• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন কেন অবৈধ নয়: হাইকোর্ট


নিজস্ব প্রতিবেদক এপ্রিল ১০, ২০১৭, ০১:১০ পিএম
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন কেন অবৈধ নয়: হাইকোর্ট

ঢাকা: বিশেষ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের অনুমোদন দিয়ে প্রণীত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ এর সংশ্লিষ্ট ধারা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি করে দুপুরে হাইকোর্ট বেঞ্চ এ অদেশ দেন। আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ, এসময় উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট সালমা আলী।

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘বাল্য বিবাহ নিরোধ বিল-২০১৭’ সংসদে পাস হয়। ওই আইনের ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোন বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং পিতা-মাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।’

আইনের এই বিধানকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে গত ৪ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট করে নারীপক্ষ ও জাতীয় মহিলা আইনজীবি সমিতি। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত এই রুল জারি করলেন।

মেয়েদের ১৮ ও ছেলেদের ২১ বছরের আগে বিয়ে না দেয়ার বিধান রেখে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৬-এর খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। তবে এতে বিশেষ প্রেক্ষাপটে আদালতের নির্দেশনা নিয়ে মা-বাবার অনুমতি সাপেক্ষে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরও বিয়ে দেয়া যাবে বলা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়।

খসড়া আইনে বলা হয়েছে, বাল্যবিবাহ বন্ধে আদালতের নির্দেশ অমান্য করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত বিষয়ে মিথ্যা অভিযোগ করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৩০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
দুজন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে বাল্যবিবাহ করলে তাদের ১৫ দিনের আটকাদেশ ও অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি অপ্রাপ্তবয়স্ক কাউকে বিয়ে করলে দুই বছর কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। মা-বাবা আইন লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড করা যাবে। বিয়ে পড়ানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আইন না মানলে দুই বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়ার কথা বলা হয়েছে খসড়া আইনে।

বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্ট এগুলোর যেকোনো একটি বিয়ের বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য হবে। এ-সংক্রান্ত মামলার বিচার অন্যান্য ফৌজদারি অপরাধের মতোই হবে। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতেও বিচার করা যাবে। বাংলাদেশের সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের জন্য বিয়ের আইনি বয়স মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর। ১৮ ও ২১ বছর বয়সের নিচে কোনো মেয়ে ও ছেলেশিশুর মধ্যে বিয়ে হলে তা বাল্যবিবাহ হিসেবে পরিগণিত হয়।

পরিসংখ্যান বলছে, ১৮ বছরের নিচে কন্যাসন্তানের বেশি বিয়ে হয়, এমন ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ৬৪% শিশুর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। মেয়েদের বিয়ের বয়স হিসেবে ১৮-কে একটা স্ট্যান্ডার্ড ধরে নেয়া হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর বহু দেশে।

দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বাল্যবিবাহ যাদের ঠেকানোর কথা, বহু এলাকায় তারাই এর মদদদাতা হিসেবে ভূমিকা রাখছেন। এদের ভেতর যেমন আছেন জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তি, তেমনি রয়েছেন কাজী এবং আইনজীবীও।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, যেসব এলাকায় জন্মনিবন্ধনের হার কম, সেখানে বাল্যবিবাহের হার বেশি। জন্মসনদ থাকলেও কাজী, আইনজীবী সবাই বিয়ে পড়ানোয় দ্বিধা করেন না। সন্দেহ হলেও প্রশ্ন করেন না। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন অসচেতন অভিভাবকরা। এ ধরনের সমস্যায় বাল্যবিবাহ রোধ করতে হলে প্রাথমিকভাবে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভুয়া জন্মসনদ দেয়া বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া নোটারি পাবলিক বিয়ের হলফনামা না দিলেও বাল্যবিবাহ কমে আসবে। নতুন আইনে নোটারি পাবলিকের কোনো ভূমিকা থাকছে না।

নতুন এ আইন বাস্তবায়ন হলে যে কোনো বিয়ের ক্ষেত্রে বর বা কনের বয়সের প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক থাকবে। প্রমাণপত্র ছাড়া কোনো রেজিস্ট্রার বিয়ে সম্পন্ন করতে পারবেন না। নতুন আইনে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে সামাজিক সচেতনতাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব ও পরিধি বাড়ানো হচ্ছে আইনে। বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত মিথ্যা অভিযোগের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে।

সমাজবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায়, বাল্যবিবাহ কোনো পৃথক সমস্যা নয়। একে দেখতে হবে সামগ্রিকভাবে অন্য সব সামাজিক সমস্যার অংশ হিসেবে। বাল্যবিবাহ রোধে জাতীয়ভিত্তিক প্রচার বা সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যথেষ্ট তৎপরতা নেই। যদি এই প্রচারণা আরো বাড়ানো যায় তবে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে এই প্রবণতা কমে আসবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!