• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ববাজারে পাটপণ্যের রফতানির সম্ভাবনা উজ্জ্বল


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ৭, ২০১৮, ১১:৫৭ এএম
বিশ্ববাজারে পাটপণ্যের রফতানির সম্ভাবনা উজ্জ্বল

ঢাকা : সোনালি আঁশের বাজার পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা বাড়ায় বিশ্বেজুড়ে বাড়ছে বাংলাদেশি পাটের বাজার। পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন হওয়ায় বিশ্ববাজারে পাটপণ্যের রফতানির সম্ভাবনাও উজ্জ্বল।

বিশ্বের পাট উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে ভারতই প্রথম। তবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে পাটের উৎপাদন দ্রুত বাড়ায় কমেছে দু’দেশের উৎপাদনের ব্যবধান। এই উৎপাদন প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ ধরে রাখতে পারলে উৎপাদনে শীর্ষস্থান সহসাই দখলে আসবে। পাট রফতানিতে শুরু থেকেই শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ আজো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিশ্বের মোট আমদানির ৮০ শতাংশ সরবরাহ হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। এমনকি ভারতেও পাট রফতানি করছে।

সারা বিশ্বের পাট খাতে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে পরিষ্কার ধারণা মেলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে। গত বছর এফএও পাট নিয়ে একটি গবেষণায় বলেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিশ্বে ২৮ লাখ ১৭ হাজার টন পাট উৎপাদিত হয়েছে। ওই বছরে ভারতে উৎপাদন ছিল ১৪ লাখ ৪০ হাজার টন, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। আর বাংলাদেশের উৎপাদন ছিল ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন। ফলে সে বছর দুই দেশের মধ্যে উৎপাদনের পার্থক্য ছিল মাত্র ৮০ হাজার টন। এ ছাড়া নেপাল, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে বাকি ১৭ হাজার টন পাট উৎপাদিত হয়েছে।

এফএও বলছে, ভারতে উৎপাদিত প্রায় পুরোটাই দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রয়োজনে পাটজাত পণ্য ব্যবহার করছে। ভারতের মিলগুলোর পাটপণ্য উৎপাদন সক্ষমতাও উৎপাদনের সমান। অন্যদিকে বাংলাদেশ উৎপাদনের পাশাপাশি ১ লাখ ৫৩ হাজার টন পাট বিশ্ববাজারে রফতানি করছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এখন পাটপণ্য উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৭০ হাজার টন।

এফএওসহ আরো কিছু গবেষণা তথ্য বলছে, বিশ্বে গত কয়েক দশক থেকে পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে পাট ও পাটসামগ্রীর বাজার অনেক প্রসারিত। এখনো বাংলাদেশের পাটের চাহিদা রয়েছে সারা বিশ্বে। ফলে পাট রফতানি করে এখনো আগের থেকে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ বলেন, এখন বিশ্বে পাটপণ্যের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। মূলত পরিবেশবান্ধব পণ্য সচেতনতার কারণে এ বড় বাজারের সৃষ্টি। যাদের অধিকাংশ দেশ ধনী। ফলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পাট খাতের বহুমুখী ব্যবহারের ক্ষেত্র তৈরি করা গেলে সোনালি এ আঁশের হারানো গৌরব ফিরে আসবে।

তিনি বলেন, আগের মতো পাটপণ্যের বাজার একমুখী নেই। বাজার বাড়াতে গবেষণা প্রয়োজন। সেভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি, কারিগরি দক্ষতা, বড় বিনিয়োগ ও বহুমাত্রিক পণ্য উৎপাদন সক্ষমতা প্রয়োজন হবে, যার কিছুটা উদ্যোগ সরকার ইতোমধ্যে নিয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরে দ্রুত বাড়ছে পাটের উৎপাদন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, দেশে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৬ লাখ ৬৭ হাজার টন পাট উৎপন্ন হয়েছে। এক যুগ আগেও ছিল তার অর্ধেক। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দেশে মাত্র ৮ লাখ ৩৮ হাজার টন পাট উৎপন্ন হয়েছিল।

এ ছাড়া পাটের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারও সক্রিয়। বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) পাটকলগুলোয় বকেয়া মজুরি এবং বেতন পরিশোধ করে সেগুলো উজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব পাটকলের আধুনিকায়নও (বিএমআরই) করা হচ্ছে। বেসরকারি খাতে বন্ধ মিলগুলোয় পুনরুৎপাদনে সহায়তা দিতে শুরু করে সরকার।
 
শুধু অবকাঠামো খাতের উন্নয়নই নয়, পাটখাতের সঙ্গে জড়িত কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, রফতানিকারকসহ ভোক্তাদের মধ্যেও উদ্দীপনার সঞ্চার করছে সরকার। ভোগ্যপণ্যে পাটজাত মোড়ক বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ প্রণয়ন করে এখন ১৭ পণ্য সংরক্ষণ, সরবরাহ ও মোড়কীকরণে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে।

বিশ্ববাজারে পাট ও পাটপণ্যের দাম বাড়ছে :  বিশ্ববাজারে এখন প্রতি টন কাঁচা পাট রফতানি করে ৬শ’ মার্কিন ডলার পাচ্ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া পাট থেকে বস্তা, চট, দড়ির মতো বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে আসছে টনপ্রতি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৪০০ ডলার। তবে বর্তমানে অপ্রচলিত পাটপণ্য হিসেবে কাপড়, শাড়ি, বিছানার চাদর, বিভিন্ন কভার ইত্যাদি পণ্য রফতানি করে প্রতি টন পাট থেকে আয় আসছে ১০ হাজার ডলার।

বহুমুখী হচ্ছে পাটপণ্যও : দেশে উৎপাদিত পাট থেকে এখন মোট ২৩২ ধরনের পণ্য তৈরি হয়। পণ্যগুলো আন্তর্জাতিক মানের। পাটপণ্য বহুমুখীকরণে জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল প্রডাক্ট ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (জেটিপিডিসি) কাজ করছে। পাট থেকে কটন কাউন্টের মিহি সুতা উদ্ভাবন ও উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।
এ ছাড়া বিজেআরআইয়ের কারিগরি শাখা উদ্ভাবিত প্রযুক্তি হস্তান্তর ও উদ্ভাবিত পণ্য সামগ্রী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন ও বাজারজাত করার লক্ষ্যে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় ৩০০টি সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে।

পাট ও পাটপণ্য রফতানি বাড়ছে : রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো জানায়, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) পাট এবং পাটজাত পণ্য রফতানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ৬৬ কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১০ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছর এ খাত থেকে মোট আয় হয়েছে ৯৬ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার ডলার। আগের অর্থবছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।

পাটচাষির মুখে হাসি : চাহিদা বাড়ায় গত কয়েক বছর থেকে পাটের ভালো দাম পাচ্ছেন চাষিরা।  মণপ্রতি পাট দেড় থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে। একই সঙ্গে পাটের আবাদও বাড়ছে। শতকরা হিসাবে আবাদ বেড়েছে ১১৩ শতাংশ।

পাটের মোড়ক ব্যবহারে বড় অভ্যন্তরীণ বাজার: পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক আইনগত বিধান করার  ফলে দেশের বাজারে পাটপণ্যের বিক্রি ও চাহিদা বহুগুণ বেড়েছে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমানে দেশে পাটের বস্তার বার্ষিক চাহিদা ১০ কোটি পিস থেকে বেড়ে ৭৫ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। সার্বিকভাবে এ সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়ন করা গেলে ওই পরিমাণ আরো বাড়বে।

উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন : পাটের বিকাশে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) এ পর্যন্ত ৪৯টি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। উদ্ভাবনের এই হার ভারতের থেকেও বেশি। গত বছর পাটের নতুন চারটি জাত উদ্ভাবন করেছিল বিজেআরআই। সম্প্রতি আরো নতুন তিন জাতের পাট আসছে প্রতিষ্ঠানটি থেকে।

সরকারি মিল আধুনিকায়ন হচ্ছে : বিজেএমসির আওতাধীন পাটকলগুলোর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৩টি পাটকলের আধুনিকায়নে চীনের সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। এভাবে বিজেএমসির আওতাধীন মোট ২৬টি পাটকলের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ২৪টি পাটকলের আধুনিকায়ন করা হবে। এসব পাটকল আধুনিকায়ন করা হলে উৎপাদনক্ষমতা বর্তমানের চেয়ে ৩২ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে।

ফিরিয়ে আনা হচ্ছে শর্ত লঙ্ঘনকারী পাটকল : সরকারের নির্দেশে গত বছর থেকে অনিয়ম ও চুক্তি লঙ্ঘনকারী পাটকল আবার রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এ পর্যন্ত আটটি কারখানা পুনঃগ্রহণ করেছে সরকার। শর্ত লঙ্ঘনকারী বেসরকারি খাতের অভিযুক্ত আরো প্রায় ৬৪টি মিলকে পুনঃগ্রহণ করা হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!