• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখ: সম্রাট আকবর থেকে রমনার বটমূল


শেখ আবু তালেব, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এপ্রিল ১৪, ২০১৭, ০৩:৩৪ এএম
বৈশাখ: সম্রাট আকবর থেকে রমনার বটমূল

ঢাকা: বাংলা সনের প্রবতর্ক সম্রাট আকবর। তিনিই প্রথম বঙ্গের কৃষকদের জীবন ও কৃষির সঙ্গে মিল করে প্রবর্তন করেন বাংলা সনের। বছরের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম দিনকে ঘিরে গ্রামীণ বাঙলায় প্রচলিত অলিখিত এক সামাজিক প্রথা। 

গৃহবধূরা এদিন ঘর-দুয়ার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখেন। আর সম্রাট, নবাব ও জমিদাররা দিনটিকে খাজনা আদায়ের জন্য নির্ধারণ করেন। সেই জমিদার ও জমিদারি প্রথা এখন নেই। কিন্তু সেই খাজনা আদায়ের পথ ধরে ব্যবসায়ীরা তাদের বকেয়া আদায়ে হালখাতা উদযাপন ও বর্ষবরণকে এখনো চিরায়ত করে রেখেছেন।

যেভাবে শুরু বাংলা সন: সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রথম নাম রেখেছিলেন ফসলী সন। পরে তা বঙ্গাব্দ থেকে বাংলা। ঠিক কী কারণে সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রচলন করেন তার কোনো সুর্নিদিষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবে ঐহিতাসিক ও সমসাময়িক পণ্ডিতরা রাজ দরবারের বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। 

তাদের মতে, ইসলামী শাসনের পূর্বে এ অঞ্চল ছিল সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীদের আবাসস্থল। বৌদ্ধ ধর্মেরও বিরাট অনুসারী দল ছিল এ বাঙলায়। সনাতন ধর্মের অনুসারীদের সব কাজ ঠিক করা হতো পঞ্জিকা দেখে। চন্দ্রের হিসাবে তা ঠিক করতেন পুরোহিতরা। যেটাকে এখনো লগ্ন হিসেবেই জানে সবাই। এখনো শুভ কাজের পূর্বে পঞ্জিকা দেখে সময় ঠিক করে অনেকে। 

ফসল নির্ভর সন

অপরদিকে ব্রিটিশদের তৈরি ইংরেজি বর্ষ ও মাস গণনার পদ্ধতিও ছিল। মুসলিম ধর্মের অনুসারীদের ছিল আরবিতে হিজরি সাল গণনা। এই তিন গণনা পদ্ধতি ছিল ধর্মের নিয়মে। এর বাইরে সবাই যেন একই বছর গণনা করে সেজন্য একটি পৃথক সনের প্রবর্তন করার ইচ্ছে করেন সম্রাট বাবর।

অপরদিকে ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য হতে হতো।

ঠিক মতো বকেয় খাজনা আদায় ও সকলকে একই বছর হিসাব করার জন্যও দরকার একটি সন গণনা। সম্রাট আকবর ছিলেন উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি। তিনি এজন্য বাংলায় একটি তারিখ গণনা সাল বের করলেন, যেখানে কোনো ধর্মের প্রভাব থাকবে না। সব ধর্মের মানুষ একে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করবে। এই প্রয়োজন থেকেই মূলত মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। 

সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। 

বাংলা দিনের হিসাব কখন থেকে: হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায়। সূর্য ডোবর সঙ্গে আকাশে নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হওয়ার পর। অপরদিকে খ্রিস্টীয় সনে নতুন দিন শুরু হয় গ্রীনিচ মান ইউটিসি ০০:০০ অনুযায়ী। 

পহেলা বৈশাখ রাত ১২টা থেকে শুরু না সূর্যোদয় থেকে শুরু- এ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। তবে প্রথা ও ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি অনুসরণ করে আসা হচ্ছে। কৃষকরা ভোরের আলো ফোটার পরেই কাজে বেরিয়ে পড়ে। এই হিসাবে সূর্যোদয়ের পরে বাংলায় দিনের গণনা হিসাব করা প্রচলিত পদ্ধতি। গ্রামীণ বাংলায় এখানো এভাবেই হিসাব করা হয়। 

কিন্তু গত ১৪০২ সালের পহেলা বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি এই নিয়ম বাতিল করে ইংরেজি সালের গণনা হিসাবে আন্তর্জাতিক পদ্ধতির মিল রেখে রাত ১২.০০টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে।

পঞ্জিকা

সার্বজনীন লোকজ উৎসব নববর্ষ: সেই থেকে নববর্ষ বাঙালিদের সার্বজনীন লোকউৎসব হিসেবে স্বীকৃত। যা বাংলায় বসবাসকারী সকল ধর্মের মানুষকে এক করেছে। দিনটি পশ্চিম বাংলা ও ভারতের ত্রিপুরায়ও পালিত হয়ে আসছে। গ্রাম বাংলায় বৈশাখকে ঘিরে চলে গ্রামীণবধূর নানা ব্যস্ততা। পুরো ঘর-দুয়ার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, ঘরের চারপাশ ও উঠোন ভালোকরে ঝাড়ু দেয়া; মাটির পিড়া (কাঠ বা টিনের তৈরি ঘরের ভিত বা বেইজমেন্ট) নতুন করে কাদামাটির প্রলেপ দেয়া। 

আবহাওয়া শুষ্ক থাকা ও ঘরে ফসল থাকায় এ সময়ে আয়োজন করা হয় গ্রামীণ মেলার। মেলায় জিলেপি, বাতাসা, নাড়ুসহ নানা ধরণের মুখরোচক খাবারের দোকান বসানো হয়। হাজারো পণ্যর সমাহার বসে। নাগরদোলা ও বায়োস্কোপ, লাঠিখেলা, উত্তরের জেলাগুলোতে নানা-নাতির গম্ভীরা গান, পালাগান, গাজী কালু–চম্পাবতী এবং ঐতিহ্যবাহী রায়বেশে নাচ, গীতিনৃত্যনাট্য, গাজী কালু-চম্পাবতীর পুঁথি পাঠের আসর। ছোটদের জন্য থাকে পুতুলনাচ। 

মেলায় এখন এসেছে বৈচিত্র। এখনতো খাট, পালংক, সোফাসেট, আলমারি থেকে শুরু করে সকল আসবাব উঠে এ মেলায়। এসবের মধ্যে প্রধান আকর্ষণ ছিল সার্কাস। যা এখন আর নেই। সার্কাস শিল্পীদের উত্তরসূরীরা এখন অন্য পেশায়। 

হাল-আমলের নববর্ষ: শহুরে জীবনে পহেলা বৈশাখের তেমন প্রভাব আগে ছিল না। ইট-পাথরের জীবনে ক্লান্তি ঘোচাতে সেই গ্রামীণ আবহ তৈরি করে এখন শহরের অধিবাসীরা। শিকড়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বৈশাখের প্রথম দিনে কৃষকের ঘরের সকালের খাবার পান্থাভাতের আয়োজন করা হয়। 

মূলত সত্তরের দশকে ছায়ানটের নববর্ষের আয়োজনকে ঘিরেই আজকের শহুরে নববর্ষের আয়োজনের ভিন্নতা পায়। বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে বরণ করে নেয়া। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের পর পর ছায়ানটের শিল্পীরা রাজধানীর ঢাকার রমনা পার্কের বটমূলে সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানান। স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃতপক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয় সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ।

উনিশশো সত্তরের দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা। তখন থেকেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতীক হয়ে উঠে ছায়ানটের বর্ষবরণ।

হাল আমলে ইলেকট্রনিক মিডিয়া তথা টিভি চ্যানেলগুলো তা সরাসরি সম্প্রচার করা শুরু করে। ফলে ছায়ানটের এই আয়োজনের প্রসারতা পায়। লোক সমাগম বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে ২০০১ সালে ছায়ানটের বর্ষবরণের উৎসবে বোমা হামলা হয়। সেই ঘটনার প্রতিবাদ হয় সারাদেশে। পরের বছর আরো নতুন উদ্যমে বড় পরিসরে আয়োজন করা হয় বর্ষবরণ উৎসব, বাড়তে থাকে প্রচার। লোক সমাগম হওয়ায় বহুতজাতিক কোম্পনিগুলো তাদের প্রচারে এখানে ভিড় করে। সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় সব বয়সী নারী-পুরুষ ভিড় করে এই রমনায়। সঙ্গে থাকে শিশুরা। দিনটিতে তারাই বেশি আনন্দ খুঁজে নিতে পারে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা

নববর্ষের এই উৎসবে তারুণ্যকে যোগ করতে ব্যবসায়ীরা এর বাণিজ্যিক সুবিধা নিতে শুরু করে। বৈশাখকে উঠিয়ে আনে পেশাকে। মূলত গ্রামীণ ঐতিহ্যর পটভূমিগুলো রঙের আঁচরে ফুটিয়ে তুলে তৈরি করে ফ্যাশনেবল পোশাক। সেই পোশাক পরলেই মনের মধ্যে এক শিহরণ জাগায়। শহুরে এই ফ্যাশন এখন গ্রামেও প্রভাব ফেলেছে। এখন বৈশাখ মানেই নতুন জামা। 

মঙ্গল শোভাযাত্রা: বর্ষবরণ উৎসবের আরেকটি প্রধান আকর্ষণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারু কলার মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে নববর্ষকে জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি দিয়েছে। সার্বজনীন উৎসব পালনে দিয়েছে বৈশাখি ভাতা। বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানও কর্মীদের উৎসাহিত করতে চালু করেছে বৈশাখি ভাতার। বাংলাদেশের আবেদনে জাতি সংঘের ইউনেস্কো এই অনুষ্ঠানকে ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। গত বছরর ৩০ নভেম্বর এই অনুমোদন দেয় জাতি সংঘ। সেই স্বীকৃতি পাওয়ার পরে এবারের আয়োজনটা আরো উৎসাহ ব্যঞ্জক করতে চেষ্টা করেছেন আয়োজকরা।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আতা

Wordbridge School
Link copied!