• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বৈরি আবহাওয়া পাত্তা দেয়নি সরকার


শেখ আবু তালেব, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জুলাই ২৬, ২০১৭, ০৩:৩৭ পিএম
বৈরি আবহাওয়া পাত্তা দেয়নি সরকার

ঢাকা: মাঠে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে সোনালী ধানের ছড়া। আশায় বুক বাঁধছিল কৃষক। কিন্তু গত এপ্রিল মাসে হঠাৎ করেই অতি বৃষ্টি ও কাল বৈশাখিতে নষ্ট হয়ে গেছে সেই সোনালী স্বপ্নের ছড়া। উজান থেকে আসা পানির ঢলে শুধু জনপদই ডুবেনি, ডুবেছে কৃষকের সেই সোনালী আভার স্বপ্ন। হঠাৎ বন্যায় সিলেটের হাওরে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৯ লাখ টন চালের। শুধু নেত্রকোনায় নষ্ট হয়েছে ১৪৪ কোটি টাকার ধান। সারা দেশের অতি বৃষ্টিতে ধানের যে ক্ষতি হয়েছে, তার পরিসংখ্যান কৃষি বিভাগে থাকলেও টনক নড়েনি সারকারের। মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাও সরকারকে এই সংকটের প্রভাব বিষয়ে সতর্কতা জানায়নি। ফলে চাল সংকটে পড়েছে দেশ।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিসাবে ২০১৬ সালে বিশ্বে মোট চাল উৎপাদন হয়েছে ৪৮ কোটি ৩১ লাখ টন। চলতি বছরে তা নেমে ৪৮ কোটি ১০ লাখ টন হতে পারে। কারণ হিসেবে বিভাগটি বলেছে, এবছর আবহাওয়া বিরূপ আচরণ করবে। খারাপ বা বৈরি আবহাওয়ার কারণে বিশ^ব্যাপী ধান তথা চালের উৎপাদন কম হবে। শতাংশ হিসেবে যা ০.৪৩ শতাংশ কম হবে গত বছরের তুলনায়।

দেশটির গবেষণা বিভাগ এ বিষয়ে আগেই পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে। অথচ বিশ্বে কম উৎপাদন হওয়ার সময়েও বাংলাদেশে চাল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে। উদ্ধৃত দেখাতে সরকার গত বছর ৫০ হাজার টন সেদ্ধ চাল রপ্তানি করেছে শ্রীলঙ্কায়।

মার্কিন গবেষণা বলছে, আগামী ২০২০ সাল থেকে ২০৫০ সালে চালের চাহিদা বেড়ে যাবে। একই গবেষণা বলছে ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের মানুষের বাৎসরিক গড়ে ভাত খাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে ৬০ কেজি থেকে ১০৩ কেজিতে পৌছেঁছে। সামনের দিনে তা আরো বাড়বে।

ধান উৎপাদন নিয়ে এরকম চাঞ্চল্যকর তথ্য দিলেও বাংলাদেশের কৃষি বিভাগ বলছে ভিন্ন কথা। কৃষি বিভাগের তথ্য নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখ টন।
 
পাশাপাশি সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে সরকারিভাবে বিভিন্ন ধরন ও মানের ৩.৯৩ লাখ মেট্রক টন ও বেসরকারিভাবে ৫০.০৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি করেছে সরকার। চলতি অর্থবছরে সরকার মে মাস পর্যন্ত ১.১৫ লাখ টন চাল আমদানি করেছে। এ হিসাবে সরকারের কাছে যথেষ্ট থাকলেও তাহলে প্রশ্ন উঠে এতো ধান গেল কোথায়। চালের দাম বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সরকার দেখতে পেয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকা সরকারি খাদ্যগুদামে এক লাখ ৯১ হাজার মিট্টক টন চাল মজুদ আছে, যা গত ৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ ২০০৯-১০ অর্থবছরের সময়ে মজুদ ছিল ৫ লাখ ৪৬ হাজার মেট্টিক টন চাল। যা পরের বছর থেকে কমেই আসছে।

মার্কিন গবেষণা সংস্থার পূর্বাভাসটি অনেকাংশেই ফলে গিয়েছে বাংলাদেশের বেলায়। গত এপ্রিল মামে সারা দেশে বৃষ্টিপাতের কারণে চোখের সামনেই নষ্ট হয়েছে ক্ষেতের ফসল। অনেকেই আধাপাকা ধানের গাছ কেটে গরুকে খাইয়েছেন ঘাস হিসেবে। জলাবদ্ধতার কারণে সরকারকেও কয়েক জেলায় ত্রাণ দিতে হয়েছে।

ফলে পরের মে মাসেই চালের বাজারে টান লাগে। মিলাররা হাটে হাটে বেরিয়েও প্রয়োজনীয় ধান কিনতে পারেন নি। বিভিন্ন জেলার কৃষকদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, যারা কিছু আগে ধান লাগিয়েছিলেন, তারা শুধু নিজের গোলায় ধান নিতে পেরেছেন। বিভিন্ন কারণে যারা পরে লাগিয়েছিলেন, তারা এবার ধান ঘরে তুলতে পারেন নি। এ বিষয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় চাল সরবরাহকারী জেলা নওগাঁ রাইস মিল মালিকদের সংগঠনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, ধানের দাম বেড়েছে। প্রতি হাটে লোক পাঠাচ্ছি বেশি দাম দিলেও ধানের যোগান কম। ৮০০ টাকা মনের ধান এখন ১১৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। কৃষকদের বরাত দিয়ে তিনি বলেছেন, এবারের বৃষ্টিতে অনেক ফসল ক্ষেতেই নষ্ট হয়েছ। তাই ধানের উৎপাদন কম হয়েছে।

কাল বৈশাখি ও থেমে থেমে ঝড় ও বৃষ্টিতে ফসল ও বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে মাঠের বোরো ধান ছাড়াও অন্যান্য ফসল তলিয়ে গিয়ে কৃষকদের মাথায় হাত উঠেছে। অতিবৃষ্টিতে শুধু বিভিন্ন জেলার ধানই নষ্ট হয়নি। বোরো ধানের পাশাপাশি তিল, তরমুজ ও সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নষ্ট হয়েছে মুগডাল, মরিচ, ফুট ক্ষেত সহ বিভিন্ন ফসল। পানিতে নেমে ধান তুলতে যে টাকা খরচ হবে, তা উঠবে না। অথচ চোখের সামনেই নষ্ট হতে দেখেছে কষ্টে বোনা ধান। শুধু নেত্রকোনার হাওরে ১৪৪ কোটি টাকার ধান নষ্ট হয়েছে বলে জেলা অফিস জানিয়েছে। সিলেটের হাওরে হঠাৎ বন্যায়, যা গত ৩০ বছরে হয়নি, নষ্ট হয়েছে প্রায় ৯ লাখ টন চাল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কারখানায় চাল উৎপাদন হয় না। এসব বৈরি আবহাওয়ার দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব কী হতে পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছিল না মন্ত্রণালয়ের। কৃষি নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্ঠ মন্ত্রণালয়গুলো ছিলো এ বিষয়ে উদাসীন। সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে এরকম পরিস্থিতি হতো না। বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন আবহাওয়া অধিদপ্তর যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তা কতোটুকু প্রয়োজ্য হতে পারে, সে বিষয়ে বাংলাদেশকে এখনই ভাবতে হবে।

সোনালীনিউজ/তালেব

Wordbridge School
Link copied!