• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বৈদেশিক বাণিজ্যে ভাবমূর্তি সঙ্কটে ব্যাংকিং খাত


অর্থনৈতিক রিপোর্ট মার্চ ৩১, ২০১৮, ০১:৫২ পিএম
বৈদেশিক বাণিজ্যে ভাবমূর্তি সঙ্কটে ব্যাংকিং খাত

ঢাকা : ব্যাংকিং খাতে মালিকানা পরিবর্তন ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষে রদবদলে অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের পাশাপাশি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যেও বড় সঙ্কট দেখা দিতে শুরু করেছে। বিদেশি অনেক ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যবসা করতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। ব্যবসায়ী ও শিল্পগোষ্ঠীর খোলা ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট-এলসি) বাতিল করে দিচ্ছে অনেক বিদেশি ব্যাংক।

এলসির অর্থ পরিশোধে অন্য কোনো ব্যাংক প্রতিশ্রুতি দিলেও তা গ্রহণ করছে না অনেক আন্তর্জাতিক ব্যাংক। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। তারা এটিকে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত কি না তা খতিয়ে দেখার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।

সম্প্রতি এ ধরনের বেশকিছু অভিযোগ অনানুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ এ ধরনের ঘটনার শিকার। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (অর্থ) উজমা চৌধুরী এ ব্যাপারে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে অবহিত করেছেন। দেশের আরেক বড় শিল্প পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপেরও দুটি এলসি বাতিল হয়। এই দুই শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপের হয়ে এলসি খোলে ২০১৭ সালে আকস্মিক মালিকানা পরিবর্তন হওয়া ইসলামী ব্যাংক।

ইসলামী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ডেস্কের দুজন কর্মকর্তা তাদের ব্যাংকের বেশ কিছু এলসি বাতিলের কথা স্বীকার করেছেন। তারা বলেন, দেশের বেশকিছু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের এলসি বাতিল হয়েছে। যাদের অনেকেই আমাদের পুরনো গ্রাহক ও ভালো গ্রাহক। ফলে বেশকিছু গ্রাহককে আমরা অন্য ব্যাংকেও পাঠিয়েছি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরে ব্যাংকিং খাতে বড় রদবদল শুরু হয় বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। এরপর বেসরকারি সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের মালিকানায় পরিবর্তন আসে, যা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ, মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি, সুশাসনের অভাব চলছে দীর্ঘদিন ধরে। তার সঙ্গে মালিকানা পরিবর্তন বড় প্রভাব ফেলেছে বিদেশে। ফলে বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশি কোনো ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা করতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পুরনো সঙ্কটগুলোর সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে নগদ টাকার টানাটানির বিষয়টি আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক অনেক ব্যাংকের ধারণা, বাংলাদেশে কোনো ব্যাংকের এলসি গ্রহণ করলে অর্থ পেতে ঝামেলা হতে পারে। একই কারণে অনেক বিদেশি ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর এলসি পরিশোধে প্রতিশ্রুতি দিতেও অনাগ্রহ দেখাচ্ছে।

তবে ব্যাংকগুলোর নানামুখী সঙ্কটের মধ্যে বিপুল পরিমাণে আমদানি বেড়ে গেছে। এটিও পর্যবেক্ষণ করছে বিদেশি ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আমদানি ছাড়িয়ে গেছে ৪৫ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরে মোট আমদানি ব্যয় ছিল ৪৫ বিলিয়ন। কিন্তু এবার সাত মাসেই সেই অংশ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে বিদেশি অনেক ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকের এলসির সীমা ছাড়িয়ে গেছে। যার ফলে ওইসব ব্যাংক বিদেশি এলসি গ্রহণ করছে না।

ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান বলেন, আমাদের ব্যাংকের এলসি বিদেশি ব্যাংক নিচ্ছে না এটা সার্বিকভাবে বলা যাবে না। দুয়েকটি ঘটনা এমন হতে পারে। এর সঙ্গে মালিকানা পরিবর্তন কিংবা সুনামকে জড়ানো ঠিক হবে না।

ভাবমূর্তি সঙ্কটে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো ব্যবসা করতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। ফলে বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে অনুমোদন পাওয়া ৯ ব্যাংককে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করতে রীতিমতো হোঁচট খেতে হচ্ছে।

ওভার ইনভয়েজিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচার হচ্ছে এ তথ্য ব্যাপক আলোচিত দেশে ও বিদেশে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মনে করে, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের ঘাটতির কারণে এটি হচ্ছে।  এজন্য ব্যাংক খাতের তদারকি জোরদারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসেই সংস্থাটির একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে এসব জানিয়ে গেছে।

সংস্থাটি বলছে, দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক বিশেষত রাষ্ট্রীয় মালিকানার কয়েকটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ও উচ্চ খেলাপি ঋণ রয়েছে। শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যাংক নয়, পুরো ব্যাংক খাতে এখন নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা উদ্ঘাটিত হচ্ছে।

ব্যবসায়িক চুক্তি থাকার পরও গ্রাহকের এলসি গ্রহণ না করায় সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তারা এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা চান বলে বৈঠকের সূত্র জানিয়েছে। তারপরও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন আসেনি। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে এমন আটটি ব্যাংক ব্যবসায়িক চুক্তি বাতিল করতে চিঠি দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন, ব্যবসায়িক গ্রুপের এলসি বাতিলের ঘটনার তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। আমরা ব্যাংকগুলোর তথ্য নিয়ে কয়েকটি বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে এ ব্যাপারে বৈঠকও করেছি।  

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, এমনিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে সঙ্কট চলছে। ব্যাংকগুলোর কাছে টাকা নেই। ফলে তারা অর্থায়ন করতে পারছে না। অনেক ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করে বিপদে আছেন। তার সঙ্গে ঋণের সুদহার দুই অঙ্কে দাঁড়িয়েছে। এলসি বাতিল হচ্ছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কী দাঁড়াচ্ছে, বুঝতে পারছি না। তিনি বলেন, আমি গভর্নর, অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের বলব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ২০১৭ সাল ছিল দেশের ব্যাংকিং খাতের কেলেঙ্কারির বছর। ২০১৮ সালে অভ্যন্তরীণভাবে আমরা তার প্রভাব দেখতে পারছি। এর প্রভাব আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পড়তেই পারে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ দরকার। তা না হলে সামনে আরো সঙ্কট আসবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!