• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপিতে কেউ কারো কথা শুনছে না


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৬, ০৫:৪৬ পিএম
বিএনপিতে কেউ কারো কথা শুনছে না

বিশেষ প্রতিনিধি

বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিতে টপ টু বটম কেউ কারো কথা শুনছে না। এমনকি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশও ঠিকমতো পালিত হয় কি না, তা নিয়ে খোদ বিএনপির মধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আলোচনা চলছে দলের গণ্ডি পেরিয়ে এখন সমর্থক, বুদ্ধিজীবী ও শুভান্যুধায়ীদের মধ্যেও। আশঙ্কা করা হচ্ছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব ‘নন-ফাংশনাল’ বা অকার্যকর হয়ে পড়েছেন কি না।

বলা হচ্ছে, খোদ খালেদা জিয়াই দলটির কয়েকজন নেতা ও কর্মকর্তার কাছে এক রকম জিম্মি হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ আবার দলটির চেয়ারপারসনের ‘প্রজ্ঞা’ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। বলছেন, ৯০’-এর আন্দোলনের খালেদা জিয়া এখন আর নেই। ‘এক হাতে’ তিনি আর দল পরিচালনা করতে পারছেন না। পাশাপাশি দলটির মধ্যে এ মুহূর্তে প্রজ্ঞাবান ও যোগ্য নেতারও অভাব রয়েছে।

বিএনপির প্রবীণ কয়েকজন নেতার মতে, দলের ওপর খালেদার আগের মতো একক কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থাকলে বিএনপি নেতারা এতোটা স্বাধীনভাবে চলতে পারতেন না। সুযোগ হতো না একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার করার। বর্তমানে দলটির নেতারা সারাক্ষণই একে অন্যের পিছু লেগে আছেন। অথচ, তারাই আবার বলছেন, এভাবে একটি দল চলে না। আবার দায়িত্ব দিলে নেতারাই তা ঠিকমতো পালন করেন না।

এ রকম পরিস্থিতিতে পরস্পর বিরোধী নেতাদের বাধা ও আপত্তির কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েও তাতে অটল থাকতে পারছেন না খালেদা জিয়া। তিনি সকালে এক ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিকেলে আবার তা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে দলের মধ্যে তার কর্তৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বলা হচ্ছে, বয়স ও অসুস্থতার কারণে আগের মতো দক্ষ হাতে দল পরিচালনা করতে পারছেন না খালেদা। আর এ কারণেই সরকারের সৃষ্ট ‘ফাঁদ’ থেকে বেরিয়ে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে।

সর্বশেষ লন্ডন থেকে ফিরে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ‘পূর্ণ মহাসচিব’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও তার সমর্থকদের আপত্তির কারণে ওই উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। শুধু তাই নয়; ভেস্তে গেছে গুলশান কার্যালয় ঢেলে সাজানোর উদ্যোগও। একইভাবে পরস্পর বিরোধী নেতাদের তৎপরতা ও আপত্তির কারণে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির বিষয়টিও নিষ্পত্তি হয়নি। ফখরুল যাতে মহাসচিব না হতে পারেন এজন্য আগ্রহী গয়েশ্বর রায়সহ নেপথ্যে আরো লেগে আছেন দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত দলটির যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদও। তার কাজ হচ্ছে; ফখরুল যেন কিছুতেই মিডিয়ায় লাইমলাইটে আসতে না পারেন। এজন্য কারণে-অকারণে প্রায় প্রতিদিনই তিনি সংবাদ সম্মেলন করছেন। তাকে কেন্দ্র করে ফখরুল বিরোধী একদল নেতাকর্মী বিএনপি কার্যালয় পাহারা দিচ্ছে।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ অবশ্য মনে করেন, বিএনপির বর্তমান অবস্থার জন্য নেতৃত্বের ব্যর্থতাকে দায়ী করা ঠিক হবে না। তার মতে, বিএনপির এখনকার অবস্থা মূলত এক- এগারোর ঘটনা প্রবাহ থেকে উদ্ভুত। ওই সময় বিএনপি তার দলীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে আপস করলে আজ পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলেও উত্থান-পতন আছে। আওয়ামী লীগের মতো পুরনো দলেও এক সময় নেতৃত্বের অভাব দেখা গেছে। ঘটেছে নির্বাচনে ভরাডুবির মতো ঘটনাও। কিন্তু সময়ে আবার তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিএনপিরও উত্তরণ ঘটবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেন বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত সুশীল সমাজের এই প্রতিনিধি।

প্রবীণ আইনজীবী বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতে, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর শুধুমাত্র তার আদর্শের ওপর ভিত্তি করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি তিনবার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু এর আগে ও পরে অনেকবার মনে হয়েছে, এই বুঝি বিএনপি শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু শেষ আজও হয়নি। উপরন্তু পৃথিবীর যেকোন সংস্থা দিয়ে জরিপ করা হোক; দেখা যাবে বিএনপি সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। কিন্তু এই জনপ্রিয়তা সরকার শিকল দিয়ে আটকে রেখেছে।

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মত ও পথের অনুসারীদের নিয়ে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। দলটির ৩৭ বছরের ইতিহাসে প্রথম চার বছর জিয়াউর রহমান এবং এরপর গত ৩৩ বছর যাবৎ খালেদা জিয়াই নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে বিএনপি সংকটের মধ্যে পড়ে। বিএনপির তৎকালীন প্রভাবশালী বেশকজন নেতা তখন এরশাদের সঙ্গে হাত মেলান এবং পরে তার দলে যোগ দেন। এরপর নানা ঘটনা-প্রবাহের মধ্য দিয়ে এই সংকটকালে ১৯৮৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিএনপির হাল ধরেন খালেদা জিয়া। জিয়াউর রহমানের মতোই খালেদা জিয়া দলে ও দলের বাইরে সমান জনপ্রিয়। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বরের কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে তিনি দলটির চেয়ারপারসনের ম্যান্ডেট পান। আগামী মার্চের কাউন্সিলে আবারো তারই চেয়ারপারসন নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে।

কিন্তু এরমধ্যে প্রবাসে থাকাবস্থায়ই গত বছরের এপ্রিলে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা যান। তাছাড়া, দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা জ্যেষ্ঠ ছেলে তারেক রহমান গত আট বছর যাবৎ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লন্ডনে প্রবাসী জীবন-যাপন করছেন। পরিবারের সদস্যরা বলতে গেলে এখন আর কেউই কাছে থাকেন না খালেদার। গুলশানের বাড়িতে ব্যক্তিগত কয়েজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়েই তার বসবাস।

শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে খালেদা জিয়া তার কার্যালয়ে বসেন। সেখানেও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলে নিয়মিত গুটিকয়েক নেতার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এরপর বাসায় ফিরে যান। বস্তুত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এভাবেই চলছে বিএনপি। দলটির মধ্যে কোনো গতিশীলতা নেই। শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস নামে চেয়ারপারসনের একজন বিশেষ সহকারী রয়েছেন; যিনি মূলত খালেদা জিয়ার সঙ্গে নেতাকর্মীদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তিনি ইতোমধ্যে রাজনৈতিক গ্রুপিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় চরম বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। খালেদা জিয়া তাকে বিশ্বাস করলেও নেতাদের কাছে তিনি ‘অবিশ্বাসী’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। অথচ খালেদা জিয়া তাকে বাদ দিচ্ছেন না, বা দিতে পারছেন না।

এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, প্রথমত, তিনি হয়তো দল বা খালেদা জিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্তের স্বাক্ষী। দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়া কখনোই একা চলার মতো নেত্রী নন। পদস্থ একজন সামরিক অফিসারের স্ত্রী ও জীবনাচারের কারণে সেভাবে তিনি অভ্যস্ত নন বলেই বিএনপি নেতাদের মত। ফলে সব সময়ই অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে চলতে হয় তাকে। টেলিফোনে কথা বলা থেকে শুরু করে গাড়িতে ওঠা, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, হাতের ব্যাগবহনসহ সবকিছুতে সার্বক্ষণিক একজনের সাহায্যে চলতে হয় তাকে।

ওয়ান-ইলেভেনের আগ পর্যন্ত একাজটি করতেন এক সময়ে খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মোসাদ্দেক আলী ফালু। তাকে নিয়ে সে সময় দলের ভেতরে কখনও বির্তক তৈরি হয়নি। কিন্তু শিমুল বিশ্বাসকে নিয়ে বিতর্ক এখন দলের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরেও সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। অথচ খালেদা জিয়া তাকে সরাতে পারছেন না। বলা হচ্ছে, শিমুলের হাতে শুধু খালেদা একা নন; বিএনপির অনেককিছুই এখন জিম্মি হয়ে পড়েছে।

যতদূর জানা গেছে, আগে দলটির নেতারা চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ভয় পেতেন। আর কিছু কিছু প্রশ্নে তার চেয়েও ভয় পেতেন তারেক রহমানকে। তার উদ্যোগেই ২০০০ সালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আনোয়ার জাহিদকে একসঙ্গে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো। গত ৮ বছর  ধরে তারেক দেশে নেই। এদিকে আর্থারাইটিসসহ খালেদা জিয়া বিভিন্ন কারণে এখনও কিছুটা অসুস্থ। গত ১৫ আগস্ট বয়স তার ৬৯ পার হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকে তার ও বিএনপির ওপর ঝড়-ঝাপটাও গেছে প্রচুর। এর মধ্যে কারাগারে থেকেছেন এক বছরের বেশি। সবচেয়ে বেশি তিনি মুষড়ে পড়েছেন ক্যান্টমেন্টের শহীদ মইনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ ও ছেলে কোকো মারা যাওয়ার ঘটনায়। অনেকের মতে, এসব ঘটনা খালেদা জিয়ার শারিরীক ও মানসিক দুর্বলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। আর কমিয়ে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস। পাশাপাশি তাকে আত্মবিশ্বাসী হতে নেতারাও তেমন সফলতা দেখাতে পারেননি। শহীদ মইনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের দিন ঢাকায় ৫শ’ লোকের একটি মিছিল পর্যন্ত  বের করতে পারেনি বিএনপি। ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে দু’দফা আন্দোলনে দু’বার খালেদা জিয়াকে গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হলেও নেতারা ঝুঁকি নিয়ে কিছু করেননি।

উপরন্তু, নেতাদের মাধ্যমে ও বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবরের কারণেও খালেদা জিয়াকে আজকাল বিভ্রান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বিভ্রান্তিকর এসব খবরের কারণেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত অংশ নেয়া হয়নি। খালেদা জিয়াকে বোঝানো হয়েছিলো যে, নির্বাচন করতে সরকার শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। অনেকের মতে, খালেদা জিয়াকে ‘ব্লাকমেইল’ করা হয়েছে। আর এ কারণে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি আগের চেয়ে আরো সন্দেহপ্রবণ ও দোদুল্যমান থাকেন। দলের সকল নেতাকে এখন আর খালেদা জিয়া বিশ্বাস করেন না। গোপন কোনও ইস্যু আলোচনা হয় না দলীয় বৈঠকে। এ প্রসঙ্গে দু’এক নেতার সঙ্গে একান্ত আলোচনায় খালেদা নিজেই বলেছেন, ‘কিছু আলোচনা হলেই তা বাইরে চলে যায়।’

দলটির শীর্ষ নেতাদের ভাষ্য হলো, চেয়ারপারসনকে আগের মতো এখন আর কেউ ভয় পান না বলেই খবর বাইরে চলে যায়। পাশাপাশি দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিরও সুযোগ পায় অনেকে। এ কারণেই দেখা যায়, দলের একাংশের বাধায় গত সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘ভারপ্রাপ্ত’ হিসেবে ঝুলে আছেন মির্জা ফখরুল। একইভাবে তারেক রহমান লন্ডনে থাকলেও তার সমর্থক সাবেক ‘হাওয়া ভবনের’ কতিপয় কর্মকর্তার দলের মধ্যে নেতিবাচক তৎপরতা এখনও বন্ধ করা যায়নি। বন্ধ করা যায়নি দলে সংস্কার-অসংস্কার প্রশ্নের বিভেদও। একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও তাদের দলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। একইভাবে জামায়াত প্রশ্নেও অদ্যাবধি বিএনপি স্থিতিশীল রয়েছে।

সূত্রমতে, ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে দলের শুভাকাঙ্ক্ষীরা খালেদা জিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন না। তাদের সন্দেহ, চেয়ারপারসনকে কিছু বললে তিনি সে অনুযায়ী ব্যবস্থা বা তৎপরতা শুরু করলে গুলশান কার্যালয় থেকে তা বাইরে চলে যায়। এ কারণে সরকারের রোষানলে পড়ার ভয় আছে বলে অনেকে গুলশান কার্যালয়ে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন। এ সব মিলিয়ে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন প্রশ্নে দলটি স্থবির হয়ে পড়েছে।

সোনালীনিউজ/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!