• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
শুল্ক ফাঁকি

বিলাসবহুল ৪শ গাড়ির পেছনে ছুটছে গোয়েন্দারা!


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ১৩, ২০১৭, ০৮:৪১ পিএম
বিলাসবহুল ৪শ গাড়ির পেছনে ছুটছে গোয়েন্দারা!

ঢাকা: কূটনৈতিক সুবিধা নিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি বেড়েই চলেছে। কূটনীতিক ছাড়াও তালিকায় রয়েছে প্রবাসী, পর্যটক, জনপ্রতিনিধি ও বিশেষ ব্যক্তিরা। তারা শুল্কমুক্ত (কারনেট) সুবিধা নিয়ে বিদেশ থেকে বিলাসী গাড়ি আমদানি অব্যাহত রেখেছেন। কেউ কেউ আবার এমন সুবিধা কাজে লাগিয়ে অবৈধব্যবসা ফেঁদে বসেছেন। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আনা হচ্ছে বিলাসবহুল এসব গাড়ি।

আমদানিতে চলছে এখন শুল্ককর ফাঁকির মহোৎসব। জনপ্রতিনিধি, বিত্তশালী-প্রভাবশালী ব্যক্তি ও মডেলরা এই কাতারে চলে এসেছেন। তারাই অবৈধ ওইসব গাড়ির ক্রেতা। শুল্ক গোয়েন্দাদের হিসাবে দেশের রাস্তায় বর্তমানে চার শতাধিক অবৈধ বিলাসবহুল গাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর এসব কব্জা করতেই মাঠে নেমেছেন শুল্ক গোয়েন্দারা। পেতেছেন ফাঁদ।

গেল এক বছরে অভিযান চালিয়ে ৩৯টি অবৈধ বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। তবে এসব গাড়ির মালিক কিংবা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে আটক করতে পারেনি। বিভাগীয় মামলা দিয়েই তারা দায় সেরেছেন। এসব কারণে শুল্ক গোয়েন্দাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রমতে, শুল্কমুক্ত সুবিধা ও শুল্ক ফাঁকি দেয়া এমন চার শতাধিক গাড়ি দেশজুড়ে চলছে। ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন নিয়ে চলছে এসব গাড়ি। উচ্চমূল্যের গাড়ি আমদানির সঙ্গে সংযুক্ত কাগজপত্রে কমদামি গাড়ির তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি হস্তান্তর করার সুযোগ না থাকলেও ভুয়া কাগজপত্রে নিবন্ধন করে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে কোটি টাকা মূল্যের এসব গাড়ি। কেনাবেচার সময় ব্যবহার করা হচ্ছে ভুয়া নম্বর প্লেটও। এতে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (সিআইআইডি) মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, আন্তর্জাতিক চুক্তির কারণে কূটনীতিক ও সুবিধাভোগী ব্যক্তি বিভিন্ন শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করেন। এদের একটি অংশ শুল্ক ফাঁকিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এমনকি তারা মানি লন্ডারিংও করছেন। এ রকম চার শতাধিক বিলাসবহুল গাড়ির অপব্যবহার হচ্ছে দেশে। এসব গাড়ির সন্ধান ও আটকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।

কেস স্টাডি-১: লন্ডন প্রবাসী সিলেটের রূপা মিয়া পর্যটক ভিসায় দেশে আসেন ২০১০ সালের ৭ অক্টোবর। তিনি কারনেট সুবিধায় আরএক্স ৩০০ মডেলের কালো রঙের একটি লেক্সাস জিপ নিয়ে আসেন। পরে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে সিলেটে বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন করান গাড়িটির। এরপর গাড়িটি বিক্রিও করে দেন।

কাগজপত্রে বলা হয়, গাড়িটি ২০১৪ সালের ২৯ মে জাপান থেকে আমদানি করা হয়েছে। পরে শুল্ক গোয়েন্দারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, নিবন্ধনের জন্য জমা দেয়া কাগজপত্র একটি পোশাক রপ্তানিকারকের পণ্যের চালানের। ২০০৪ সালে তৈরি গাড়িটির মূল্য দুই কোটি টাকা। দুই বছর আগে সিলেটের এন কে করপোরেশন থেকে ৭৫ লাখ টাকায় গাড়িটি কেনেন এক ব্যবসায়ী। গত বছরের ২৫ জুন সুনামগঞ্জ থেকে গাড়িটি জব্দ করেন শুল্ক গোয়েন্দারা।

কেস স্টাডি-২: কূটনীতিক সুবিধায় আমদানি করা শুল্কমুক্ত অত্যন্ত বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করতেন ঢাকায় উত্তর কোরিয়া দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি হ্যান সন ইক। ২০১৫ সালে রুপালি রঙের রোলস রয়েস গোস্ট মডেলের ৩০ কোটি টাকা দামের এই গাড়িটি বিএমডব্লিউ এক্স৫ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।

৬৬০০ সিসির এই গাড়ির শুল্ককর প্রায় ২২ কোটি টাকা। তাই শুল্ক ফাঁকি দিতেই আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা দেয়া হয়। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর এই বিলাসবহুল গাড়িটি রাজধানীর আইসিডি কমলাপুর বন্দর থেকে জব্দ করেন শুল্ক গোয়েন্দারা। তবে এর আগে গত বছরের ২৮ আগস্ট কূটনীতিক হ্যান সনকে সিগারেট চোরাচালানের দায়ে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

সিআইআইডি সূত্র জানায়, ‘কারনেট দ্য প্যাসেজ’ আইনের আওতায় একজন পর্যটক ইচ্ছা করলে গাড়ি নিয়ে শুল্ক ছাড়াই কোনো দেশে যেতে পারেন। তবে শর্ত হলো ফিরে যাওয়ার সময় গাড়িটি সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য পর্যটকদের ‘রয়েল অটোমোবাইল ক্লাব অব ইউকে’ থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। তবে বাংলাদেশে এ ক্লাবের কোনো শাখা নেই। তাই কারনেট সুবিধায় শুল্কমুক্ত গাড়ি আনা হচ্ছে দেশে। এ সুবিধায় আনা গাড়ির মেয়াদ ছয় মাস থেকে এক বছর।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম না হলে যৌক্তিক আবেদনে অবস্থানকাল বাড়িয়ে নেওয়ারও সুযোগ আছে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় পর্যটকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবৈধভাবে গাড়ি বিক্রি করে দিয়ে যান। কারনেট সুবিধার বাইরে কয়েকটি খাতের বিশেষ ব্যক্তিরা যেমন কূটনীতিক, বিদেশি ও শিল্পপতিরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করতে পারেন। বিদেশিদের ক্ষেত্রে এসব গাড়ি নির্দিষ্ট সময় পর নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু অনেকেই গাড়ি আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে শুল্কমুক্ত ও পর্যটন সুবিধার অপব্যবহার করছেন।

শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা গাড়ির মধ্যে রয়েছে— রোলস রয়েস, বিভিন্ন মডেলের মার্সিডিজ বেঞ্জ, বিএমডব্লিউ, ল্যান্ড রোভার, রেঞ্জ রোভার, পোর্শে, লেক্সাস, ওডি রেসিং কার, হ্যামারসহ বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল গাড়ি। মডেল ভেদে এসব গাড়ির দাম এক কোটি টাকা থেকে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত।

চার হাজার সিসির ওপরে এ ধরনের গাড়ি আমদানির শুল্ক, সম্পূরক শুল্কসহ মোট শুল্ককর পরিশোধ করতে হয় ৮৪০ শতাংশ হারে। আর ১৫০০ সিসির নিচে গাড়ি আমদানিতে কর দিতে হয় ১৪০ শতাংশ। গাড়ির আমদানিতে খরচ বহুগুণ হওয়ায় কৌশলে কারনেট সুবিধার আওতায় গাড়ি আনা হচ্ছে। শুল্কমুক্ত আমদানি করা এ ধরনের গাড়ির বেশি অপব্যবহার করছেন বিদেশি ও বহুজাতিক সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কূটনৈতিক ও পর্যটন সুবিধাভোগীরা।

অভিযোগ আছে, বিআরটিএ, শুল্ক গোয়েন্দা, এনবিআর ও পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় এই অবৈধ কারবার চলছে। এসব দামি গাড়ি ব্যবহার করছেন শুধু ব্যবসায়ী-শিল্পপতিই নন, শিক্ষক ও শোবিজ তারকারাও। অবৈধ এই গাড়ির মালিকদের কেউ কেউ ধরা পড়ার ভয়ে রাস্তায় কিংবা কোনো গ্যারেজে এগুলো রেখে পালিয়ে যাচ্ছেন। অভিযান চালিয়ে এসব অবৈধ গাড়ি উদ্ধারও করছেন শুল্ক গোয়েন্দারা।

কূটনৈতিক সুবিধার অপব্যবহার করে আনা কয়েকটি গাড়ি জব্দ: ১ জানুয়ারি গুলশানের ইংলিশ ইন অ্যাকশন নামে একটি সংস্থার কার্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) জুনিয়র প্রফেশনাল মিজ নিসকে জ্যানসেন এবং ২২ ডিসেম্বর আরেক কর্মকর্তা কিশোর কুমার সিংয়ের মারুতি সুজুকি ব্রান্ডের দেড় কোটি টাকা দামের পাজেরো জিপ গাড়ি আটক করেন শুল্ক গোয়েন্দারা। গাড়ি দুটি অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়।

গুলশান-২ নম্বর থেকে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর জাফর সাদেক চৌধুরী নামের এক ব্যবসায়ীর মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা বিএমডব্লিউ এক্স-ফাইভ মডেলের একটি গাড়ি জব্দ করা হয়। ২৮ নভেম্বর উত্তরা থেকে ইউএনডিপির সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর স্টিফেন প্রিসনারের ব্যবহৃত মিতসুবিশি পাজেরো ব্রান্ডের একটি গাড়ি আটক করা হয়। গত বছরের ২৮ আগস্ট রাজধানীর কাকরাইলে পরিত্যক্ত মার্সিডিজ বেঞ্জ ব্রান্ডের একটি গাড়ি জব্দ করেন শুল্ক গোয়েন্দারা।

গাড়ির ভেতর পাওয়া একটি খোলা চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আমার দখলে থাকা গাড়িটি শুল্ক গোয়েন্দা সদর দপ্তরে জমা দিলাম। আমি এ গাড়িটি জমা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই। আমার মতো অন্যরাও যেন অনুরূপভাবে অবৈধ গাড়ি জমা দেন।’ কারনেট সুবিধায় তিন কোটি টাকা মূল্যের এ গাড়িটি আনা হয়েছিল। ১ আগস্ট চট্টগ্রামে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া প্রায় ১১ কোটি টাকা দামের রেঞ্জ রোভার ও পোরশে মডেলের দুটি গাড়ি জব্দ করা হয়।

৬ এপ্রিল গুলশানে জাকিয়া মুনের ৩ কোটি টাকা দামের পোর্শে মডেলের একটি গাড়ি, ৪ এপ্রিল গুলশান থেকে বুয়েটের শিক্ষক কাজী ফাহরিবা মোস্তফার তিন কোটি টাকা দামের বিএমডব্লিউ এক্স-ফাইভ, ২ সেপ্টেম্বর সিলেটের লন্ডনি রোড থেকে জাগুয়ার এস, ৫ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার থেকে নিশান ৩০০-জেড এক্স ও ২২ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল রোডের একটি ওয়ার্কশপ থেকে মিতসুবিশি গাড়ি জব্দ করা হয়।

২৬ জুলাই মংলা বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় আনা ভক্সওয়াগনের একটি গাড়িও জব্দ করা হয়। তা ছাড়া গত বছরের ১০ মার্চ ৩৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চারটি গাড়ি অবৈধভাবে আমদানি করায় দুবাই এভিয়েশন করপোরেশনের বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় মামলা করেছেন শুল্ক গোয়েন্দা।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!