য করা খুবই প্রয়োজন। ঐক্য না হলে যে সংশোধন হবে, সেটি বিতর্কিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, আমি পুরোপুরি সমর্থন করেছি। তারও নিশ্চয় আমাদের দাবির ওপর সমর্থন আছে। তিনি তৃণমূল ও তরুণদের সঙ্গে কাজ করছেন। গণসংহতি আন্দোলনের দাবি ও কর্মসূচি নীতিভিত্তিক।’

ড. কামাল হোসেন জানান, ‘গণফোরাম দু-একদিনের মধ্যে ২৩ দফা পুনস্থাপন করবে এবং ঈদের পর দলের বর্ধিত সভা করে জোটের বিষয়ে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করবে। এরপরই ঐক্য-প্রক্রিয়া নিয়ে আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হবে।’

সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে বিকল্প শক্তিকে বিকশিত করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা সংগ্রাম করছি। প্রয়োজনে ইলেকশনেও একই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’

তিনি বলেন, ইলেকশনকেন্দ্রিক বড় কাজ, বিশেষ করে নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করা। সংখ্যানুপাতিক হারে প্রতিনিধি দিতে হবে, নির্বাচনে টাকা পেশীশক্তির ব্যবহার, প্রশাসনের কারসাজি, সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবমুক্ত করতে হবে।

আওয়ামী লীগ-বিএনপির জোটের বাইরে বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত বাম মোর্চার সাবেক সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান এই সমন্বয়কারী বলেন, ‘সরকার স্বৈরাচারী, বিরোধীদল জনবিরোধী-জনগণের স্বার্থরক্ষা করতে তারা ব্যর্থ, ফলে এই দুইজোটের বাইরে জনগণের রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে চাই আমরা।’

তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কর্মসূচিকে সামনে রেখে দেশপ্রেমিক শক্তিকে একত্র করতে ঐক্য করা এবং তার ভিত্তিতে নির্বাচন করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছি।’ তবে বাম মোর্চার একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ঐক্যের বিষয়ে বাম মোর্চা এখনও কোনও ঐক্যমত্যে আসতে পারেনি।

ইতিমধ্যেই সিপিবি-বাসদ ও বামমোর্চা ২০১৭-১৮ সালের অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করেছে সমন্বিতভাবে। ৩ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তারা সমাবেশ ও মিছিল করেছে। এ প্রসঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ তো হয়েই গেল, বাজেটের বিরুদ্ধে রাজপথে ঐক্যবদ্ধভাবেই প্রোগ্রাম করলাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে বাম-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক শক্তির সমাবেশ করতে চাই। প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রাজপথে আমাদের কাজ আমরা বাড়িয়ে দেব। সঙ্গে-সঙ্গে নির্বাচনের প্রশ্নে একসঙ্গে চলার চেষ্টা করব।’

ঐক্য-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সূত্র জানায়, ২০ দলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামী থাকায় বাম-গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল দলগুলো কোনোভাবেই এই জোটে ভিড়বে না। এমনকি নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রব এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ৫ জুন পাশের টেবিলে জামায়াতকে বসিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ইফতার করলেও বিএনপি-জোটে তাদের না-যাওয়াটাই অনেকটা নিশ্চিত। এই ধারণা পরিষ্কার হয় গত বছরের জুলাইয়ে। ওই সময় খালেদা জিয়া তার গুলশানের বাসভবনে চা চক্রের আমন্ত্রণ জানালেও কোনও বাম ও প্রগতিশীল দলই অংশ নেয়নি ওই আমন্ত্রণে। তবে বিএনপি এখন চাইছে, কোনও না কোনোভাবে সরকারবিরোধী একটি কার্যকর রাজনৈতিক জোট গড়ে উঠুক-আর সেটি বাম-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক দলগুলোর হলেও তাদের আস্থা কমবে না।

জাতীয়তাবাদী ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও বিএনপির রাজনীতির পর্যবেক্ষক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘একটু ওয়ার্ক করলেই তারা কাছাকাছি যেতে পারবে। বিএনপির জোটের মধ্যে আসবে না বা আসার দরকারও নেই। আলাদাভাবে তারা জোট করলেও করতে পারবে। ২০ দলের সঙ্গে ঐক্য হয়তো হবে না, কারণ এখানে জামায়াত আছে। ফলে তারা নিজেরাই যদি ৪-৫ দলের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করে আলাদা জোট করে যুগপৎ প্রোগ্রাম করে, তাহলেও হবে। তারাও তো এন্টিগভর্মেন্ট। অসুবিধা কি?’

আ স ম রব ও মাহমুদুর রহমান মান্নার বিএনপির ইফতারে অংশগ্রহণ ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘ইফতারিতে বসে আলোচনা হলো আর এত দ্রুত আমাদের ধরে নেয়া উচিৎ না, যে ঐক্য হয়ে গেল। এটা নিয়ে কথা হবে। ওরা (রব-মান্না) কী চিন্তা করছে, তা তো জানতে হবে।’

এদিকে রাজনৈতিক মহলে সমালোচনা রয়েছে, ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু করলেও ডাক দিয়ে ফের বিদেশ চলে যান ড. কামাল হোসেন। এর আগে অন্তত কয়েকবার তিনি ঐক্যের ডাক এবং ‘জাতীয় ঐক্য-প্রক্রিয়ার আহ্বান করলেও সে উদ্যোগগুলো সফল হয়নি। ২০১২ সালের ২১ অক্টোবর হোটেল র‌্যাডিসনে ‘সুস্থ রাজনীতি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদমুক্ত সমাজ এবং সমৃদ্ধ অর্থনীতি- এই তিন দফার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেন। যদিও ওই উদ্যোগ বেশিদূর টেকসই হয়নি। তবে প্রয়োজনে আবারও সাবেক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা হতে পারে, এমনটি বললেন ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘বি চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তবে এখন এ বিষয়ে হয়নি। প্রয়োজনে আবার হবে।’

এরপর জাতীয় প্রেসক্লাবে এবং সর্বশেষ গত বছরের ২০ আগস্ট ১৪ দফা নিয়ে ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ঘোষণা করেন তিনি। এর আগে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার প্রেক্ষিতে ৩ জুলাই সন্ত্রাস-উগ্রবাদ মোকাবিলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন।

তবে ড. কামাল হোসেন নিজের ওপর এখন আস্থাশীল। তার ভাষ্য, ‘ঐক্যের আবেদন তো আমার মাঠে আছে। ২৩ দফাকে নতুন করে ছাড়তে চাই। এটাকে ঐক্যবদ্ধভাবে, যৌথভাবে আবার তুলে ধরতে চাই। ২০০৮ সালেও ২৩ দফা ছিল। এবার বদল হবে।’

কামাল হোসেন বলেন, ‘ঐক্যের প্রয়োজন সব সময়ই ছিল। ২০০৫ এ উদ্যোগ নিয়েছিলাম, রেজাল্ট এলো ২০০৮ সালে। ২০০৭ সালে নির্বাচনের চেষ্টা করা হল, কিন্তু হয়নি। ভুয়া ভোটার তালিকা বাতিল হল। এটা তো আমাদের ঐক্যের কারণেই। সেই ঐক্যের কারণেই তো শেখ হাসিনার সরকার।’

ঐক্যপ্রক্রিয়া সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করে কামাল বলেন, ঐক্য করবো লক্ষ্য অর্জনের জন্য। ফলে লক্ষ্য অর্জনে আন্দোলন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন, গণসংযোগ করা হবে। তবে তিনি আবারও বিদেশ যাচ্ছেন, ফিরবেন জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ঐক্যের আলোচনা হয়তো এগুবে এরপর।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!