• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্যাংকের লোকেরা বৌ নিয়া যাইবো?


জেসমিন চৌধুরী এপ্রিল ১৮, ২০১৮, ১১:৫৪ এএম
ব্যাংকের লোকেরা বৌ নিয়া যাইবো?

ফেসবুক অনেক অপকারের সাথে একটি উপকার করেছে আমাদের, মানুষের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সহজেই জানবার এবং বুঝবার সুযোগ করে দিয়েছে। স্কুল-কলেজে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে যাদের, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ মুখস্ত এবং ভাব সম্প্রসারণ করে বড় হয়েছেন যারা, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মত ন্যুনতম বুদ্ধিও যাদের রয়েছে, যাদের প্রত্যেকের জন্ম কোনো নারীর গর্ভে, তাদের অনেকেই এখনো নারীকে পণ্য ছাড়া কিছু ভাবেন না।

কিছুদিন আগে এক জনপ্রিয় ফেসবুকার পোস্ট দিলেন, ‘সবচেয়ে ব্যয়বহুল গৃহপালিত পশুর নাম কি বলতে পারেন?’

কমেন্ট থ্রেডে একের পর এক কী উত্তর আসতে থাকল বুঝতেই পারছেন। লোকটা আমি যতটুকু ভেবেছিলাম, তার চেয়েও মনে হলো অনেক বেশি পপুলার। অসংখ্য মন্তব্য তার পোস্টে, মন্তব্যকারী অনেকেই আবার নারী অথবা নারী নামের কলঙ্ক। যে দু’চারজন প্রতিবাদ করলেন তাও মিনমিনিয়ে, দুর্বলভাবে, পাছে সেই ‘মহাপুরুষ’ চটে যান। তার প্রোফাইলে গিয়ে দেখলাম বায়োতে লেখা ‘বুদ্ধি প্রতিবন্ধী’।

এই লোক আমার বন্ধুতালিকায়? নিজের উপরই রাগ হলো। তালিকা থেকে তাকে মুছে দেয়ার আগে একটা মন্তব্য করবার লোভ সামলাতে পারলাম না, ‘গৃহবধূদেরকে আপনার কাছে গবাদি পশু মনে হয়? অন্তত বায়োতে লেখা নিজের পরিচয়টাকে সার্থক প্রমাণ করেছেন, এটুকু কৃতিত্ব আপনাকে দিতেই হয়। আপনার জন্য করুণা এবং আপনার জীবনের নারীদের জন্য সহমর্মিতা রেখে গেলাম।’

এটুকু লিখে মন ভরলো না, তাই আবার লিখলাম, ‘সম্পূর্ণ বিনা বেতনে একজন গৃহবধূ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যত কাজ করে তার অর্থনৈতিক মূল্য জানা না থাকলে কোনো অর্থনীতিবিদের সাথে যোগাযোগ করুন।’

একজন অপেক্ষাকৃত কম ‘বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী’ দেখলাম তার বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে দেয়া পোস্টে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে লিখেছেন, ‘আজ তাকে ঘরে তোলার দিন’। অনেকের কাছেই হয়তো এই কথাকে মিষ্টি মনে হবে, কিন্তু আমি এধরনের কথার পেছনে লুকিয়ে থাকা নারীর প্রতি সহস্র বছরের অবমাননা দেখি। এর বদলে ‘ঘর বাঁধার দিন’ কি লেখা যেত না? তিতা সত্য হচ্ছে নারীকে বোঝা বানিয়ে রেখেছে সমাজ, একটা ঘর সামলাতে দিনভর তার কাজের কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই বলেই যে ঘর সাজাতে সে সমস্ত জীবন ঢেলে দেয় সেই ঘরে তাকে তোলা হয়, ঘর বাঁধা হয় না নারীর জীবনে।

অন্য এক ‘সংবেদনশীল’ পুরুষের স্ট্যাটাস ‘ভাই, লোন নিয়ে বিয়ে করে লোন শোধ করতে না পারলে কি ব্যাংকের লোকেরা বৌ নিয়া যাইবো?’ উত্তরে নানান মন্তব্যে হাসিঠাট্টার বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কেউ বলছেন, ‘আমার কাছে বৌ বন্ধক রাখেন, আমি লোন দিমু’; কেউ বলছেন, ‘নিলে তো ভালোই, ঋনও শোধ হলো।

আবার বিয়ে করবেন, নতুন বৌ পাইবেন’; কেউ বলছেন, ‘লোন নিয়ে গাড়ি কিনলে যেহেতু গাড়ি নিয়ে যায়, বৌ তো নিবেই’। এই নিছক হাসিঠাট্টার মধ্যে ফুটে উঠেছে নারীকে পণ্য হিসেবে দেখার মানসিকতা। বিয়েশাদী আর গাড়ি কেনার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখে না এরা। আজীবন খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের বিনিময়ে এখনো একজন নারীকে সেবাদাসী হিসেবে কেনা হয়, এই লেনদেনকে যত ফুলেল নামই সমাজ দিক না কেন।

পারিবারিক নির্যাতনের উপর বিলেতের পটভূমিকায় লেখা আমার একটা গল্প পড়ে একজন লিখেছেন, ‘এসব দেখে মেয়েকে বিদেশি পাত্রের হাতে তুলে দেয়ার সাহস পাই না।’ আমি এই বাবার ভাবনার আন্তরিকতার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করছি না, কিন্তু কন্যার ভবিষ্যত জীবনে নির্যাতনের সম্ভাবনায় আঁতকে ওঠা একজন পিতার স্নেহেময় বিলাপেও ফুটে ওঠে নারীজীবনের করুণ পরিণতির কথা।

উল্লেখিত গল্পটি বিলেতের বাঙ্গালি সমাজের পটভূমিকায় রচিত হলেও বস্তুতপক্ষে পারিবারিক নির্যাতন কোনো বিশেষ দেশ, জাতি বা শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ নয়। যেখানেই একপক্ষে নিয়ন্ত্রণকামীতা এবং অপর পক্ষে দুর্বলতা, সেখানেই ঘটে পারিবারিক নির্যাতন। এটা একটা বৈশ্বিক সমস্যা।

এ থেকে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে মেয়েকে কারো ‘হাতেই তুলে’ না দেয়া, হোক তা দেশে অথবা বিদেশে। মেয়েকে নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে শেখাতে হবে। একটি মেয়ে কোনো উপহার সামগ্রী নয় যে তাকে কারো হাতে তুলে দেয়া হবে। সে কোনো সম্পত্তি নয় যে বিয়ের মাধ্যমে তার মালিকানা বাবা থেকে স্বামীর কাছে হাতবদল হবে।

এবার বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়ে পারিবারিক নির্যাতনের করুণ সব কাহিনী শুনেছি যেখানে মেয়েটি শিক্ষিত এবং উপার্জনক্ষম তবু তার উপর ভয়াবহ রকমের পারিবারিক নির্যাতন চলছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

সমস্যা হচ্ছে মেয়েটি শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর হলেও আত্মবিশ্বাসী নয়, নিজের জীবন নিজে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম নয়। তাকে পুরুষের হাতে তুলে দেয়া হয়, পুরুষ বিয়ে করে তাকে ঘরে তোলে, পণ্যের মত লেনদেনের সামগ্রী সে। দিনশেষে নিজের কাছে ফেরা শেখেনি সে, একজন পুরুষের কাছেই তাকে ফিরে আসতে হয়। হোক না সে একজন নির্যাতক পুরুষ তাতে কী? বাইরের জগত থেকে সে নারীকে রক্ষা করবে, ঘরে না হয় সে ভক্ষক হলোই বা?

সবমিলিয়ে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। মনে রাখা প্রয়োজন হাজার বছরের অপসংস্কৃতির ভার বয়ে বেড়াচ্ছে যে গৃহবধূ নারী, ঘরে বসে একশত রকম ফ্রি সার্ভিস দেয়ার জন্য আশৈশব প্রস্তুত করা হয় যে গৃহবধূ নারীকে, সবকিছুর পর সে গৃহপালিত পশু নয়, পণ্য নয় বরং সে একজন মহামানবী । সে পথে বসে থাকা ফকিরও নয় যে তাকে ঘরে তোলা হবে। সে গৃহবধূ হলেও উপেক্ষার পাত্রী নয়। সে ঘর বানায়, ঘর সাজায়, কাজ শেষে ফেরার জন্য একটা ঘরকে প্রস্তুত করে রাখে। সে দশভূজা, সে পূজনীয়।

জেসমিন চৌধুরী : অভিবাসী শিক্ষক, লেখক ও অনুবাদক; ম্যানচেস্টার, ইউকে।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!