• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অাগ্রাসী পদ্মায় ভাসছে মানুষ!


শরীয়তপুর প্রতিনিধি আগস্ট ২৩, ২০১৭, ০৭:৩১ পিএম
অাগ্রাসী পদ্মায় ভাসছে মানুষ!

শরীয়তপুর: গত কয়েক দিনের পদ্মার ভাঙন আর বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে শরীয়তপুরের হাজার হাজার মানুষ। পদ্মার পাড়ের আশেপাশের প্রায় ২০০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জাজিরা-নড়িয়া উপজেলার ২৬৫টি সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত করেছে কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া ওই দুই উপজেলায় ৭০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। ইতিমধ্যে নড়িয়ায় ১২টা ও জাজিরায় ৭টি বিদ্যালয়ে শ্রেণি কক্ষে পানি থাকায় বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।

জেলার  নড়িয়া, জাজিরা, ভেদরগঞ্জ ও শরীয়তপুর পৌরসভা সদর উপজেলার বেশ কিছু এলাকা বন্যায় প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি ভাঙন কবলিত হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষকে। ঘরে মাচা পেতে থাকতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে। এছাড়া দৈনন্দিন কাজকর্ম সারতে চলাচলের জন্য নৌকা অথবা ভেলা ব্যবহার করতে হচ্ছে।

এছাড়া এসব বন্যা দুর্গত মানুষের দাবি, তাদের কোনো সাহায্য দেয়া হয়নি। প্রশাসনের পক্ষ ভাঙন কবলিতদের ত্রাণ সহায়তা দিলেও বন্যা দুর্গতদের কোনো সহায়তা দেয়া হয়নি।

এদিকে নড়িয়া উপজেলার ১২টি ও জাজিরা উপজেলায় ৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণি কক্ষে হাটু পানি থাকায় স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ৭০টি বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করায় পাঠদানে ব্যাহত হচ্ছে। ইতিমধ্যে জেলার দুইশত ৬৫টি সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করেছেন কর্তৃপক্ষ ।

বন্যা কবলিত স্কুল শিক্ষার্থী তানভীর, রেজাউল, সোনিয়াসহ অন্যরা জানায়, প্রতি বছরই বন্যার সময় পাঠদান ও পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এছাড়া বসতবাড়িতে পানি ওঠায় বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিতে হয়। এতে তাদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটে। এসব সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেবেন এমনটাই আশা করেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।


জাজিরা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান শেখ জানান, কলমিরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সরলখার কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সায়েদ আলী মাদবরকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড়কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রেজি. আমিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুন্ডেরচর হাসেম আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাইজ্জারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালু বেপারীকান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বন্দুকমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পাইনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ৪০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করায় পাঠদান ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। আর উপজেলার ১১৬টির সবকটির দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।

নড়িয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, এ উপজেলায় ১৪৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সবকটির দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানসহ দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা সাময়িক বন্ধ আছে।

তিনি আরো জানান, যেসব বিদ্যালয়ে বন্যার কারণে পড়ালেখা বিঘ্নিত হবে, সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি চলে যাবার পর অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে তা পূরণ করা হবে।

শরীয়তপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, প্রতিদিনই পানি বাড়ছে। এ পর্যন্ত ৭০টি স্কুলে বন্যার পানি উঠেছে। এই স্কুলগুলোতে পাঠদান ও পরীক্ষা কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ করা হয়েছে। আর জাজিরা-নড়িয়ার ২৫৯টি স্কুলের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

তিনি আরো জানান, দুর্গত এলকার বন্যার পানি নেমে গেলে শিক্ষকরা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অতিরিক্ত ক্লাস নেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতিটা পুষিয়ে দেবেন। আর শিক্ষার্থীরা যে পরীক্ষাগুলো দিতে পারল না সে পরীক্ষাগুলো নেয়া হবে। এসব বিষয় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও একাডেমি সুপারভাইজাররা মনিটরিং করবেন।

গো খাদ্যারসহ সেনেটিসনের ব্যবস্থা না থাকায় মানবেতর জীবন কাটছে দুর্গত মানুষের। ভাঙন ও বন্যা প্লাবিত হয়ে পড়ায় ভাসছে মানুষ ভাঙছে নদী। নতুন নতুন এলাকায় পানি উঠে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পরেছে জাজিরা, নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার বেশ কিছু গ্রামের মানুষ।

পানিবন্দি আনোয়ার, আজিজ মাদবর, ফাতেমা বেগম, জান্নাতুন জানিয়েছেন, পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন। বাড়িতে পানি ওঠায় রান্না করতে পারছেন না। গবাদী পশু নিয়ে তারা বিপাকে পড়েছেন।

তাছাড়া চারপাশে পানি হওয়াতে হাতে নেই কোনো কাজও, আবাদী জমিগুলো তলিয়ে রয়েছে পানিতে। তাদের এমন চরম দুঃসময়ে এখনো পর্যন্ত চেয়ারম্যান মেম্বারসহ কেউ কোনো সাহায্য সহযোগিতা করনি।

দুর্গত নড়িয়া উপজেলার ওয়াপদা বাজারের ব্যবসায়ী হজরত আলী ফকিরের গ্যারেজের ব্যবসা ছিল। গ্যারেজটি চালানোর জন্য ফসলি জমি বন্ধক রেখে ১ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। বন্যার পানিতে গ্যারেজটি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। একই সঙ্গে বিলীন হয় পাঁচ শতাংশ জায়গার ওপর থাকা বসতবাড়ি ও পাঁচ বিঘা ফসলি জমি। সর্বশান্ত হজরত আলী কীভাবে ঋণের টাকা ফেরত দেবেন, সেই দুশ্চিন্তায় আছেন।

হজরত আলী ফকির বলেন, ‘সংসারে কোনো অভাব-অনটন ছিল না। জমির ফসল বিক্রি করা টাকা ও ব্যবসার টাকা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনেক সুখে ছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে রাস্তার ফকির হলাম। এখন কে আমাদের পাশে দাঁড়াবে? সরকারি-বেসরকারি কোনো সহায়তা এখনো পাইনি। ২০ কেজি চাল পাঁচশ-এক হাজার টাকা সহায়তা দিয়েও বা কি হবে?’

পূর্ব নড়িয়া গ্রামে কীর্তিনাশা ও পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ইটভাটা স্থাপন করেছিলেন ব্যবসায়ী মনছুর ছৈয়াল। পদ্মার ভাঙনে ইটভাটাটি বিলীন হয়ে যায়। মনছুর ছৈয়াল বলেন, ‘সারা জীবনের সঞ্চয় ও আত্মীয়স্বজদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ইটভাটা করেছিলাম। ব্যবসা করে সবার ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল। পদ্মা নদীতে আমার সব শেষ। এখন মানুষের ওই পাওনা টাকা কীভাবে ফেরত দেব? নতুন করে ব্যবসা শুরু করারও অবস্থা নেই।’

ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসন মাহবুবা  আক্তার বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা ও ভাঙন কবলিতদের হালনাগাদ তালিকা করা হয়েছে। যাছাই বাছাই করে ২ হাজার ৫শ’ পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। শিগগিরই ত্রাণ বিতরন শুরু করা হবে। এছাড়া দ্রুত পানি কমতে শুরু করবে। বন্যা মোকাবেলায় সব ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণের কথাও জানালে জেলা প্রশাসন।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমএইচএম

Wordbridge School
Link copied!