• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশে জিম্মি দেশে মুক্তিপণ!


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ২০, ২০১৭, ১২:১৮ এএম
বিদেশে জিম্মি দেশে মুক্তিপণ!

জমি বিক্রি আর ধার-দেনা করে আদম বেপারীর হাতে টাকা তুলে দিয়েছিলেন যুবক সুমন। মালয়েশিয়া পাঠিয়ে তাকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আদম বেপারী সেলিম মাস্টার। কিন্তু সুমনকে পাঠিয়ে দেয়া হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ লিবিয়ায়। লিবিয়ার বিমানবন্দরে নামার পরই সেলিম মাস্টার চক্রের হাতে বন্দি হয় সুমন। 

এরপর অমানষিক নির্যাতন করে সুমনের পরিবারের কাছ থেকে সেলিম মাস্টার হাতিয়ে নেয় সাড়ে তিন লাখ টাকা। কিন্তু সাড়ে তিনলাখে খায়েশ না মেটায় সুমনকে মেরে ফেলার ভয় দেখানো হয়। অবশেষে র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করলে সেলিম মাস্টারকে আটক করে চাপ প্রয়োগ করায় সুমনকে ছেড়ে দিলে বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফিরেন। 

শুধু সুমন নয়, স্বজনদের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে ভিটেমাটি বিক্রি করে পাচারকারীর মাধ্যমে বিদেশে গিয়ে শতশত যুবক বন্দি জীবন কাটাচ্ছে। লিবিয়াসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে রাজনৈতিক অস্থিশীলতা এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের লোক স্বল্পতার কারণে বন্দিদের ফিরিয়ে আনতেও পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। এসব দেশ থেকে টাকা পাঠানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় উপার্জনের টাকাও কেড়ে নিচ্ছে এইসব মানবপাচারকারী চক্র। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা অভিযানে এই চক্রের ১৫ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৩। এসময় উদ্ধার করা ভুক্তভোগী ১১ জনকে। 

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, দেশী-বিদেশী অর্ধশতাধিক চক্র স্বল্প আয়ের মানুষদের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে চাকরি নামে মানব পাচার করছে। এসব চক্রের হাতে জিম্মি শতশত মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বনে জঙ্গলে কিংবা বন্ধ ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। নির্যাতনের কারণে অনেকের মৃত্যু হচ্ছে। ভিটেমাটি বিক্রি করে বিদেশে যাওয়া এসব মানুষ নি:স্ব হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে যাচ্ছে জীবনও। 

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আদম পাচারকারীরা লিবিয়া, ইরাক, সুদান, উগান্ডা, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা পাচার করছে। এসব দেশের বেশিরভাগই যুদ্ধ বিধ্বস্ত হওয়ায় রাজনৈতিক অস্থিশীলতার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিস্কিয়। বাংলাদেশের দূতাবাসের লোকজন ও কাজকর্ম সীমিত হয়ে পরায় জিম্মিদের সহজে ফিরিয়েও আনতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অনেক ক্ষেত্রে তারা অভিযোগ পেয়েও ভুক্তভোগীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অসহায়। 

জিম্মি থেকে কোনমতে প্রান ফিরে আসা লোকজনও জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশে আদম পাচারকারীদের হাতে শত শত বন্দি লোক রয়েছে। লিবিয়া থেকে ফিরে আসা সুমন আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, তাকে লিবিয়ার একটি ছোট ঘরে ২৬ দিন বন্দি করে রেখে অমানসিক নির্যাতন করা হয়। র‌্যাব আদম পাচারকারী সেলিম মাস্টারকে চাপ প্রয়োগ করায় তাকে ওই দেশের চক্র ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। লিবিয়ার সেই একই ঘরে আরও ২৫ জন এখনো বন্দি আছে। তারা সবাই বাংলাদেশী। তারা এখনো উদ্ধার হয়নি। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্ণেল খন্দকার গোলাম সারওয়ার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিশীলতার কারণে ওইসব দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ কঠিন। বাংলাদেশের দূতাবাসেরও লোক স্বল্পতা রয়েছে। আদম পাচারকারীদের ধরে তাদের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে আনা চেষ্টা করা হবে। এ জন্য যে সব লোক আদম পাচারকারীদের কাছে বিদেশে বন্দি আছে তাদের পরিবারকে র‌্যাবের সাথে যোগাযোগ করারও পরামর্শ দেন তিনি।

পুলিশের অপরাধী তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এক কর্মকর্তা জানান, লিবিয়া, তুরস্ক, ইরাক, ইরান, দক্ষিন আফ্রিকা ও মালয়শিয়ায় সবচে বেশী জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি সিরিয়া ও সুদানেও এ ধরনের চক্র গড়ে উঠেছে।এসব বৈধ কিংবা অবৈধভাবে দীর্ঘদিন ধরে একটি দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের মধ্যে কিছু ব্যাক্তি স্থানীয় কিছু অপরাধীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে। তাদের সহযোগিতায় দেশী-বিদেশী অপহরনকারী চক্র এ ধরনের অপরাধ করছে। 

আবার ঘটনার শিকার ব্যাক্তিদের অনেকই অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ায় তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নেয় অপহরনকারীরা। অপহৃত হওয়ার পর তাদেরকে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি ভয় দেখানো হয় পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়ার। তাই বাধ্য হয়েই তারা মেনে নেয় অপহরনকারীদের দাবী। এসব ক্ষেত্রে দেশের পুলিশকেও ভিকটিমের পরিবারের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয় না।  তিনি আরও জানান, এসব দেশের কিছু দুর্নীতিপরায়ন পুলিশ সদস্যের অসহযোগিতার কারনে অনেকক্ষেত্রেই এই চক্রগুলোকে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। 

অন্যদিকে লিবিয়া ও ইরাকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীল থাকায় সেখানেও এ বিষয়ে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল সেসব দেশেই এসব চক্র বেশী সক্রিয়। তাই অবৈধ পন্থায় বিদেশ না যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

সম্প্রতি মানবপাচারকারী ও জিম্মি চক্রের ১৫ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে  র‌্যাব-৩। গ্রেফতারকৃতদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া গমনের চেষ্টায় থাকা ১০ জনকে উদ্ধার করা হয়। এছাড়া লিবিয়া থেকেও একজনকে উদ্ধার করে দেশে এনেছে র‌্যাব। বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্ণেল খন্দকার গোলাম সারওয়ার। 

তিনি আরও জানান, গত ২ জানুয়ারি নুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি লিবিয়ায় তার ছোট বোনের স্বামী সুমনকে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা জানিয়ে র‌্যাব-৩ কার্যালয়ে অভিযোগ করেন। ইতিমধ্যে তারা বোন জামাইয়ের মুক্তিপণ হিসেবে সাড়ে ৪ চার লাখ টাকা দিয়েছেন। তারপরও জামাইকে মুক্তি না দিয়ে অপহরণকারীরা আরো দেড় লাখ টাকা দাবি করে। অভিযোগ পেয়ে তদন্ত নামে র‌্যাব। 

একপর্যায়ে রাজধানীর বারিধারার মোস্তফা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে মুক্তিপণের টাকা নিতে আসা মূল হোতা মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান (৪৫), সহযোগী শফিকুল ইসলাম ও মাসুম আহমেদকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরপর তাদের দেয়া তথ্যে, অপহরণে জড়িত আরো ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। আর দূতাবাসের সহায়তায় লিবিয়ায় অপহৃত সুমনকেও উদ্ধার করা হয়। সুমনকে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে আনা হয়।

র‌্যাব জানায়, অপহরণের ঘটনায় জড়িত ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা আর্ন্তজাতিক মানবপাচারকারী ও জিম্মিকারী চক্রের সদস্য। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট, বিভিন্ন দেশের জাল ভিসা, ভিসা তৈরীর সামগ্রী এবং বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রাসহ নগদ প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অপহরণকারীরা জানায়, জনশক্তি রফতানির বৈধ কোনো কাগজপত্র ছাড়াই তারা বিদেশে লোক পাঠিয়ে আসছিল। 

তারা বিমান, স্থল ও নৌপথের মাধ্যমে ভারত, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, চায়না, থাইল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য, ইতালী, কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশে মানবপাচার করে আসছে। এজেন্টের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক লোক সংগ্রহ করত। স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে বিদেশে গমনের প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করা হত। 

পরে বিদেশগামীদের দেশি-বিদেশি এজেন্ট ও দেশীয় এয়ারপোর্টে দায়িত্বরত অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে ইমিগ্রেশন পার করানো হয়। বিদেশে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের সে দুর্গম এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর মুক্তিপণের টাকা আদায়ে পরিবারকে ফোন দেওয়া হয়। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে চলছে দেশি-বিদেশি অপহরণকারী চক্রের ভয়ংকর অপরাধ।

এদিকে গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের তৈয়ব মোল্লা (২০) ও তার ভগ্নিপতি আজিজুর রহমান মোল্লা (৪৮) কানাডায় যাওয়ার জন্য স্থানীয় এক দালালের হাতে তুলে দেন ১৮ লাখ টাকা। নির্দিষ্ট দিনে তারা উড়াল দেন কানাডার উদ্দেশে। কিন্তু ৩ দিন পর দক্ষিণ আফ্রিকার এক জঙ্গল থেকে তারা ফোনে পরিবারকে জানায়, গভীর জঙ্গলের ভেতর একটি ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে তাদের। ১০ লাখ টাকা না দিলে তাদের মুক্তি মিলবে না। 

একই বছরের ২৩ জুলাই রাজধানীর দক্ষিণখানের ব্যবসায়ী ফয়েজ আহমেদ ব্যবসার কাজে মালয়েশিয়া যাওয়ার পর অপহরণকারীদের খপ্পরে পড়েন। অপহরণকারীরা তার মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করে এক কোটি টাকা। টাকা দিতে দেরি হওয়ায় নির্মম নির্যাতনের শিকার হন তিনি। 

পরে এ ঘটনায় দেশে মুক্তিপণ নিতে গিয়ে মা-ছেলেসহ অপহরণ চক্রের ৭ সদস্য র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হন। গত ২০ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়া জিম্মি করে আবুল খায়ের নামে এক যুবককে। ওই ঘটনায় বিদেশে অপহরণ করে দেশে মুক্তিপণ আদায় চক্রের আব্দুল হাই, মনা মিয়া ও  শামছু মিয়াকে রাজধানীর পল্টন থেকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। 

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!