• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেপরোয়া ছাত্রলীগ-যুবলীগকে ঠেকাবে কে?


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ৭, ২০১৭, ০১:১৩ পিএম
বেপরোয়া ছাত্রলীগ-যুবলীগকে ঠেকাবে কে?

বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগের। নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কিছুতেই। বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে একের পর এক নানা অঘটনের জন্ম দিয়েই যাচ্ছে সংগঠনগুলো। 

এ নিয়ে আবারও বিব্রত শাসকদল আওয়ামী লীগ। নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছে সরকারের বিভিন্ন অর্জন।

একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে নিজেদের মধ্যে ঘটছে সংঘর্ষ-সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনা; তেমনি ক্ষমতার দাপটে কারণে-অকারণে হামলা করছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে ছোটখাটো ছিনতাইয়ের অভিযোগও যেমন আসছে; তেমনি পাড়া-মহল্লায় অলিগলিতে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরেও ঘটছে তুলকালাম।

রাস্তাঘাট বন্ধ করে মানুষকে যানজটে ফেলে পালন করছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। শাসকদলের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের এখন কিছুটা সমীহ করেই চলতে হয় স্থানীয় মানুষদের।

গত ৫ জানুয়ারি পুলিশসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অহেতুক ১৬ জেলায় নির্বিচারে বিএনপি নেতাকর্মীদের কর্মসূচিতে হামলা চালায়। এতে শতাধিক আহত হন। বিশেষ করে বরিশালের বিএনপি নেত্রী কামরুন্নাহার রোজির ওপর আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের লজ্জাজনক হামলার ঘটনা দেশজুড়ে সমালোচিত হয়। 

হামলার ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে এলে লজ্জায় পড়তে হয় সরকারকেও। এমনকি তার আগের দিন ঠাকুরগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পালন কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় ১০ জন আহত হন। গত বছরও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সময় দুপক্ষের সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়েছিলেন। পরে এ ঘটনায় সিরাজী, সৌরভসহ ৫ নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, গত বছর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ২১ নেতাকর্মী-সমর্থক মারা গেছেন। এর মধ্যে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষেই মারা গেছেন ৬ জন। এ সময় নিজেদের মধ্যে ১১৫টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। 

এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ৮২টি, ছাত্রলীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে ২২টি, যুবলীগ-যুবলীগের মধ্যে ৩টি, ছাত্রলীগ-যুবলীগের মধ্যে দুটি, আওয়ামী লীগ-যুবলীগের মধ্যে পাঁচটি ও আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে একটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

সংশোধিত না হলে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে অপকর্ম সংগঠনকারী নেতাকর্মীদের সতর্কও করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গত শুক্রবার (৬ জানুয়ারি) রাজধানীর ধানমণ্ডিতে দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগের যৌথসভা শেষে সাংবাদিকদের সামনে এ হুশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, যারা অপকর্ম করে তাদের সংশোধন হতে হবে। যারা সংশোধন হবে না তাদের দল থেকে বের করে দিতে হবে। প্রথমে সংশোধন করব; যারা সংশোধন হবে না তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ছাত্রলীগ-যুবলীগকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফেরদৌস হোসেন বলেন, যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়, তাই তাদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। বিতর্কিতদের দিয়ে সংগঠনের কমিটি করা যাবে না। নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে কমিটি করতে হবে। 

ত্যাগী কর্মীরা যেন কোণঠাসা না হয়। যেন পকেট কমিটি কোথাও না হয়, সেটা লক্ষ রাখতে হবে। বিশেষ করে এসব সংগঠনকে কিছুতেই মূল দলের লেজুড়বৃত্তি করা যাবে না। স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। কোনো অন্যায় হলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছেÑ ছাত্রলীগ-যুবলীগকে সামলাবে কে? এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দলের ভেতরও। যুবলীগের সাবেক নেতারা বলছেন, গুটিকয় নেতার ইশারায় চলছে সংগঠনটি। দীর্ঘদিন ধরে কাঙ্খিত কমিটি আসছে না। 

ফলে সংগঠনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ। তিনি বলেন, আমরা যুবক হলেই যুবলীগ নেতাকর্মী ধরে নেই। অভিযোগ তুলি যুবলীগের বিরুদ্ধে। যুবলীগের কোন নেতাকর্মী কোন অপরাধ করলে সাংগঠনিকভাবে শাস্তি দেওয়া হয়।

সংগঠনের সূত্রগুলো বলছে, এত দিন ধরে ‘বিশৃঙ্খল’ ছাত্রলীগকে দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল সংগঠনের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদেরের ওপর। আওয়ামী লীগের এবারের কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের ভালো-মন্দ দেখাশোনার ভার কারো ওপর ন্যস্ত হয়নি। আর এ ‘সুযোগে’ ছাত্রলীগের ‘বেপরোয়া’ নেতাকর্মীরা একের পর এক ‘অঘটন’ ঘটিয়ে যাচ্ছেনÑ এমন অভিযোগও রয়েছে।

ছাত্রলীগের সাবেক নেতারাও বলছেন, সংগঠনটি অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন। বৃহৎ সংগঠন হওয়ায় কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাবের কারণেও স্থানীয় পর্যায়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নানা ‘অপকর্মে’ জড়ানোর ঘটনা ঘটছে। 

তবে সংগঠনের বিরুদ্ধে এসব কর্মকা-ের অভিযোগ অস্বীকার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন বলেন, এসব কর্মকা- বন্ধ করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। তারা পারেনি, এটা তাদের ব্যর্থতা। তারা যদি আমাদের কাছে কোনো সহযোগিতা চায়, তাহলে আমরা সেটা দিতে প্রস্তুত আছি। তবে ‘সাংগঠনিকভাবে’ এসব কর্মকা- বন্ধের ‘আপ্রাণ’ চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানান জাকির।

অবশ্য ছাত্রলীগের এসব ‘অপকর্ম’ নিয়ন্ত্রণ করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ বাধা বলে দাবি করেন সংগঠনটির সাবেক কেন্দ্রীয় এক সভাপতি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এত বড় সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কিছু নয়। জেলা-উপজেলা কমিটিগুলো চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। 

কারণ এসব জেলা-উপজেলার কমিটিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। কমিটিগুলো দেওয়ার সময় স্থানীয় নেতাদের অনেক আবদার থাকে। তাই চাইলে এসব কমিটি কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, গত ২৪ মাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রায় ২৩৫টি অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে শতাধিক। এসব ঘটনায় ছাত্রলীগের ৪ শতাধিক নেতাকর্মী বহিষ্কার এবং সংগঠনের ১২টি কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। 

এসব সংঘর্ষের অধিকাংশ ঘটনাই ঘটে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংগঠিত সংঘর্ষের সংখ্যা ১৮৭টি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে ৪৮টি। এসব সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ১৬ জন এবং আহতের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এসব ঘটনায় ৫শর বেশি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মেয়াদে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ছাত্রলীগের পাশাপাশি যুবলীগও নানা অপকর্ম ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!