• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিতর্কিত নতুন আইনে বাল্যবিয়ে বাড়ার ঝুঁকি!


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ৪, ২০১৭, ০৬:২১ পিএম
বিতর্কিত নতুন আইনে বাল্যবিয়ে বাড়ার ঝুঁকি!

ঢাকা: দেশের জাতীয় সংসদে পাস হওয়া বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন নিয়ে বিতর্ক চলছেই। গত ২৪ নভেম্বর আইনটির খসড়া মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়ার পর থেকেই শুরু এই বিতর্ক গত সোমবার সংসদে পাস হওয়ার পর আরো বেড়েছে।

মেয়ে ও ছেলের বিয়ের বয়সের ক্ষেত্রে যে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপট’ নিয়ে আপত্তি ছিল বিভিন্ন মহলের, সেই আপত্তি শেষ পর্যন্ত আইনে থেকে যাওয়ায় শঙ্কিত বিশিষ্টজনরা। আইনে বিয়ের জন্য মেয়ে ও ছেলের বয়স ন্যূনতম ১৮ ও ২১ বছর বহাল রাখা হলেও ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ কম বয়সে বিয়ের সুযোগ রাখাতেই মূল আপত্তি তাদের।

এ নিয়ে সরকারের ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট দেশের ও আন্তর্জাতিক নারী ও মানবাধিকার সংগঠন। এমনকি শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘও সরকারের এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে আইনটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়ার পর থেকেই এসব সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়ে মেয়েদের বিয়ের বয়সসীমা শিথিল করার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছিল।

সভা সেমিনার, মানববন্ধন, জনমত গঠন থেকে শুরু করে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপট’ পরিবর্তনে বৈঠক পর্যন্ত হয়েছে। বয়স কমানোর বিধানের সুযোগে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে উৎসাহিত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তা বাতিলের দাবি তুলেছিল দেশি-বিদেশি মানবাধিকার ও নারী সংগঠনগুলো।

তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বিরোধিতাকারীরা বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে ‘অজ্ঞাত’। সমাজ বাস্তবতার কথা বিবেচনায় রেখেই এই আইন করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত নানাজনের এসব মতামতকে অগ্রাহ্য করে বয়সের ক্ষেত্রে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপট’ রেখেই পাস হলো বিলটি। বিরোধিতাকারীদের অভিযোগ, বাল্যবিয়ের হার কম দেখাতেই এই আইন সংশোধন করছে সরকার।

তবে বিশিষ্টজনদের এমন উদ্বেগে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। তিনি বলেন, যেকোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতেই পারে। কোনো ঘটনা ঘটলে আদালত ও বাবা-মায়ের সম্মতি থাকলে তবেই বিয়ে হতে পারে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করলেও কিশোর-কিশোরীদের প্রেম বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটি নয়।

কোনো কিশোরী পরিস্থিতির শিকার হয়ে গর্ভবতী হলে, তখন তার ভবিষ্যৎ কি হবে? অভিভাবকহীন প্রতিবন্ধী কিশোরীর থাকার জায়গা না থাকলে ১৮ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা না করে মেয়েটিকে ভালোর জন্য বিয়ে দেয়া যেতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রগুলো আইনের বিধিতে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।

আর বিশেষ বিধান প্রসঙ্গে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগমের দাবি, ‘বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৬’ এর বিশেষ বিধানকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।

আইনের বিশেষ বিধানে বলা আছে- শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, বিশেষ ক্ষেত্রে বিয়ের বয়স ১৮’র নিচে বিবেচনা করা যাবে। শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বলতে কি বোঝানো হয়েছে তা বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে স্পষ্ট করা হবে। এই আইনটি অন্য যে কোনো আইনের তুলনায় শক্তিশালী। এ আইনে বাল্যবিবাহ সম্পাদনে জড়িত সকল পক্ষের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

তা হলে আইনটি নিয়ে কেন এমন উদ্বেগ এবং আইনে সংযুক্ত মেয়ে-ছেলেদের বিয়ের বয়সের ক্ষেত্রে এই বিশেষ বিবেচনা কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে- জানতে কথা হয় দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে।

তারা বলেছেন, বিশেষ বিধান যুক্ত করে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৬’ পাস করা হলে মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষমতায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বৃদ্ধি পাবে নারীর প্রতি সহিংসতা। অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ করতে গিয়ে মাতৃমৃত্যু ঝুঁকি ও গর্ভপাতজনিত ফিস্টুলার মতো মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার হার এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে যাবে।

দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে এই আইনের মধ্য দিয়ে দেশের মেয়েদেরকে আরো বেশি বাল্যবিবাহের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হবে। এই আইন সারাদেশে অভিভাবকদের এই বার্তা দেবে যে, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে সরকার বাল্যবিবাহকে যৌক্তিক মনে করছে। ১৮ বছরের আগেও মেয়েদের বিয়ে দেয়া যায়। দেয়া সম্ভব।

বিশিষ্টজনরা এমন কথাও বলেছেন, এই আইনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে, ধর্ষণের কারণে কোনো মেয়ে গর্ভবতী হলে, তাকেও এই আইন দেখিয়ে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়েতে বাধ্য করা হতে পারে। এ জন্য তারা বিশেষ বিধান ছাড়া ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৬’ অনুমোদন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ১৮ নিচের মেয়েদের বিয়ে দেয়া হলে বাল্যবিবাহ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাবে। আমাদের আশঙ্কা প্রতিটি ক্ষেত্রই বিশেষ ব্যবস্থার আওতায় পড়বে।

তিনি বলেন, আইনটিতে আছে কোনো কারণে যদি কিশোরী গর্ভধারণ করে তবে বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে বিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু কোনো মেয়ে ১২ থেকে ১৬ বছরের কিশোরী গর্ভধারণ করলে কি হবে? এমনিতেই বিয়ের বয়স ১৮ বছর রেখেই দেশে বাল্যবিবাহ কমানো যাচ্ছে না। এই অবস্থায় এই বিশেষ বিধান বাল্যবিবাহকে উৎসাহিত করবে এবং তা আরো বাড়িয়ে দেবে। তার মানে আমরা কি পিছিয়ে যাচ্ছি?

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, এখনো দেশে বাল্যবিবাহের উচ্চহার একটি নেতিবাচক দিক। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে বিশেষ বিধান বাল্যবিবাহের হার আরো বাড়াবে। কারণ দেশের বাস্তবতায় ‘বিশেষ বিধানের’ অপব্যবহারের আশঙ্কা অনেক বেশি। বাল্যবিবাহ (প্রতীকী) বিশেষ ক্ষেত্রে মেয়েদের বয়সসীমা শিথিলের সুযোগ রেখে প্রস্তাবিত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ধর্ষক ও প্রভাবশালীদের সুবিধা দেবে।

ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট-১৯২৯’ বাতিল করে নতুন এই আইন করা হচ্ছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। সংসদীয় কমিটি ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ মেয়েদের বয়সসীমা শিথিলের সঙ্গে পুরুষদেরও এ সুবিধার আওতায় আনার বিষয়টি যুক্ত করে।

এ ছাড়া ‘কোনো নারীর’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ এবং ‘মাতা-পিতা’র সঙ্গে ‘প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের’ সম্মতির শব্দটি যোগ করেছে। এ আইনে বলা হয়েছে, ছেলের ২১ এবং মেয়ের ১৮ বছর বয়সের সীমারেখা ঠিক থাকলেও ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ আদালতের অনুমতি নিয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের সর্বোত্তম স্বার্থে বিয়ে দেয়ার বিধান রাখা হয়।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন

Wordbridge School
Link copied!