• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ধারাবাহিক উপন্যাস

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০১)


সাহিত্য সংস্কৃতি ডেস্ক আগস্ট ৩, ২০১৬, ০৭:৪২ পিএম
মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০১)

ক্লান্ত, বিষন্ন শরীরটাকে টেনে টেনে হেঁটে আসে রতন মাঝি। মাঝি পাড়ার শেষ প্রান্তে ছোট্ট একচালা ডেরাঘর রতন মাঝির। সামনে এক চিলতে উঠোন। বিষন্ন শরীরটাকে টেনে টেনে উঠোনটার মাঝে এসে দাঁড়ায় রতন মাঝি। কোমরে বাঁধা গামছাটা খুলে গা ঝাড়ে। ঘাড়ের এপাশ-ওপাশ ঝাড়ে। গামছার ভাজ খুলে মুখ মোছে। তারপর গামছাটাকে গোটা দুই ঝাড়া দিয়ে কাঁধের একপাশে ফেলে রাখে। বিষন্ন চোখ তুলে তাকায় এদিক-ওদিক।

রতন মাঝির মনে হয়, যেন এই প্রথম সে দেখছে তার ছোট্ট এই আঙ্গিনাটাকে। সবকিছুই নতুন মনে হয় তার কাছে। একচালা ছনের ছাউনির নীচে ডেরাঘরটার একপাশ ঘেঁষে রান্নাঘর। নড়বড়ে চারটা খুঁটির উপর শোলার মাচার নীচে রান্নাঘরটায় মাটি খুঁড়ে এক মুখের একজোড়া চুলা, চুলার একপাশে গোটা দুই ভাঙা সরা, গোটা দুই ময়লা মাটির হাঁড়ি, অন্যপাশে কিছু শুকনা পাতা, ডালপালা। একটু জোর বাতাস এলেই এরা সবাই একসাথে ঢেউ খেলে। উঠোনের চারদিকে থেকে থেকে কলাগাছ। ঘরের অন্যপাশটায় ঝাঁকড়া মাথার একটা আমগাছ।

art

 

রতন মাঝি চারপাশ ঘুরে ঘুরে এসব দেখে আর ভাবে, কে, কখন, কেমন করে গড়ে তুলেছে এদের। এই আমগাছ, কলাগাছ, নড়বড়ে রান্নাঘর, এ সবই রতন মাঝির অথচ এসব যেন এর আগে আর কখনো দেখেনি সে। প্রতিদিন ভোরে এই ডেরাঘর থেকেই বের হয়ে যায়। আবার এই ডেরাঘরেই এসে রাত কাটায়। কিন্তু এসব থেকে যে রতন মাঝি কতদূরে আজ প্রথম সে অনুভব করে।

নলীনির মুখটা মনে করতে চায় রতন মাঝি, পারে না। যে মুখের সাথে প্রতিরাতে মিলন ঘটে রতন মাঝির, সে মুখটাও মনে করতে পারছেনা এখন সে।

আকাশের দিকে তাকায় রতন মাঝি। সূর্যটা ঠিক মাথার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। উদ্ভ্রান্তের মত চারপাশে তাপ ছড়াচ্ছে সে। রতন মাঝির মনে হয়, সূর্যটা যেন তার সব যন্ত্রণা পৃথিবীর বুকে ঢেলে দিয়ে নিজেকে হালকা করতে চাইছে। তার উগ্রে দেয়া যন্ত্রণার ভারে জ্বলছে মাটি, মানুষ, পৃথিবী সব, স-অ-ব কিছু। এর দিকে এখন চোখ তুলে তাকায় মানুষের সাধ্যি কি। কিন্তু রতন মাঝি হার মানে না সূর্যের এই উদ্ভ্রান্ত চাহনীর কাছে। শরীরের সব শক্তি দিয়ে বিপ্তি চোখে সে তাকিয়ে থাকে সূর্যের দিকে। 

এমনভাবে তাকায় যেন ঐ সূর্যের যন্ত্রণার ভারে আজ যদি তার চোখের পুত্তলি গলে গলে পরে তবুও আজ ওকে জানতেই হবে, কী এমন যন্ত্রণা ঐ সূর্যের বুকে! আজ ওকে আবিষ্কার করতেই হবে, কেন সে এমন করে উদ্ভ্রান্তের মত পৃথিবীর বুকে ঢেলে দিচ্ছে এত যন্ত্রণা! এ রহস্য আজ তাকে উদ্ঘাটন করতেই হবে! করতেই হবে! জানতেই হবে কী এমন কষ্ট ঐ সূর্যের বুকে।

art

রতন মাঝি দু’হাতে দু’দিক থেকে মাথার চুলগুলো টেনে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মাটিতে। বাচ্চাদের মত ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠে। কেঁদে কেঁদে বলে: আমি কেন পারতাছি না ঐ সূর্যের মত আমার সব যন্ত্রণারে চারদিকে ছড়াইয়া দিয়া নিজেরে হালকা করতে! কেন পারতাছিনা! কেন পারতাছিনা! ডুকরে ডুকরে কাঁদে রতন মাঝি।

নলীনি মিয়াদের বাড়ির কাজ শেষ করে বাড়ির পথ ধরে হাঁটে। শাড়ির আঁচলে দুপুরের ভাত ঢাকা। ডেরাঘরটায় ঢুকার মুখে আমগাছ তলায় পা রেখেই ভূত দেখার মত থমকে দাঁড়ায় নলীনি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। আজ পাঁচ বছর ছ’মাস সতের দিন হ'তে চলল নলীনি এই ডেরাঘরটায় উঠে এসেছে। রতন মাঝির বৌ হয়ে। ষোল বছরের নলীনি আজ একুশ বছরের যুবতী। যৌবন তার উছলে উছলে পড়ে। তারপরও আজ পর্যন্ত এই অবেলায়, অসময়ে রতন মাঝিকে ডেরায় ফিরতে দেখেনি কখনো। সারাণই কঠিন এক আবরণ রতন মাঝির মুখটাকে ঢেকে রেখেছে।

সেই মাঝি আজ কাঁদছে। বাচ্চাদের মত ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। গায়ে চিমটি কাটে নলীনি। স্বামীকে সত্যি সত্যি কাঁদতে দেখে ভয়ে বুক কাঁপে নলীনির। আঁচলের নিচ থেকে ভাতের থালা নামিয়ে রাখে আমগাছ তলায়। তারপর এক’পা, দু’পা করে এগিয়ে যায় স্বামীর দিকে। আবার ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। শেষে পা’দুটোকে শক্ত করে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় স্বামীর পাশে। বারকয়েক চেষ্টার পর মাথায় হাত রাখে স্বামীর। 

কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চায়: কি হইছে আপনের? পোলাপাইনের মত কানতাছেন ক্যান? এই অসময়ে ফিরাই বা আইলেন ক্যান? রতন মাঝি কান্না থামিয়ে বিষন্ন চোখ তুলে তাকায় নলীনির দিকে। উঠে দাঁড়ায় নলীনির মুখোমুখি হয়ে। হাত রাখে নলীনির কাঁধে। বিষন্ন গলায় বলে: আমাগ সর্বনাশ হইয়া গেছে বউ। সর্বনাশ হইয়া গেছে।

নলীনি কিছু বুঝতে পারে না। বোকার মত তাকিয়ে থাকে স্বামীর বিধ্বস্ত মুখের দিকে। বিয়ের পর আজ এতটা দিন একই চৌকিতে মাঝির পাশে ঘুমিয়েছে নলীনি। রোজ সকালে আযানের সময় উঠে মাটির হাঁড়িতে ভাত চড়িয়েছে। ভাতের হাঁড়ি উপুর হলে মাঝি উঠে ঘাটে গিয়েছে। পাঁচ মিনিটের মাথায় গোছল সেরে এসে বসেছে ঘরের মেঝেতে পিঁড়ি টেনে। নলীনি তারই মাঝে শাঙ্কিতে ভাত বেড়ে মাঝির সামনে রেখে পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে। কাঁচা মরিচ ভেঙ্গে সে ভাত মাঝি নাকে মুখে দিয়ে গো-গ্রাসে গিলে। 

তারপর ছুটে যায় ঘাটে। নাও ভাসিয়ে দেয় মেঘনার বুকে। বিরামহীনভাবে সারাদিন ভেসে বেড়ায় মেঘনার জলে। এ ঘাট থেকে সে ঘাটে। সে ঘাট থেকে অন্যঘাটে। মানুষ পার করে। সন্ধ্যার শেষে কান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফেরে। তার আগেই নলীনি কুপিতে আগুন দিয়ে শাঙ্কিতে ভাত বেড়ে রাখে। মাঝি ঘাট থেকে হাত মুখ ধুয়েই ফেরে। ডেরায় ঢুকেই পিঁড়ি টেনে বসে গো-গ্রাসে ভাত খায়। খেয়েই গা এলিয়ে দেয় চৌকিটাতে। মাথার নিচে তেল চিটচিটে বালিশটা রেখে। কখনো নলীনির শরীরটাকে নিয়ে নিজের মত করে কিছুণ খেলে। খেলা শেষে অন্যপাশ ফিরে শুয়েই নাক ডাকতে শুরু করে।

আজ এতটা সময় এ নিয়মের বাইরে স্বামীকে মুহূর্তের জন্যও দেখেনি নলীনি। সংসারের কথা, নলীনির ভাল থাকা না থাকার কথা এসব যেন রতন মাঝির ভাববার কোন বিষয় নয়। পৃথিবীর নিয়মের বদল হতে পারে কিন্তু রতন মাঝির এ নিয়মের কোন হেরফের নেই। রতন মাঝির মুখের চেহারাতেই নেই কোন পরিবর্তন। সেই মুখে আজ কান্না। নলীনি কিছু ভাবতে পারে না। বোকার মত তাকিয়েই থাকে শুধু মাঝির বিধ্বস্ত মুখের দিকে। 

রতন মাঝি নলীনির কাঁধ ঝাকিয়ে আবার বলে : বৌ। আমাগ সর্বনাশ হইয়া গেছে। রতন মাঝির হাতের ছোঁয়ায় এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলে যায় নলীনির সারা শরীরে। যে অনুভূতি বিয়ের কথা পাকা হবার পর থেকে কল্পনা করে এসেছে নলীনি। আজও খুব স্পষ্ট করে মনে আছে নলীনির :

art

একদিনের কথাতেই রতনমাঝির বৌ হয়ে এসেছিল নলীনি। ষোল বছরের চঞ্চলা তরুণী নলীনি সেদিন মাঠে ছাগল খোঁটা দিয়ে উঠানে এসে দাঁড়িয়েছিল মাত্র। কোত্থেকে মা দৌড়ে এসে সেখান থেকে আড়াল করে নিয়েছিল নলীনিকে। কিছুণ পর পাশের বাড়ি থেকে শাড়ি ধার করে এনে নলীনির গায়ে জড়িয়ে ঘরে বসা কয়েকজন লোকের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছিল নলীনিকে। লোকগুলো আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিল নলীনিকে। শেষে বিশ টাকা নলীনির হাতে গুজে দিয়ে তারা কন্যা পছন্দের রায় ঘোষণা করেছিল।

সেদিনই সন্ধ্যাবেলা গরুর গাড়ির ছই এর ভেতর বসে রতন মাঝির ডেরাঘরটায় উঠে এসেছিল নলীনি। ছই এর ভেতর রতন মাঝির পাশে বসে নলীনির বুকের ভেতর সে কি কাঁপুনি। ডেরাঘরের খালি চৌকিতে ঘোমটা টেনে বসে সে কাঁপুনি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল। নতুন জীবনের অনাগত সুখ-দুঃখের কল্পনা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল নলীনিকে। নলীনির এসব ভাবনা, ভয়, ভাললাগার মাঝেই রতন মাঝি কোত্থেকে এসে ডেরায় ঢুকে। ডেরাঘরটার ছোট্ট মেঝেতে খানিক পায়চারী করে। তারপর নলীনির সামনে এসে দাঁড়ায়। কোন ভুমিকা ছাড়াই হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলে নলীনির ঘোমটা। 

তারপর অগ্নিমূর্তি হয়ে বলেছিল : খানকি মাগির বাচ্চা! নাও দিবার কতা আছিল, নাও না লইয়াই আইলি ক্যান! বিয়া তরে করছি না নাওরে করছি বুঝবার পা্রসনা। ফিরা যাত্রায় নাও না লইয়া আইছসতো চুলের মুডি ধইরা বাইর কইরা দিমু। 

 

কথাসাহিত্যিক ড. রিটা আশরাফ
নরসিংদী জেলার সদর থানার চিনিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়ার সময় স্বরচিত কথাসাহিত্য প্রতিযোগিতায় বহুবার প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। কথাসাহিত্য রচনায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকেও। 
ড. রিটা আশরাফ বর্তমানে বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এইউবি) বাঙলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং একই সঙ্গে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন থেকেই। 
তাঁরই সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকা। পেয়েছেন ভারতের বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন সম্মাননা (২০১৪), ভিন্নমাত্রা সাহিত্য সম্মাননা (২০১০), গঙ্গা-গোবিন্দ সাহিত্য সম্মাননা (২০১৫), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি সহিত্য পত্রিকা সম্মাননাসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সন্মাননা।
রিটা আশরাফের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বালুচরে বসতি (উপন্যাস), নৈবেদ্যর নারী (উপন্যাস), বিবর্ণ স্বাধীনতা (উপন্যাস), একটু ভুলের অনুভূতি (উপন্যাস), তুতুলের খড়গোশ শিকার (শিশুতোষ গল্প), মামদোভূতের পুত (শিশুতোষ গল্প সংকলন) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনলো যাঁরা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে তৎকালীন বিশ্ব (গবেষণা), নজরুলের কুহেলিকা : একটি সার্বিক পর্যালোচনা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে উপমা (গবেষণা) ইত্যাদি।

 

আগামীকাল পড়ুন, ড. রিটা আশরাফের ‘মধ্য রাতের নদী’-এর দ্বিতীয় পর্ব... (চলবে...)

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!