• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘বারডেমে বসে অফিস করতেন এখন করেন কারাগারে’


বিশেষ প্রতিনিধি আগস্ট ২৮, ২০১৭, ০৩:২২ পিএম
‘বারডেমে বসে অফিস করতেন এখন করেন কারাগারে’

ঢাকা: দুর্নীতির মামলায় দীর্ঘদিন ধরে কারান্তরীন আছেন ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমিন। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষের সহায়তায় তিনি কারাগারে বসেই সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কারাগারে বসে এখন তিনি নিয়মিত অফিসের কাজ করেন।

এর আগে নানা রোগের দোহাই দিয়ে চিকিৎসার উছিলায় ১৪ মাস ধরে তিনি বিশেষ ব্যবস্থায় বারডেম হাসপাতালে বসে অফিসের যাবতীয় কাজ সারতেন। বিষয়টি জানাজানি হলে সম্প্রতি তাকে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাঠিয়ে দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সোমবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে জেল সুপার জাহাঙ্গীর আলমকে পাওয়া যায়নি। তিনি বাইরে ছিলেন। পরে জেলার মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার জন্য কারাগারের তথ্য কেন্দ্র থেকে ফোন করা হলে তিনি জানান, সাংবাদিকদের সঙ্গে কোন প্রকার কথা বলা যাবে না। তিনি তথ্য কেন্দ্রর মাধ্যেমে জানিয়েছেন সাংবাদিকদের বলে দেন জেল সুপারের সঙ্গে কথা বলার জন্য। জেল সুপারের বাইরে কোন প্রকার কথা বলা যাবে না।

সূত্র জানায়, বহুস্তর বিপণনপদ্ধতিতে (এমএলএম) সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে মামলার পর চার্জশিট দাখিল করে দুদক। ডেসটিনি গ্রুপের বিরুদ্ধে করা দুটি মামলার বিচারকাজ গত আগস্টে শুরু হয়েছে। ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশিদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীনসহ ৫৩ জন এ দুই মামলার আসামি। ইতিমধ্যে এই গ্রুপের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে করা মামলার বিচার শুরু হয়েছে। মামলায় সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদ জামিনে থাকলেও রফিকুল আমিনসহ আরও বেশ কয়েকজন আসামি এখনও জেলে আছেন।

অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে কারাগারে বসেই রফিকুল আমিন অফিসের যাবতীয় কাজ চালাচ্ছেন। এর আগে একইভাবে নানা রোগের দোহাই দিয়ে তিনি বারডেম হাসপাতালে ১৪ মাস ধরে সব সুবিধা নিয়ে আসছিলেন। আইনে অনুমোদিত না হলেও এইভাবে সব ধরনের সুবিধার অপরাধে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখন তিনি জেলে বসে সেই সুবিধা নিচ্ছেন।

জানা গেছে, নানা উছিলায় রফিকুল আমিন আবারও বারডেম হাসপাতালে আসার চেষ্টা করছেন। কারণ, এই হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি তাকে নিয়মের বাইরে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন।
 
গত ১৩ নভেম্বর দেশের সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে করা দুই মামলায় ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন ও ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা দেয়ার পর জামিনে মুক্তি পাবেন।

আদালত গাছ বিক্রি করে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলেছেন। ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেডের বিক্রির উপযোগী ৩৫ লাখ গাছ বিক্রির জন্য ছয় সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে।

আদালত বলেছেন, এর পরিবর্তে নগদ আড়াই হাজার কোটি টাকা জমা দিলেও তারা জামিনে মুক্তি পাবেন। কিন্তু উচ্চ আদালত আড়াই হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার শর্তে রফিকুল আমিনকে জামিন দিলেও তিনি ওই টাকা জমা দিতে পারেননি বলে জামিন হয়নি বলে জানা গেছে।

ডেসটিনির চেয়ারম্যান ও এমডি জামিনে একবার কারাগারের বাইরে গেলে তারা এক টাকাও জমা দেবেন না। এমনকি একবার জামিন পেলে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে মন্তব্য বলেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

সম্প্রতি ডেসটিনির দুই কর্ণধারের জামিন আবেদনের শুনানিতে ডেসটিনির পক্ষের আইনজীবীর উদ্দেশে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন। ওই সময় আদালতে ডেসটিনির পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ।

আদালত তখন বলে বলেছিলেন, ডেসটিনির বিরুদ্ধে ৩ হাজার কোটি টাকা অর্থপাচারের অভিযোগে মামলা হয়েছে। এই মামলায় ডেসটিনির চেয়ারম্যান ও এমডির জামিনের পর একবার কারাগারের বাইরে গেলে তারা এক টাকাও জমা দেবে না। টাকা দেয়া তো দূরে থাক তারা আরও অর্থ বাইরে পাচার করবেন।
আদালত আরও বলেছিলেন, আপনারা শর্ত অনুযায়ী কিছু টাকা পরিশোধ করুন। আপনাদের সব সুবিধা দেব। এরপর আদালত ব্যাংক হিসাব দাখিলের নির্দেশ দিয়ে আগামী রোববার মামলার শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য করেন।

এর আগে গত বছরের ১৩ নভেম্বর ডেসটিনি গ্রুপের গাছ লাগানো প্রকল্পের আওতায় থাকা ৩৫ লাখ গাছ ছয় সপ্তাহের মধ্যে বিক্রির নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।

ওইদিন আদালত আদেশে বলেছিলেন, ৩৫ লাখ গাছ বিক্রির ২৮০০ কোটি টাকা সরকারকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে দিতে হবে। টাকা পাওয়ার পর ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমিন ও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইনকে আপিল বিভাগ জামিন দেবেন বলে আদেশে বলা হয়।

তবে গাছ বিক্রি করে যদি ২৮০০ কোটি টাকা না হয় তাহলে কমপেক্ষ ২৫০০ কোটি টাকা সরকারকে দিলেই জামিন মিলবে ডেসটিনির চেয়ারম্যান ও এমডির। কিন্তু আদালতের শর্ত অনুযায়ী, টাকা জমা না দেয়ায় এখনো জেলে রয়েছেন ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমিন ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন।

কাগজে-কলমে বলা হয়েছে, ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রয়েছেন। তবে ‘রোগী’ হিসেবে ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে তিনি বারডেম হাসপাতালে ছিলেন। তিনি প্রথম শ্রেণির বন্দীর মর্যাদাও পাচ্ছেন।

সরকারের বিভিন্ন সংস্থার করা তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পাঁচ হাজার কোটির বেশি টাকা সংগ্রহ করেছে ডেসটিনি। এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকারই কোনো হিসাব নেই। এই অর্থের বড় অংশই পাচার হয়েছে।

২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে আট মাস কাজ করার পর একই বছরের ১ অক্টোবর ৩৮৪ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো)। অভিযোগ ছিল, বিভিন্ন দেশে হুন্ডি ব্যবসা করা, অর্থ পাচার, অবৈধ ব্যাংকিং, জঙ্গিদের অর্থায়ন, ভুয়া বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চালু, অর্থ আত্মসাৎ ইত্যাদি কাজ করছে ডেসটিনি।

প্রতিবেদনে আটটি গুরুতর অনিয়ম উল্লেখ ও ছয়টি সুপারিশ করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব দুর্নীতি ও অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়, সেগুলো হলো- ডেসটিনি পরিবারভুক্ত ২২ ব্যক্তির নিজেদের মধ্যে শেয়ার লেনদেন, লোকসানি কোম্পানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে তহবিল তছরুপ, বেআইনিভাবে প্রতিষ্ঠানের অর্থ পরিচালকদের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর, চড়া সুদে অবৈধ ব্যাংকিং, বৃক্ষরোপণের নামে অর্থ সংগ্রহ ও অর্থের হদিস না থাকা, উদ্দেশ্য অনুযায়ী কোম্পানি পরিচালিত না হওয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে কোম্পানির তথ্য গোপন এবং একচেটিয়া পণ্যের বাজার সৃষ্টি করে চড়া মুনাফায় পণ্য বিপণন।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!