• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয়ভাবনা এবং সৈয়দ হকের ‘উত্তরবংশ’


ড. ফজলুল হক সৈকত সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৬, ০৫:১৭ পিএম
বিজয়ভাবনা এবং সৈয়দ হকের ‘উত্তরবংশ’

সৈয়দ শামসুল হক (জন্ম : কুড়িগ্রাম, ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫; মৃত্যু : ঢাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬) সব্যসাচী লেখক। তাঁকে আমরা জানি শক্তিমান কবি, কাব্যনাট্যের সফল নির্মাতা, স্বনামখ্যাত কথাশিল্পী হিসেবে। দেশের আর ভাষার গণ্ডি ছাড়িয়ে, আজ ক্রমাগত, তাঁর পরিচিতি বিশ্বসাহিত্যের বিরাট পরিসরের দিকে প্রসারিত। 

সাহিত্যপথে দীর্ঘদিনের পরিভ্রমণে তাঁর অবদান আর অর্জনের প্রকৃত মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। চেষ্টা যে চলছে না, তা নয়; তবে প্রাতিষ্ঠানিক আর গবেষণাভিত্তিক আরো প্রচেষ্টার উদ্যোগ দরকার। আমাদের আজকের প্রসঙ্গ তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞের বিবেচনা নয়; সদ্যলিখিত

একটি কাব্যনাট্যের আলোচনা। দেশমাতা আর মাতৃভাষার প্রতি নিবিড় শ্রদ্ধাশীল এই শিল্পী-প্রতিভা বরাবরই সত্য আর বর্তমানের জিজ্ঞাসা রূপায়নে নিষ্ঠাবান। 

ইতিহাস-ঐতিহ্য তাঁর সাহিত্যবোধের একটি প্রধান অনুষঙ্গও। উনিশশো একাত্তর, পাকিস্তান-বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অর্জনের সংগ্রাম, প্রতিকূলতা-অনুকূলতা, আসন্ন সম্ভাবনাস্রোতলীন মানুষ, বিপরীত স্রোতের মানুষ, সৃজনশীল সমাজের প্রত্যাশা-প্রচেষ্টা, বিবর্ণতা আর আনন্দ-বিষন্নতার গল্প সৈয়দ শামসুল হকের কবিতানাট্য উত্তরবংশ

একজন নাট্যকার, তার কন্যা, আর তাঁর এক রাজনীতিক বন্ধুকে ঘিরে মূলত আবর্তিত হয়েছে উত্তরবংশ কাব্যনাট্যের ক্যানভাস। তাদের আলাপচারিতায় নির্মিতি লাভ করেছে স্বাধীনতা-পরবর্তী বর্তমান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি, আমাদের প্রকৃত অর্জন, সাফল্য-ব্যর্থতা। পাশাপাশি লেখক উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন ব্যর্থতার কারণ আর বাতলে দিয়েছেন এ থেকে উত্তরণের পথ। কবিতানাট্যটিতে বর্ণিত নাট্যকারের বন্ধু, যিনি রাজনীতিতে ব্যয় করেছেন বিপুল সময়, অর্জন যে কিছু হয়নি এমন নয়, তিনি চান স্বাধীনতা সংগ্রামের সত্য

ইতিহাস আর বাস্তবের উত্তেজনা নিয়ে রচিত হোক একটি নাটক যা প্রেরণা হয়ে, শক্তি হয়ে বিরাজ করবে বর্তমান প্রজন্মের চিন্তায় আর প্রয়াসে। 

নাট্যকার অবশ্য স্বাধীনতাকেন্দ্রিক একটি ব্যাক্তিগত-পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে তৈরি করতে থাকেন ভিন্ন এক নাটক। দুইবন্ধুর ভাবনায়, অবশ্য, তেমন তফাৎ থাকে না, যেহেতু বিচ্ছিন্নসব ব্যক্তিগত-পারিবারিক ইতিহাসই নির্মাণ করে জাতীয় ইতিহাস; এভাবে এগোতে থাকে গল্প। আর তৈরি হতে থাকে নাটকের শরীর, রক্ত-মাংস-শিরা-উপশিরা; চিহ্নিত হতে থাকে বিভ্রান্তি আর লজ্জার ঘা-পুঁজ-রক্তবমি। প্রকাশ পায় শিল্প-বিষয়ক ধারণা; বিবৃত হয় শিল্পী আর রাজনীতিবিদের দায় ও দায়িত্ব।

বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি হিশেবে আমাদের, বাংলাদেশিদের, একটা অপবাদ থাকলেও মাত্র আটত্রিশ বছর আগের ঘটনা আমরা বেমালুম ভুলে যাবো, তা কি করে সম্ভব? মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রজন্মের বিরাটসংখ্যক মানুষ এখনও বেঁচে আছেন এবং তাদের জীবদ্দশাতেই ইতিহাস-বিকৃতির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, এই পরিস্থিতি লজ্জাকর ও অপমানজনক ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। তাই, আমাদের, এই প্রজন্মের অনুভবশক্তিতে নির্ভর করে ওই অপচেষ্টার কবর দিতে হবে, নইলে জাতিগত দৃঢ়িকরণ আর কোনোদিন সম্ভব হবে না। 

আমরা জানি, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস অত্যন্ত দীর্ঘ ও রক্তাক্ত। দীর্ঘ ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে এদেশের অসংখ্য সূর্যসন্তান বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলনকে এগিয়ে দিয়ে গেছে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন এবং সর্বশেষ ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ, সবই এক সুতোয় বাঁধা। 
    
নাটকের অভিনয়স্থান আর পাত্রপাত্রী নির্বাচন ও নামকরণে রয়েছে পরিবর্তন-প্রত্যাশার আভাস। ‘এ নাটকের অভিনয়স্থল দুটি। একটি: নাট্যকারের ফ্ল্যাট, সমুখের ঘর বসবার এবং তার লেখার। অপরটি: শূন্য একটি স্থান।’ কুশীলব রয়েছে নাট্যকার, নেতা, নাট্যকারের মেয়ে, বিপরীত-মানুষের দল, কয়েকজন যুবক, বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, শিশু, মধ্যবয়সী নারী ও যুবতীরা এবং নাট্যকারের স্ত্রী। নানান বয়স ও পেশার মানুষের উপস্থিতি যেমন নির্দেশ করে স্বাভাবিক জীবনের আবহ, তেমনি বিপরীত-মানুষের দল ইঙ্গিত বহন করে প্রতিকূল চিন্তার বাস্তবতা; আর লেখার ঘর যার অবস্থান সামনের দিকে, হয়তো শিল্পকলার বিকাশকে ধারণ করে।

নাটকের শুরুতে ছাব্বিশ মার্চ, ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর আর আরো অগ্রসর হয়ে চৌদ্দ ডিসেম্বর, রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনকের হত্যাকাণ্ড- এসব প্রসঙ্গ খুব সহজভাবেই এদেশের উদ্ভব আর স্খলন-দুর্ভাগ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। নাট্যকার আর নেতার উদ্দেশ্যও সরল এবং অভিন্ন। নেতার ভাষ্য: ‘মানুষই আমাদের উভয়ের লক্ষ্য এবং বিষয় যদিও/এমন রাজনীতিও দেশে আছে, /দেশ বা মানুষ যার লক্ষ্য নয়/ইতিহাস তাদের বিষয় নয়।/সেই ইতিহাসটা কতভাবেই না বিকৃত করে চলেছে/ওই ভ্রষ্ট রাজনীতিকের দল।...তোমাদের লেখায় অভিনয়ে গানে তোমরা তৈরি /করেছ জমি।/রোপন করেছ বীজ। 

হাজার বছরের ভাঁড়ার থেকে বীজ।/আর আমরা রাজনীতির মানুষেরা তোমাদের বীজতলা থেকে/চারা তুলে ফসল করেছি, স্বাধীনতা আমরা ঘরে তুলেছি।’ নাট্যকার মনে করেন, মানুষকে যদি সত্য আর বিভ্রম সম্বন্ধে সজাগ করা যায়, দেখিয়ে দেওয়া যায় ভুল আর অন্যায়সমূহ, মানুষের ভেতরে যদি জাগিয়ে তোলা যায় শিল্পের আলোকসভা রঙ, স্বপ্নের আর বাস্তবের সৌকর্য, তাহলে সম্ভব ‘পাহাড়ের মতো দেয়াল’ অতিক্রম করে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন। 

‘সৎ আর অসতের পার্থক্য’, খাঁটি আর ভেজালের সত্যতা নির্ণয় করতে পারলে গোপন ইতিহাসের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়বে চপাা-পড়া আগুন। তার মত হলো, শিল্প আর রাজনীতি পরস্পরের সম্পূরক; একটি জাগায় বোধ, অন্যটি দেখায় পথ। নাট্যকার বলছেন নেতা বন্ধুকে: 
শিল্প যখন আমাদেরকে স্পর্শ করে ভেতরের ব্যক্তি জেগে ওঠে।
শিল্পের এটাই কাজ, বন্ধু, এটাই হচ্ছে কাজ।
শিল্পের কাজ নয়, তোমাদের বক্তৃতার ভাষায় পথ দেখানো।
শিল্পের কাজ ভেতরের ব্যক্তিকে জাগিয়ে তোলা।
রাজনীতির কাজ ব্যক্তি নয়, সমষ্টিকে জাগিয়ে তোলা।

এই নাটকে বর্ণিত নাট্যকারের মধ্যেও রয়েছে এক এশীয় প্রবণতা

সত্যগোপনের চেষ্টা; তিনি তার জীবনে ঘটে-যাওয়া নিবিড় কষ্টকে চেপে রাখতে চান। যে মানুষটি কবিতায় বা মঞ্চে উচ্চকণ্ঠ, তিনি কেন বাস্তবজীবনে সত্যকে গোপন করছেন; কেন তাঁর এই বৈপরিত্য এমন ভাবনা তার কন্যাকে বিচলিত করে তোলে। 

সত্যপ্রকাশে সংকোচ কিংবা ভয় থেকে এমনতরো প্রবণতার জন্ম হতে পারে; হতে পারে পূর্বপুরুষের মানসিকজরাগ্রস্ততার উত্তরাধিকার। কিন্তু কেন? তার মেয়ে বলছে : “মায়ের গল্প, মায়ের কথা আমাকে অনেক তুমি বলেছ,/কিন্তু কখনোই বলনি, মা কেন আত্মহত্যা করেছিল?” নাট্যকারের স্ত্রী একাত্তরের অনেক ধর্ষিতা নারীর একজন। দেশ স্বাধীনের পর তিনি তার অপমানের বিচার হতে দেখেননি; বরং দেখেছেন জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যার ছবি, অবলোকন করেছেন বিবেচনারহিতের তাণ্ডব। 

নিজের জীবনের গ্লানিকে, দেশের অগণন মানুষের অবদমিত লজ্জাকে বারবার আঘাতের শিকার হতে দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন এই মা। তাই তিনি নিজের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে রাষ্ট্র ও জাতির সকল অক্ষমতাকে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। নিজ ভূমিকে পরাধীনতার যন্ত্রণা থেকে বাঁচাতে যে জনগোষ্ঠী সংগ্রাম করেছে, সে জাতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারেনি; বরং তাদের উত্থানকে সহ্য করেছে প্রায় নীরবে এই অবিশ্বাস্য সত্যকে মেনে নিতে পারেননি বীরাঙ্গনা এই নারী। তাই তার প্রতিবাদ; আত্মহননের পথে অবগাহন সাড়ে তিন বছরের কন্যাশিশুকে পরিত্যাগ করে সংসারের সকল মমতাকে পেছনে ফেলে সাহসের সাথে আপনজীবন-অবসানের দায় গ্রহণ করেছেন।

সৈয়দ শামসুল হক বর্তমান নাটকে সৃষ্ট নেতা চরিত্রের মধ্য দিয়ে জাতিকে জানান দিতে চান যে, প্রয়োজনে আমাদেরকে নতুন করে, প্রথম থেকে শুরু করতে হবে আন্দোলন-বিপ্লব, হত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ-স্বাধীনতাবিরোধীতার বিরুদ্ধে। গতিপথ-হারা আদর্শরহিত এই নিথর বাংলাদেশ আমাদের কাম্য ছিল না। রাষ্ট্রের স্থপতিকে হারানোর লজ্জা, তাঁর মৃতদেহ দাফন করতে না পারার ব্যর্থতা আমাদেরকে বহন করতে হবে অনন্তকাল। 

উত্তরপ্রজন্ম নিশ্চয় সেই ব্যর্থতার দায় নেবে না; দোষ দেবে আমাদেরকেই। হয়তো উত্তরপ্রজন্ম বিচারের দায়িত্ব নেবে। এমন প্রত্যাশার কথা, প্রত্যয়ের কথা ব্যক্ত করেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হক। জাতিসত্তার স্বরূপ উদঘাটনে ও প্রকাশে তাঁর এই সদিচ্ছা আমাদেরকে নানানভাবে আশান্বিত করে। বর্তমান প্রজন্মকে যুদ্ধাপরাধের সমূহ দায় থেকে মুক্ত করার জন্য, সঠিক দায়িত্বটি পালন করার জন্য এবং জাতিকে ও রাষ্ট্রকে অগ্রগতির মহাসড়কে চলার পথ তৈরি করার জন্য জাতীয় চেতনার প্রতি বিশ্বস্ততার কোনো বিকল্প নেই, এই উপলব্ধির কথামালাই সাজিয়েছেন সৃজনশিল্পী।

নাট্যকারকে বারবার ফিরে যেতে দেখি স্বাধীনতা-সংগ্রামের আগের পটভূমিতে তার নতুনগড়া সাজানো সংসার বাগানের ঠাণ্ডা শীতল শান্ত দিনগুলোতে। এখানে অবশ্য নিজেকে আড়াল করার ভূমিকায় অবতীর্ণ নন এই শিল্পী; বরং উদার স্থির জনজীবনের প্রত্যাশাকে ধারণ করেন তিনি। কঠিন বাস্তবতার বিপরীতে তিনি হয়তো বারবার খুঁজে ফেরেন তরুণ এক দম্পতির পরস্পরকে জানার নিভৃত দিনগুলোর মুছে-যাওয়া ছবি। মিথ্যের পাটাতনে সত্যের আলোককে, সামান্য করে হলেও স্বপ্নের মতো করে হলেও, দেখে নিতে চান হয়তো। নাট্যকার আমাদের শেকড়বিমুখ প্রবণতার কথাও বলেছেন কৌশলে। 

গ্রাম ছেড়ে শহরে প্রবেশ করে আমরা যেমন বেমালুম ভুলে থাকি গ্রামকে, তেমনি সামনে পাড়ি জমিয়ে আমরা বিলকুল ভুলে গেছি আমাদের রাজনৈতিক প্রত্যয়ের ইতিহাস। সন্দেহ-অবিশ্বাস-অসহিষ্ণুতা আর কীর্তির মূল্যায়নে ব্যর্থতা এসবই যেন আমাদের অর্জন!

কবিতায় নিমগ্ন শিল্পী সৈয়দ হক শিল্পের প্রেরণায় পরিশুদ্ধ করতে চান আমাদের অনুভব; মর্যাদা আর অধিকারের প্রত্যয় এবং চিন্তার মুক্তির পথ নির্মাণ করতে চান সত্য-উদ্ঘাটনের পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে। তিনি বলছেন: 
নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে আবৃত ইতিহাসের অন্ধকারে
বিকৃত ইতিহাস আর ধর্মলোপের জুজু যখন
জাপটে ধরে জাতিকে
তখন বিশ্লেষণ করবার অবকাশ আর মানুষ পাবে কী করে।

তিনি লক্ষ্য করেছেন বর্তমান প্রজন্ম মনে করে, আমাদের জাতিগত বুদ্ধিবৃত্তিক অসাবধানতার ফলে সৃষ্ট হয়েছে এই দুর্গতি। তাই কবি-নাট্যকারের পরামর্শ সকল মূর্খতা, ভাবনার অপরিচ্ছন্নতা-শূন্যতা, অপ্রকাশ-অভিপ্রায় থেকে বেরিয়ে নেতৃত্বশূন্যতাকে দূর করার পথ ও প্রত্যয় নির্মাণ করতে হবে; অনাগত নেতার আগমনবার্তার আওয়াজ শোনার মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে; তৈরি করতে হবে নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাবার রাস্তা। 

কবি সৈয়দ হক জানেন, নাটকের মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে আপামর জনতার কাছে ম্যাসেজ পৌঁছানো সহজ; অন্তত কবিতা বা গল্প-উপন্যাসের চেয়ে এটা বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তাই বর্তমান নাটকে মানুষকে জাগিয়ে তোলার তীব্র-উজ্জ্বল অভিপ্রায়, দায় আর দাবির আশাবাদ তিনি প্রকাশ করেছেন আপন যন্ত্রণার-ব্যর্থতার গ-ানিমোচনের ইচ্ছাকে মনে রেখে। এই কাব্যনাট্যটির প্রায় শেষাংশে বর্ণিত নাট্যকারের মেয়ের সংলাপে প্রকাশ পেয়েছে শিল্পী সৈয়দ হকের আকাঙ্খা। মেয়েটি বলছে: 
তোমরা শান্ত হও, শান্ত হও, হে অশান্ত আত্মা,
আমার মা, আমার বোন, আমার ভাই, আমার পূর্বপুরুষেরা,
আমি উত্তরবংশের মেয়ে, আমরাই করব বিচার।/বাবা, আমি তোমার উত্তরপ্রজন্ম তোমরা যেখানে ব্যর্থ,
আমরা সেখানে হতে চাই সফল। 

নতুন প্রজন্মের কাছে এ এক ভিন্নতর বারতা, অনাগত মানবশিশুর জন্য এক অনিবার্য প্রেরণা; অনুভবকে শাণিত করার শক্তি। জয়তু সৈয়দ শামসুল হক, জয়তু উত্তরবংশ!

 

ডক্টর ফজলুল হক সৈকত :

জন্ম ১৪ অক্টোবর ১৯৭১ রাজশাহী জেলার পুঠিয়া থানার ঝলমলিয়া গ্রামে। নিবাস পূর্বে পুঠিয়া থানার মধুখালী গ্রাম বর্তমানে নাটোর সদরের একডালা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৯২ সালে অনার্স (মেধাতালিকায় প্রথম); ১৯৯৩ সালে মাস্টার্স (মেধাতালিকায় দ্বিতীয়) এবং ২০০৩-এ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন। পরবর্তীকালে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ এবং চাইনিজ ভাষায় ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বাবা মরহুম ডা. মো. আবুল হোসেন, মা মমতাজ বেগম, স্ত্রী জান্নাতুল পারভীন, পুত্র অনিরুদ্ধ অস্মিত সৌভিক, কন্যা সম্প্রতি সোপান শ্রেয়সী।

প্রকাশিত গ্রন্থ : প্রবন্ধ-গবেষণা : শব্দসৌভিক বাংলা ব্যাকরণ ও রচনারীতি, তিরিশোত্তর কাব্যধারা ও আহসান হাবীবের কবিতা, আধুনিক বাংলা কবিতা : বিষয় ও প্রবণতা, সরদার জয়েনউদ্দীনের কথাসাহিত্য : সমাজ ও সমকাল, অবসন্নতার অন্তরালে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় : বিভ্রান্তি ও বাস্তবতা, কথাসাহিত্যের কথা, কবিতায় সমাজ ও রাষ্ট্র, সাহিত্যে গীতলতা ও প্রতিবাদ, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভাবনা, ভাষা চর্চা ও শিক্ষা-পরিকল্পনা, বাংলা কবিতায় সমকাল, বাংলা লেখার নিয়ম, সাহিত্য ও সৌন্দর্য, বই বইমেলা ও প্রকাশনা।

সম্পাদনা : জসীম উদ্দীন : ঐতিহ্যের অহংকার, কথাশিল্পী আবু ইসহাক, জীবনানন্দ : কবি ও কথাশিল্পী, বাংলাদেশের সাহিত্য: বিষয় ও প্রবণতা, নজরুলের চিন্তাবিশ্ব, মুহম্মদ মতিউর রহমান : জীবন ও কর্ম, লালন : চিন্তা ও কর্ম, সাহিত্যতত্ত্ব-জিজ্ঞাসা, কথানির্মাতা সেলিনা হোসেন, লালন সাঁই-এর জীবন ও গান;

ছোটদের বই : ছোটদের বাংলা লেখার নিয়ম, অনি-প্রীতির পাঠশালা। ছোটগল্প : বিড়ির আলোয় পরির মুখ। এছাড়া বেসরকারি উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানের কিছু গ্রন্থের ভাষা-সম্পাদনা এবং কয়েকটি গ্রন্থের ভূমিকা রচনা করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে নাটোর জেলার কাফুরিয়া কলেজে অল্পকাল অবৈতনিক শিক্ষক হিশেবে কাজ করেছেন। অতঃপর ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে ঢাকা কমার্স কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে প্রকৃত কর্মজীবনের শুরু। ৯ জুন ২০০৫ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিশেবে কর্মরত; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং সুইডেন থেকে প্রকাশিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকায় কবিতা, গল্প, সাহিত্য-সমালোচনা এবং কলাম লিখছেন।

পুরস্কার ও সন্মাননা :

বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান উপস্থাপক, পাণ্ডুলিপি লেখক ও সংবাদ পাঠক। বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং ফররুখ একাডেমীর সদস্য। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৩ সালে পেয়েছেন ‘উর্মি-ইসলাম পুরস্কার’, রোটারী ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮০ বাংলাদেশ প্রদত্ত ‘বেস্ট জোনাল কালচারাল অ্যাকটিভিটিজ অ্যাওয়ার্ড ১৯৯৫’ এবং ‘বেস্ট প্রফেশনাল ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড ১৯৯৬’ পেয়েছেন।

এছাড়া  শিল্প-সাহিত্য ও সামাজিক উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ক্যামব্রিয়ান কলেজ প্রদত্ত ‘বিশ্ব কবিতা দিবস বিশেষ সম্মাননা ২০০৯’ এবং উত্তর বাঙলা সংস্কৃতি পরিষদ প্রদত্ত ‘গবেষণা সাহিত্যে উত্তর বাঙলা বিজয় দিবস পদক-২০১১’ লাভ করেছেন। সুইডেন থেকে ‘অনুশীলন সাহিত্য পুরস্কার- ২০১৩’। বাংলাদেশ কবিতা পরিষদ থেকে ২০১৪ সালে ‘সরদার জয়েনউদদীন সম্মাননা’, ২০১৫ সালে সিএনসি প্রদান করে ‘সৈয়দ আলী আহসান পদক’।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!