• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মঙ্গলগ্রহে প্রাচীন সভ্যতা!


নীলা হাসান ডিসেম্বর ১৭, ২০১৬, ০৭:৫০ পিএম
মঙ্গলগ্রহে প্রাচীন সভ্যতা!

ঢাকা: আজকের সত্য কালকে মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে। আবার বিপরীতভাবে আজকের অবিশ্বাস্য কোনো ঘটনা কালকে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। এ রকম নানা সম্ভাবনা আর সংশয় নিয়েই প্রকৃতির কৌতুহল উদ্দীপক ঘটনাগুলি আমাদের সামনে আসে।

আমাদের প্রতিবেশী লাল গ্রহ মঙ্গল নিয়েও রয়েছে কত যে জনশ্রুতি, মিথ কিংবা উপ ও অপকথা। তার ইয়ত্তা নেই। তবে এসব গল্পগুলোই যে একদিন সত্য হয়ে উঠবে না তা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না।

সম্প্রতি মঙ্গলে ‘সভ্যতার (সিভিলাইজেশন) চিহ্ন’ আবিষ্কারের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, মঙ্গলের পিঠে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিন তিনটি অতিকায় স্তম্ভ বা মিনার কিংবা টাওয়ার। এসব রয়েছে একেবারে একটি সরলরেখায় নির্দিষ্ট দূরত্বের ব্যবধানে।

মানবাকৃতির চিহ্ন

সেই ‘টাওয়ারগুলির ছবি প্রকাশ করেছেন একদল বিজ্ঞানী। যারা ‘কনস্পিরেসি থিয়োরিস্ট’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তাদের দাবি, আমাদের প্রতিবেশী লাল গ্রহে যে এখনও প্রাণের বা সভ্যতার অস্তিত্ব রয়েছে এই চিহ্নগুলিই তার বড় প্রমাণ। তারা শুধু এভাবে দাবিই তুলছেন না, সেইসব টাওয়ারের ছবির একটি ভিডিও ছড়িয়ে দিয়েছেন ইউটিউব চ্যানেলে। আর ‘কনস্পিরেসি থিয়োরিস্টদের’ মধ্যে যারা এই ভিডিওটি ছড়িয়েছেন তাদের দলের নাম দেয়া হয়েছে ‘মানডোডএস্কোনোসিডো’। 

তবে বিজ্ঞানীরা যে অবাক করা তথ্য দিচ্ছেন, তা হলো- ভিডিতে দেখানো টাওয়ারগুলির প্রত্যেকটির উচ্চতা সাড়ে চার কিলোমিটারের বেশি ( সঠিকভাবে ৪.৮ কিমি)। আর সেগুলো রয়েছে নির্দিষ্ট সরলরেখায় ও সমান দূরত্বে। ‘কনস্পিরেসি থিয়োরিস্টদের’ কথা হচ্ছে, অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তি-প্রকৌশল ছাড়া এত উঁচু টাওয়ার বানানো অসম্ভব। 

গুহা

তারা আরো দাবি করছেন, মঙ্গলে যদি উন্নত বা উন্নততর সভ্যতা না থাকত তাহলে ওই ধরনের টাওয়ার বানানো কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। যারা মঙ্গলে এখনও প্রাণ বা উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব রয়েছে বলে দাবি করেন এবং বিশ্বাস করেন ভিনগ্রহবাসীরাই পাঠায় ‘আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট’ (ইউএফও) সেই ‘কনস্পিরেসি থিয়োরিস্টদের’ দাবি এই দাবিকে কিন্তু অস্বীকার করেছে নাসা।

নাসার প্রশ্ন, কোথা থেকে পেয়েছে তারা মঙ্গলের ওইসব সুবিশাল, সুউচ্চ টাওয়ারগুলির ছবি? ‘কনস্পিরেসি থিয়োরিস্টদের’ জবাব হচ্ছে, ছবিগুলো নাসার ‘মার্স গ্লোবাল সারভেয়ার’ ও ‘মার্স ওডিসি মিশন’ মহাকাশযানগুলির পাঠানো। 

তবে টাওয়ারগুলি কীভাবে মঙ্গলে এলো সে ব্যাপারে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা দেননি। হয়তো কোনো কারণে তারা ব্যাখ্যা দিতে চাননি। আবার নাসাও সরকারিভাবে কোনো মন্তব্য করেনি ছবিগুলি নিয়ে।
 
‘কনস্পিরেসি থিয়োরিস্টরা’ গলা উঁচিয়েই বলছেন, এমন উঁচু টাওয়ার কখনও জল বা বায়ুপ্রবাহের জন্য তৈরি হতে পারে না। এসবের অস্তিত্বই মঙ্গলে উন্নততর সভ্যতার আদর্শ প্রমাণ। দীর্ঘদিন ধরেই তো তারা বলে আসছেন, এখনও উন্নততর প্রাণ ও সভ্যতা টিকে আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্যান্য প্রান্তে। তারা এও দাবি করছেন, এখনও উন্নততর সভ্যতার অস্তিত্ব টিকে রয়েছে মঙ্গলে।

নভোযান

যদিও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ হাতে না থাকায় নাসা বা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ বা, এসা) জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বরাবরই এসব দাবি অস্বীকার করে আসছেন।

এসব ব্যাপারে ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির (জেপিএল) মিডিয়া সেলের অন্যতম মুখপাত্র মালবিকা দত্তশর্মা ও নাসার গডার্ড স্পেস সেন্টারের মিডিয়া সেলের অন্যতম মুখপাত্র গাই ওয়েবস্টারের বক্তব্য স্পষ্ট। তারা বলেছেন-

১. মঙ্গলের ওই টাওয়ারগুলিকে নাসা বা এসা ‘সভ্যতার চিহ্ন’ বলে আদৌ মনেই করে না।
২. টাওয়ারগুলিকে দূর থেকে সরলরেখায় রয়েছে বলে মনে করা হলেও কাছে গিয়ে দেখলে হয়তো বোঝা যাবে, সেগুলি নির্দিষ্ট কোনো সরলরেখায় নেই।
৩. দূর থেকে দেখা হচ্ছে বলেই ওই রকম মনে হচ্ছে। কিন্তু খুব কাছ থেকে দেখলে হয়তো সেই ভুল ভেঙে যেতে পারে।
৪. আকাশে মেঘ বা বরফে ঢাকা উঁচু উঁচু পাহাড়েও অনেক সময় মানুষ বা পশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ‘প্রতিকৃতি’ লক্ষ্য করা যায়। সেটা আসলে দৃষ্টির বিভ্রান্তি। এ ক্ষেত্রেও তারই সম্ভাবনা বেশি। 
৫. এর আগেও তারা মঙ্গলে মানুষের মুখের প্রতিকৃতি (ফেস অন মার্স) দেখতে পেয়েছেন বলে হই চই করেছিলেন। কিন্তু পরে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

নাসা বলছে, আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের বাসিন্দারা যখন মহাকাশে কোনো অজানা, অচেনা, অদেখা মহাজাগতিক বস্তুর হদিস পায় তখন প্রথমেই তারা পৃথিবীতে দেখা বা পাওয়া কোনো বস্তুর চেহারা বা আকার-আকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে ভালোবাসেন বা মিলিয়ে দেখেন। তবে সেটা কিছুতেই বাস্তব হতে পারে না। এ ঘটনাটাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘প্যারেইডোলিয়া’ বলে।

টাওয়ার

পৃথিবীর মতো মঙ্গল: মঙ্গলগ্রহ সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ। পৃথিবী থেকে অনেকটা লাল দেখানোর কারণে এর অপর নাম হচ্ছে লাল গ্রহ। মঙ্গল সৌর জগতের শেষ পার্থিব গ্রহ। অর্থাৎ এরও পৃথিবীর মত ভূ-ত্বক রয়েছে। এর অতি ক্ষীণ বায়ুমণ্ডল রয়েছে, এর ভূ-ত্বকে রয়েছে চাঁদের মত অসংখ্য খাদ, আর পৃথিবীর মত আগ্নেয়গিরি, মরুভূমি এবং মেরুদেশীয় বরফ। সৌর জগতের সর্ববৃহৎ পাহাড় এই গ্রহে অবস্থিত। এর নাম অলিম্পাস মন্‌স। সর্ববৃহৎ গভীর গিরিখাতটিও এই গ্রহে যার নাম ভ্যালিস মেরিনারিস। মঙ্গলের ঘূর্ণন কাল এবং ঋতু পরিবর্তনও অনেকটা পৃথিবীর মত।

১৯৬৫ সালে মেরিনার ৪ মহাকাশযান প্রথমবারের মত মঙ্গল গ্রহ অভিযানে যায়। এই অভিযানের পর থেকে অনেকেই ধারণা করে আসছিলেন যে মঙ্গলে তরল পানির অস্তিত্ব আছে। মঙ্গল থেকে পাওয়া আলো এবং আঁধারের তরঙ্গের মধ্যে পর্যাবৃত্ত পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে এই ধারণা করা হয়। বিশেষত মঙ্গলের মেরু অঞ্চল থেকে এ ধরণের পরিবর্তন চোখে পড়ে, যা মহাসাগর বা জলাশয়ের প্রমাণ হিসেবে অনেকেই গ্রহণ করেছিল।

অভিযান: সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপানের পক্ষ থেকে মঙ্গল অভিমুখে ডজনখানেক নভোযান পাঠানো হয়েছে যার মধ্যে অরবিটার, ল্যান্ডার এবং রোভার সবই ছিল। আর অভিযানগুলোর উদ্দেশ্য ছিল মঙ্গলের ভূত্বক, জলবায়ু এবং ভূতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করা। দুঃখজনক হলেও সত্যি, মঙ্গলে পাঠানো নভোযানগুলোর মধ্যে অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির আগে ব্যর্থ হয়ে গেছে। অনেকগুলো অভিযান ঠিকমতো শুরু করার আগেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। মূলত কৌশলগত সমস্যার কারণেই এই ব্যর্থতাগুলোর উৎপত্তি। অধিকাংশের সাথে মাঝপথে যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। যোগাযোগ নষ্টের কারণ জানা যায়নি, অনেকগুলোর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা এখনও চলছে।

প্রাণের সন্ধান

সফল অভিযান: মঙ্গলের প্রথম ফ্লাই-বাই করতে সমর্থ হয় নাসার মেরিনার ৪। ১৯৬৪ সালে এই নভোযান উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। প্রথম মঙ্গলের ভূ-পৃষ্ঠে অবতরণ করে দুটি সোভিয়েত সন্ধানী যান, মার্স ২ এবং মার্স ৩। ১৯৭১ সালে উৎক্ষেপিত এই দুটি যানই সোভিয়েত মার্স প্রোব প্রোগ্রাম এর অংশ ছিল। দুঃখের বিষয় হল, অবতরণের মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মাথায় দুটি নভোযানের সাথেই পৃথিবীর মিশন কন্ট্রোলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর ১৯৭৬ সালে শুরু হয় নাসার বিখ্যাত ভাইকিং প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামে দুটি অরবিটার এবং প্রতিটি অরবিটারের সাথে একটি করে ল্যান্ডার ছিল। দুটি ল্যান্ডারই ১৯৭৬ সালে মঙ্গলের ভূমিতে অবতরণ করে। ভাইকিং ১ ৬ বছর এবং ভাইকিং ২ ৩ বছর কর্মক্ষম ছিল এবং তাদের সাথে এই সময়ে পৃথিবীর যোগাযোগও ছিল। ভাইকিং ল্যান্ডারগুলোই প্রথম মঙ্গলের রঙিন ছবি রিলে করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল। এগুলো মঙ্গলপৃষ্ঠের এতো সুন্দর মানচিত্র প্রস্তুত করেছিল যে এখনও তার কোনো কোনোটি ব্যবহৃত হয়। সোভিয়েত সন্ধানী যান ফোবোস ১ এবং ফোবোস ২ ১৯৮৮ সালে মঙ্গল এবং তার দুটি উপগ্রহ - ফোবোস ও ডিমোস পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। দুঃখজনকভাবে ফোবোস ১ এর সাথে যাত্রাপথেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফোবোস ২ মঙ্গল এবং ফোবোসের ছবি তোলার পর ফোবোসে অবতরণের উদ্দেশ্যে দুটি ল্যান্ডার নামাতে যাওয়ার ঠিক আগে অকেজো হয়ে পড়ে। অর্থাৎ এর সাথেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

১৯৯২ সালে মার্স অবজারভার অরবিটার ব্যর্থ হওয়ার পর নাসা ১৯৯৬ সালে মার্স গ্লোবাল সারভেয়ার প্রেরণ করে। শেষের অভিযানটি ব্যাপক সফলতা অর্জন করে। ২০০১ সালে এর প্রাথমিক মঙ্গল মানচিত্রায়ন কাজ সম্পন্ন হয়। ২০০৬ সালের নভেম্বরে তৃতীয় বিস্তৃত প্রোগ্রামের সময় এর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। মহাকাশে প্রায় ১০ বছর কর্মক্ষম ছিল এই সারভেয়ার। সারভেয়ার প্রেরণের মাত্র এক মাস পরই নাসা মঙ্গলের উদ্দেশ্যে মার্স পাথফাইন্ডার পাঠায় যার মধ্যে সোজার্নার নামক একটি রোবোটিক যান ছিল। সোজার্নার মঙ্গলের এরিস উপত্যকায় অবতরণ করে। এই অভিযান ছিল নাসার আরেকটি বড় ধরণের সাফল্য। এই অভিযানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। মঙ্গলের চমৎকার সব ছবি পাঠানোর জন্য জনমনে এ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ দেখা দিয়েছিল।

মহাকাশ থেকে মঙ্গল

আগামীর অভিযান: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি তথা এসা ২০৩০ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে মঙ্গলে মানুষ প্রেরণের কথা ভাবছে। এর আগে অনেকগুলো সন্ধানী যান পাঠাবে তারা, একটার আকৃতি তার আগেরটা থেকে বড় হবে। এক্সোমার্স উৎক্ষেপণ এবং মার্স রিটার্ন মিশনের মাধ্যমে এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হবে। নাসা ২০৩৭ সালের মধ্যে মঙ্গলে মানুষ প্রেরণের কাজ সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর, যাতে ২০৫৭ (১৯৫৭ সালে স্পুটনিক ১ এর মাধ্যমে মহাকাশ যুগের সূচনা ঘটেছিল) সালে মঙ্গলে মানব বসতির ২০ বছর পূর্তি উৎসব উদ্‌যাপন করা যায়।

মঙ্গলে জ্যোতির্বিজ্ঞান: অনেকগুলো অরবিটার, ল্যান্ডার এবং রোভার থাকার কারণে এখন মঙ্গলের আকাশ থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা করা সম্ভব। সেখানে মঙ্গল থেকে খুব সহজেই পৃথিবী এবং চাঁদ দেখা যায়। সূত্র: আনন্দবাজার ও উইকিপিডিয়া। 

সোনালীনিউজ/এমএন

Wordbridge School
Link copied!