• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিজ্ঞাপন নির্মাতা যখন চলচ্চিত্রের ঈশ্বর


মিতুল আহমেদ নভেম্বর ১৪, ২০১৬, ০৭:৪১ পিএম
বিজ্ঞাপন নির্মাতা যখন চলচ্চিত্রের ঈশ্বর

গল্প কবিতা উপন্যাস আর আঁকাআঁকির মতো চলচ্চিত্রও আর্ট। শুধু তাই না সবেচেয়ে আধুনিক, ব্যয়বহুল আর সৌখিন মাধ্যমের নামও চলচ্চিত্র। কিন্তু সবার পরে এই মাধ্যমটির জন্ম হলেও আর সব মাধ্যমগুলো থেকে কোনো অংশেই সহজতর ব্যাপার নয়। কল্পনার জগতটাকে গল্পে কবিতায় লিখে হয়তো এক পরাবাস্তব ঘোর তৈরি করে কোনোভাবে প্রকাশ করা যায়, কিন্তু তা ভিজ্যুয়াল করানোটা অবশ্যই কঠিন। যিনি যতো নিঁখুতভাবে দৃশ্যের পর দৃশ্যের গাঁথুনি দিয়ে শব্দের ঘোর তৈরিযোগে দেখাতে পারেন তিনিই প্রকৃত ঈশ্বর। তিনি টিকে থাকেন যুগে যুগে।

চলচ্চিত্র শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমগুলোর মতো পুরনো না হলেও এরই মধ্যে এমন টিকে যাওয়া নিখুঁত নির্মাতার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। হিচকক, বার্গম্যান, অরসন অয়েলস, জ্যাঁ রেঁনুয়া, ত্রুফু, সিকা, আইজেস্টাইন, তারকোভস্কি, চ্যাপলিন, সত্যজিৎ কিংবা ঋত্বিক ঘটকের মতো জগৎ কাঁপানো সব নির্মাতা একেকজন। একেকটা নাম মানে একেকটা প্রতিষ্ঠান। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করেছেন তারা। আর চলচ্চিত্রকে নান্দনিক আর শৈল্পিক দিকে প্রবাহিত করে গেছেন।

শত প্রতিবন্ধকতা মাথায় নিয়ে সেইসব নির্মাতা যেসব নির্মাণ করে গেছেন তা যেনো একেকটা মাস্টারপিস! অথচ এই প্রযুক্তিনির্ভর সময়ে বাস করেও কেউ চাইলেই একটা চলচ্চিত্র নামিয়ে ফেলতে পারছেন না। কারণ চলচ্চিত্র মানে এখন কোটি কোটি টাকার ব্যাপার। ফলে যে তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাণের পোকা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাকে প্রস্তুত হতে হয়। সাবলম্বী হতে হয়। পয়সার যোগান নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়। নির্মাণে নেমে যাওয়ার আগেই তাকে ভাবতে হয় চলচ্চিত্রের বিপনন নিয়ে। আর প্রাথমিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার মোটামুটি সহজ উপায় বিজ্ঞাপন নির্মাণ!

এই সময়টা দাঁড়িয়েই আছে বিজ্ঞাপনের উপর। এক অর্থে এখন বিজ্ঞাপনেরই যুগ। এই মাধ্যমটির প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়ে আছে সমাজে। একটা ঠুনকো জিনিষ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিষটি বেচতে ও কিনতে প্রয়োজন হয় বিজ্ঞাপনের। যে বিজ্ঞাপন মানুষকে যতোটা চমকের মধ্য দিয়ে একটা পণ্য কিনতে ও বেচতে প্রলুব্ধ করতে পারে সেটাই সফল বিজ্ঞাপন! তবে কেউ কেউ আছেন যাদের অনেকেই মানুষকে প্রলুব্ধ করার কাজটি দুর্দান্ত সৃষ্টিশীল উপায়ে করেন। এইরকম যারা করেন তারা বিজ্ঞাপনকেও চলচ্চিত্রের বনসাঁই বলে ভাবেন। কিংবা এমনটি অনেকেই নাও ভাবতে পারেন।

তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সৃষ্টিশীলতা দেখানোর পাশাপাশি বিজ্ঞাপনে আছে প্রচুর অর্থ। ফলে যে তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখছেন কিন্তু অর্থের অভাবে পেরে উঠছেন না, তারজন্য বড় প্লাটফর্ম বিজ্ঞাপন নির্মাণ। পৃথিবীর এমন অনেক বিখ্যাত নির্মাতা আছেন যাদের অনেকেই বিজ্ঞাপন নির্মাণের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন। আবার অনেকে আছেন যারা শুধুমাত্র সিনেমা নির্মাণের স্বপ্ন থেকেই মূলত ‍বিজ্ঞাপন নির্মাণে হাত দিয়েছেন। এমন স্বপ্নবান নির্মাতাদের মধ্যে সদ্য যোগ হলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘আয়নাবাজি’ নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরি।

অমিতাভ রেজা বহুদিন ধরে বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে আসছিলেন। বিজ্ঞাপন নির্মাণে তিনি বাংলাদেশে শীর্ষস্থানীয়দের একজন। সৃষ্টিশীল আর চমকপ্রদ নির্মাণে বিজ্ঞাপনের দুয়ার মাতিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার ভেতরে ছিল মূলত চলচ্চিত্র নির্মাণের বাসনা, ক্ষুধা। আর এমন ক্ষুধা যে তার ছিলই তা বোঝা যায় সদ্য মুক্তি পাওয়া আলোচিত চলচ্চিত্র ‘আয়নাবাজি’ দেখেই। যদিও ছবিটি মুক্তির আগে অনেকেই ‘একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতার চলচ্চিত্র’ বলে পাত্তাই দিতে চাননি বা উড়িয়ে দিয়েছেন। 

আমাদের দেশে বিজ্ঞাপন কিংবা নাটক নির্মাতাদের নিয়ে তাচ্ছিল্য করেন একদল মানুষ। বিশেষ করে বিজ্ঞাপন-নাটক থেকে কেউ যখন সিনেমা নির্মাণে আসেন। অমিতাভ রেজা যেন সেইসব নিন্দুকের জন্য চপেটাঘাত বয়ে নিয়ে এলেন ‘আয়নাবাজি’র মধ্য দিয়ে। আয়নাবাজি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি সফল ও কমপ্লিট পূর্ণ্যদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। যে চলচ্চিত্রে আছে একটা অসাধারণ সম্মোহনের গল্প। ঘোরগ্রস্ততার গল্প। একটা ম্যাজিকের গল্প।

রাশেদ জামানের ক্যামেরায় পুরান ঢাকার মনজুড়ানো দৃশ্য, মানুষের পারাপার আর বৃষ্টির নান্দনিক সিনেমাটোগ্রাফি। আয়না চরিত্রে বাংলা সিনেমার বিগত দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরির অভিনয় যে কাউকে টেনে নিয়ে যাবে এক মোহাচ্ছন্ন পৃথিবীতে। আবহ সংগীতের মূর্চ্ছনায় মাথা দোলাতে দোলাতে যেখানে গেলে আপনিও হয়তো অমিতাভ রেজার উদ্ভট গল্পটির বাস্তবতা খুঁজতে যাবেন না নিন্দুকের মতো।      

যদিও আয়নাবাজিকে ঘিরে এবার নিন্দুকের ভূমিকা ধোপে টেকেনি। কারণ ছবিটি বাংলা চলচ্চিত্রে মারাত্মক চমকের জন্ম দিয়েছে। প্রথম সপ্তায় দেশের মাত্র বাইশটি সিনেমা হলে মুক্তি পেলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সিনেমা হল সংখ্যাও বেড়েছে কয়েক গুনে। একটা ভালো গল্প, ভালো নির্মাণ হলে যে মানুষ বাংলা সিনেমা দেখে তারই যেনো প্রমাণ দিলেন অমিতাভ। বিজ্ঞাপনের সাথে দীর্ঘদিন জড়িত থাকার ফলে মানুষের রুচি আর বিপণনের বিষয়টিও ভালোই দেখভাল করেছেন তিনি।

নির্মিত চলচ্চিত্রের ফ্লপ-হিট নিয়ে যখন আপনাকে চিন্তা করতে হবে না তখন আপনি আপনার মনের মতো একটা গল্পে নির্মাণ দেখিয়ে দিতে পারেন। যা করেছেন অমিতাভ রেজা। এই আত্মবিশ্বাসটা তিনি নিজের মধ্যে তৈরি করেছেন ধীরে ধীরে। বিজ্ঞাপন নির্মাণের মধ্য থেকেই! তাহলে কি চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন থেকেই অমিতাভ রেজা বিজ্ঞাপনে কাজ শুরু করেছিলেন? এমনটা হতেই পারে।

শুধু অমিতাভ রেজা নন চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন থেকে বিজ্ঞাপন নির্মাণে হাত দিয়েছেন এমন নির্মাতা পৃথিবীতে অসংখ্য পাওয়া যাবে। বিশেষ করে এই মুহূর্তে বিশ্ব সিনেমায় সবচেয়ে প্রভাবশালী নির্মাতা আলেহান্দ্রো গঞ্জালেস ইনারিতুর কথা বলতেই হয়। যে মানুষটি সিনেমা নির্মাণের টার্গেট মাথায় নিয়ে কতো কিছুই না করেছেন! দু'হাজার সালে 'আমোরেস্ পেরোস্' মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত পৃথিবীর অসংখ্য অপরিচিত মানুষের মতোন তিনিও ছিলেন মামুলি একজন। এমনকি নিজের জন্ম শহর মেক্সিকোতেই! কিন্তু যার রক্তে থাকে দুনিয়া মাৎ করে দেয়ার প্রবণতা তিনি আর মামুলি থাকেন কতো কাল।

ফলত দেখা যায় প্রথম ছবি নির্মাণ করেই পূব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে প্রবল হাঁকডাক পড়ে যায় তার নামে! যদিও প্রথম সিনেমার আগে তিনি এফএম রেডিওতে করেছেন ডিজেগিরি, টিভি প্রোডাকশনের জন্য প্রমো বানিয়েছেন। সিনেমার পয়সা যোগাতে হন্যে হয়ে গেলেন তিনি। এরপর বিজ্ঞাপন বানিয়ে পয়সা আয় করেছেন শুধুই সিনেমার জন্য। মেক্সিকো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সহ-পরিচালক হতে গিয়ে দেখেছেন দুর্নীতিগ্রস্ত ইন্ডাস্ট্রি। এইসব ছেড়ে ছুড়ে ইন্ডাস্ট্রির বলয়ের বাইরে গিয়ে জমানো পয়সা আর ধার-দেনা করে বানিয়েছেন নিজের প্রথম সিনেমা আমোরেস্ পেরোস। মানে লাইফ ইজ এ বিচ! দুর্দান্তভাবে সফলও হয় ছবিটি। যদিও তার জন্মভূমি মেক্সিকোতে কেউ তখনও তাকে পাত্তায় দেয়নি।

গঞ্জালেসও সেই ইন্ডাস্ট্রির হয়ে সিনেমা বানাতে যাননি। কারণ তখন আন্তর্জাতিকভাবে তার সিনেমা একের পর এক সাফল্যের মুখ দেখে চলেছে। প্রথম সিনেমার পর একে একে তিনি বানিয়েছেন টুয়েন্টি ওয়ান গ্রামস, বাবেল, বিউটিফুল,বার্ডম্যান এবং সর্বশেষ গেল বছরে নির্মাণ করলেন আলোচিত সিনেমা দ্য রেভিনেন্ট। যার মধ্যে ২০১৫ সালে বার্ডম্যান ছিনিয়ে নেয় অস্কার সেরার পুরস্কার আর এ বছরে তার নির্মিত সিনেমা দ্য রেভিনেন্ট-এ অভিনয় করে প্রথমবারের মত সেরা অভিনেতার পুরস্কার জেতেন তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও!

তো বিজ্ঞাপন থেকে সিনেমায় যারা আসেন তাদের চিন্তা চেতনা বেশির ভাগ সময় পরিশীলিত। প্রথমেই সিনেমায় নেমে যাওয়ার সুযোগ থাকে না বলেই বিজ্ঞাপন কিংবা নাটক নির্মাণে তারা হাত দেন। বিজ্ঞাপন নির্মাণ দিয়ে আসলে তারা একটা মজবুত ভিত তৈরি করতে চান বলেই মনে হয়। হুট করে কেউ সিনেমা নির্মাণে চলে আসেন না। যারা দূরদর্শি তাদের একটা গোল থাকে, সেটা হচ্ছে সিনেমা নির্মাণ। বিজ্ঞাপন হচ্ছে ভায়া। ফলে তাদের সিনেমা জ্ঞান নিয়ে যারা চিন্তিত সন্দিহান কিংবা তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেন তাদের জ্ঞাতার্থে একটু তথ্যও যোগ করা যেতে পারে যে, পাশের দেশ ভারতের প্রখ্যাত নির্মাতা আর বাল্কিও বিজ্ঞাপনের হাত ধরে পরবর্তীতে সিনেমায় আসেন।

মূলত সিনেমার প্রতি আগ্রহ থেকেই প্রথমে বিজ্ঞাপনের কাজ করে হাত মশক্ করেন তিনি। তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘চিনি কম’ ২০০৭ সালে রিলিজ পায়। এরপর ২০০৯ সালে তার পরিচালিত সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা ‘পা’ মুক্তি পেলে নির্মাতা হিসেবে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পরে চারদিকে। এরপর ২০১৫ সালে ‘সামিতাভ’ এবং চলতি বছরে ‘কি এন্ড কা’ মুক্তি পায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো তার চারটি সিনেমার নায়কই অমিতাভ বচ্চন। যদিও সিনেমাগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে ‘পা’ ছাড়া আর কোনোটায় তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। কিন্তু তারপরও তিনি তার সিনেমার জন্য আর আর দশটা নির্মাতার চেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন।

এছাড়া ভারতের মধ্যে যারা এখন সিনেমা নির্মাতা হিসেবে বেশ নাম কুড়াচ্ছেন তাদের মধ্যে দিবাকর ব্যানার্জি, রাকেশ ওম প্রকাশ মেহরা এমনকি রাজ কুমার হিরানিও প্রথম বিজ্ঞাপন দিয়েই হাতে খড়ি। বিজ্ঞাপন বানানোর পর তারা পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মাণে আসেন। আর সিনেমা-বিজ্ঞাপন সমানতালে করে গেছেন বা এখনও করছেন এমন বিখ্যাত নির্মাতার সংখ্যাও কম নয়। এদের মধ্যে সার্জিও লিওন, ডেভিড ফিন্চার, ডেভিড লেঞ্চ, ক্রিস্টোফার নোলান উল্লেখযোগ্য।

আমাদের এখানে অনেক মেধাবী নির্মাতা আছেন, যাদের আন্তর্জাতিক মানের ছবি বানানোর সামর্থ আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা কিংবা উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তারা পেরে উঠছেন না। এখন সবারতো আর বিজ্ঞাপন বানিয়ে অর্থ কামায় করে নিজ উদ্যোগে সিনেমা বানানো সম্ভব না। ফলে সেইসব স্বপ্নবান ভবিষ্যৎ সিনেমা নির্মাতাদের সরকারি সহায়তা আবশ্যক।তাছাড়া প্রতিবছরতো সিনেমার জন্য একটা বরাদ্ধ থাকেই সরকারি তহবিলে। সেখান থেকে দলকানা কিংবা পুরনো ধ্যান ধারনার নির্মাতাদের না দিয়ে তরুণ নির্মাতাদের অর্থায়ন করলে হয়তো বছর বছর আয়নাবাজির মতো আরো বৈচিত্রপূর্ণ্য সিনেমা বাংলার দর্শক পেতে পারেন।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিএল

Wordbridge School
Link copied!