• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে এখনও পিছিয়ে কুমিল্লা


কুমিল্লা প্রতিনিধি মে ২৭, ২০১৭, ০৯:২৯ এএম
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে এখনও পিছিয়ে কুমিল্লা

কুমিল্লা: ‘মা’। এ শব্দটি পৃথিবীর সেরা শব্দ। সব মেয়েরই স্বপ্ন থাকে সে একদিন মা হবে। আর ‘মা’ ডাকটি শুনে তৃপ্ত সুখে হৃদয় ভরে ওঠবে। কিন্তু একজন শিশুই যদি হয় আরেকটি শিশুর মা। তবে নিশ্চয়ই বিষয়টি মানবিকতাকেও হার মানায়।

এমন চিত্র কুমিল্লার অধিকাংশ উপজেলা ও  গ্রামে লক্ষ্য করা যায়। নারীর ক্ষমতায়নে দেশ অনেক এগিয়ে গেলেও বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে এখনও পিছিয়ে আছে কুমিল্লা।

কুমিল্লা জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকতার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর কুমিল্লায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে ৮টি। এদের মধ্যে বুড়িচং ২টি, মেঘনায় ২টি, আদর্শ সদর ১টি , মুরাদনগর ১টি, হোমনা ১টি ও লাকসাম ১টি। বেসরকারি হিসাব মতে কুমিল্লায় কিশোরীর সংখ্যা ৭১ হাজার ৭৬১ জন। এদিকে বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে কুমিল্লায় অন্তত ৭-১০টি বাল্যবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, “বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাধনের আগে বৈবাহিক জীবনে প্রবেশ করায় এক ধরনের মানসিক চাপে পড়ে। এই চাপ এক ধরনের দ্বন্দ্ব  সৃষ্টি করে। তারা উৎকণ্ঠা, বিষন্নতা, সমন্বয়হীনতা প্রভৃতিতে ভুগতে থাকে। যা পরবর্তিতে ব্যক্তিত্ব সমস্যা তৈরি করে। তারা তখন পরিবারের ও সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালনে ব্যর্থ হয়। আর তখনই এসব মানুষগুলো রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে যায়।”

বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে বাল্যবিবাহ হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা। বর্তমানে বাল্যবিবাহ এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে এটি নারী নির্যাতন ও জনসংখ্যা বিস্ফোরণের অন্যতম কারণ হিসাবে আখ্যায়িত হচ্ছে।

কুমিল্লা জেলা বিজ্ঞ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালত থেকে জানা যায়, পূর্ববর্তী মাসে জের অনুযায়ী নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা ৩ হাজার ৬৬৮টি। ৯১৭টি কোর্ট পিটিশনসহ মোট মামলার সংখ্যা ৪ হাজার ৫৮৫টি। ১হাজার ৩০টি কোর্ট পিটিশনসহ মোট বিটারাধীন মামলার সংখ্যা ৪ হাজার ৭৭২টি। শুধু গত মাসেই নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার সংখ্যা ৭৪টি, ১১৩ টি কোর্ট পিটিশন সহ মামলার সংখ্যা ১৮৭টি।
অন্যদিকে চলতি মাসে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৬০টি, অব্যাহতি হয়েছে ৪১টি, ৭৪টি কোর্ট পিটিশনসহ অন্যভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে ৯০টি ও বদলি হয়েছে ১টি মামলা। চলতি মাসে মোট নিষ্পত্তি হয়েছে ১৯২টি মামলা। মাস শেষে ৯৫৬টি কোর্ট পিটিশনসহ বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪হাজার ৫৮০টি।

উপজেলা নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ক কমিটির তথ্য থেকে জানা যায়, মার্চ মাসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী উপজেলার নারী ও শিশু নির্যাতনের ৫টি অভিযোগের আবেদন পড়েছে। গত মাসের ৫টি  অভিযোগও পেন্ডিং রয়েছে। মোট ১০টি অভিযোগের মধ্যে ৭টি নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি ৩টি অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে।

পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের পূর্ববর্তী মাস পর্যন্ত ২৪টি ও গত মার্চ মাসে ১০টিসহ মোট দায়েরকৃত মামলা ৩৪টি। তদন্তাধীন অবস্থায় এসব মামলায় এ পর্যন্ত ১৯জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতনের ৭টি চলমান রয়েছে।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কবীর উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধ না হওয়া মূল কারণ হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি বিবাহের সংস্কৃতি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যথাযথ নারী শিক্ষার বৃদ্ধি না পাওয়া, স্কুল থেকে ঝরে পড়া, নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া সুযোগ বৃদ্ধি না হওয়াসহ বেশ কিছু কারণেই বাল্যবিবাহ প্রকৃতঅর্থে কমিয়ে আনা যাচ্ছে না।

তিনি মনে করেন, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের কুফল সর্ম্পকে জানান দিলে বাল্য বিবাহ কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা যাবে। তবে সেজন্য সব শ্রেণির মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বাল্যবিবাহের শিকার মানুষ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ না হওয়ায় ব্যক্তিত্ব সমস্যায় ভুগতে থাকে। ফলে তারা একসময় রাষ্ট্রের জন্যও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এখনই বাল্য বিবাহের পরিমান না কমালে নারীর প্রতি সহিংসতা, নারী শিক্ষার হার হ্রাস, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি, নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ কমে যাওয়াসহ নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকবে। বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েদের কি কি শারীরিক ক্ষতি হতে পারে?

কথা হয় গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. পারভিন মজিব সাথে। তিনি জানান, বাল্যবিবাহের কারণে শিশুর মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি, অপরিণত গর্ভধারণ, প্রসবকালীন শিশু মুত্যুঝুঁকি ও প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে। তাছাড়া অল্প বয়সে মা হওয়ার কারণে শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েন তারা। পূর্ণ মানসিক বিকাশের আগে মা হওয়ার কারণে সন্তানের দিকে সঠিক মনোযোগ তারা দিতে পারেন না। ফলে অল্প বয়সী মায়ের সন্তানরা সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে না।

কুমিল্লা জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জেবুন্নেছা বলেন, আমাদের পর্যাপ্ত জনবল নেই। রয়েছে মাঠ কর্মীর সংকট। কোন বাল্যবিবাহের ঘটনা শুনলে আমরা দ্রুত ছুটে যেতে পারি না। তাছাড়া সদর উপজেলায়ও আমাদের আলাদা কোন অফিস নেই। জেলা অফিসের যাতায়তের জন্য নেই কোন ব্যবস্থা।  তবে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের চেষ্টা অব্যাহত। এসব সমস্যা সমাধান হলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কুমিল্লা অনেকটা এগিয়ে থাকবে।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!