• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’


নিজস্ব প্রতিবেদক মার্চ ১৮, ২০১৭, ০১:৪২ পিএম
‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’

ঢাকা : ১৮ মার্চ, ১৯৭১। চারিদিকে বীর বাঙালীর গগনবিদারী রণধ্বনি। শুধু চূড়ান্ত ডাকের অপেক্ষায়। ডাক পেলেই হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে যেন ফুঁসছে মুক্তিপাগল জনতা। একাত্তরের এদিন পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে বীর বাঙালী। হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম গর্জে ওঠে বাঙালীর অস্ত্র।

এদিন পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে ৯০ মিনিটের বৈঠক শেষ করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু বৈঠক যে নিষ্ফল তা বঙ্গবন্ধুর অবয়বে ধরা পড়ে। বাইরে তখন আগ্রহাকুল জনতার ভিড়। উৎসুক চোখে তারা তাকিয়ে আছে প্রিয় নেতার মুখের দিকে। বৈঠককে ঘিরে ভিড়ের মধ্যে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরাও রয়েছেন। আশা, বৈঠকের অগ্রগতি সম্পর্কে যদি কিছু জানা যায়।

পুরো বিশ্বের সংবাদমাধ্যম তখন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছোট্ট এ ভূখণ্ডের চলমান ঘটনাবলীর দিকে। তৃতীয় দিনের মতো পাক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে আসামাত্রই চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেন সাংবাদিকরা।

কালো পতাকাশোভিত সাদা গাড়ি থেকে নেমে এলেন বঙ্গবন্ধু। হাতে পাইপ। উপস্থিত জনতা ও সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দাবি না মেটা পর্যন্ত আমরা জাতীয় পরিষদে বসতে পারি না।’ সাধারণ মানুষের ওপর সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘টঙ্গি-জয়দেবপুরসহ বহুস্থানে সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করে চলছে। তাহলে এই আলোচনার অর্থ কী? শহীদদের রক্তের সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।’ তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন, ‘আমরা আবার কথা বলব পাক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। তবে কোনো আপোস নয়।’

অগ্নিঝরা একাত্তরের এই দিনে জয়দেবপুরে গুলিবর্ষণের পর কারফিউ জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘তারা (পাকিস্তানী শাসক) যদি মনে করে থাকে যে, বুলেট দিয়ে জনগণের সংগ্রাম বন্ধ করতে সক্ষম হবে, তাহলে তারা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছে।’ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এ দিনেই প্রথম পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে জয়দেবপুরের মানুষ। গর্জে ওঠে প্রথম বাঙালীর অস্ত্র। সে সময় জয়দেবপুরের ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজবাড়ীতে অবস্থান ছিল দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের। এ রেজিমেন্টে ২৫-৩০ জন জওয়ান ও অফিসার ছাড়া সবাই ছিলেন বাঙালী।

এদের সবাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। এ রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল মাসুদ হাসান খান এবং সহ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর কে এম শফিউল্লাহ।

বাঙালী অফিসারদের মনের কথা বুঝতে পেরে পাক হানাদাররা গভীর চক্রান্ত শুরু করে। ঢাকার ব্রিগেড সদর দফতর থেকে নির্দেশ আসে ১৫ মার্চের মধ্যে ৩০৩ ক্যালিবারের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সদর দফতরে জমা দিতে। কিন্তু সেনানিবাসে বাঙালী কর্মকর্তারা অস্ত্র জমা দিতে রাজি নন। কারণ ইতোমধ্যে তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।

এ জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে তারা সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে চলছেন।

সদর দফতরে অস্ত্র জমা না দেয়ার কৌশল হিসাবে অস্ত্র নিয়ে গাজীপুর থেকে ঢাকায় নিরাপদ নয় বলে জানিয়ে দেন রেজিমেন্টের অধিনায়ক। কিন্তু সে অজুহাতে সন্তুষ্ট হলো না পাক সামরিক জান্তা। এবার নির্দেশ এল, ব্রিগেড কমান্ডার পাঞ্জাবী ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব নিজেই ১৯ মার্চ এক কোম্পানি সৈন্যসহ জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে আসবেন। বাঙালী অফিসার ও জওয়ানদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিতেই যে এই কৌশল তা বুঝতে বাকি রইল না কারও। বিষয়টি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের জানিয়ে দেয়া হয়।

যথারীতি ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে জয়দেবপুরে হাজির হন। বাঙালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে ঢাকা থেকে পাঞ্জাবী সৈন্য এসেছে- এ খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার জনতা হাতে যা আছে তাই নিয়ে জড়ো হতে থাকে জয়দেবপুর বাজারে। সমরাস্ত্র কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরাও এসে যোগ দেয়। সবার হাতে লাঠি, তীর, বল্লমসহ নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র। রাস্তার বিভিন্নস্থানে রেলস্টেশন থেকে একটি মালগাড়ির ওয়াগন ঠেলে এনে রেলক্রসিংয়ের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। সর্বত্র টানটান উত্তেজনা, যে কোন মূল্যে পাক সামরিক জান্তার এই ষড়যন্ত্র রুখতে প্রস্তুত উত্তেজিত হাজারো জনতা।

পরিস্থিতি বুঝতে পেরে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে পাক সৈন্যরা। গুলির শব্দ শুনে উত্তেজিত জনতা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইট-পাথর নিক্ষেপ শুরু করে। শুরু হয় সংঘর্ষ। জয়দেবপুরের প্রতিরোধ সামাল দিয়ে পাক হানাদার বাহিনী কোনমতে ঢাকার পথে রওয়ানা হয়। কিন্তু সংঘর্ষের খবরে ৩ কিলোমিটার অদূরে চান্দনা চৌরাস্তায় স্থানীয় জনগণ জড়ো হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেনাসদস্যরা এবার জনতার ওপর গুলি চালিয়ে হত্যা করে অনেক মানুষ। এরপর কারফিউ জারি করে অনেক কষ্টে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানী সেনাসদস্যরা ঢাকায় ফেরে।

বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে ফলাও করে জয়দেবপুরের বীর বাঙালীর সশস্ত্র প্রতিরোধের খবর প্রচারিত হয়। সশস্ত্র প্রতিরোধের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্নস্থানেও বীর জনতা দেশীয় অস্ত্রেসস্ত্রে সজ্জিত হয়েই রাজপথে মিছিল- সমাবেশ করে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!